অবরোহী পঞ্চদশঃ

আমার একটি ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে উদ্ভব হয় কবিতার অবরোহী পঞ্চদশ প্রকরণ। এই ধারার প্রথম কবিতা “প্রকাশ লুকানো যায় ভালোবাসা নয়” । এই লেখাটি ১৫ লাইনের এক বিশেষ ধরনের কবিতা যার প্রতি লাইনে বর্ণসংখ্যা লাইন সংখ্যার সমান । অর্থাৎ ১৫ লাইনের এই কবিতায় লাইনগুলো ১-২-৩-৪-৫-৬-৭-৮-৯-১০-১১-১২-১৩-১৪-১৫ এই লাইন ও বর্ণসংখ্যার ক্রম মেনে চলবে । এই লেখায় এভাবে মোট ১৫ টি লাইনে সর্বমোট ১২০টি বর্ণ আসবে । এই লেখার আকৃতি অনেকটা পিরামিড বা পর্বতের মত দেখতে হয়, বাংলা বা ইংরেজি উভয় ভাষায়ই পিরামিড আকৃতির কবিতা লেখার প্রচেষ্টা কিছু কিছু দেখা যায়, কিন্তু এরকম লাইন এবং বর্ণ সংখ্যা মেনে কোন কাজ হয়নি । প্রচলিত পিরামিড কবিতায় লাইন ভেঙে পিরামিড বা পাহাড়ের শেপ দেয়া ছাড়া আর কোন সুনির্দিষ্ট বাহ্যিক বা অন্তঃস্থ গাঠনিক কাঠামো না থাকায় এটিকে কোন ঘরানা হিসাবে দাড় করানো সম্ভব নয় যা Reproduce করা যাবে, সেই জায়গায় একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও আকর্ষণীয় সুনির্দিষ্ট বাহ্যিক বা অন্তঃস্থ গাঠনিক কাঠামো নিয়ে এলো এই অবরোহী ঘরানার লেখা, অবরোহী ধারণা থেকে পরে বিবর্তিত হয়ে এসেছে আরোহী ও সমারোহী কবিতার ধারণা । এই ধারাটি বোঝার জন্য “প্রকাশ লুকানো যায় ভালোবাসা নয়” কবিতাটিকে লাইন অনুসারে বিশ্লেষণ করে দেখানো যেতে পারে ।

লাইন-কবিতা-বর্ণসংখ্যা

০১-কি-০১
০২-করে-০২
০৩-বললে-০৩
০৪-চলে যাবে ?-০৪
০৫-নিয়তি যদি-০৫
০৬-তোমার আমার-০৬
০৭-ভাগ্যরেখা মিলন-০৭
০৮-বিন্দুতে না বেঁধে দিত-০৮
০৯-তোমার কান্না আমাকেও-০৯
১০-কেন আকূল করে কাঁদাল ?-১০
১১-যদি ভালো না বাসো আমায়-১১
১২-দুচোখ বেয়ে নামা দুঃখ নদীর-১২
১৩-জলধারা কি করে তোমার সুখের-১৩
১৪-ঘরে কাঁটার ক্ষত হয়ে বিঁধে রইল ?-১৪
১৫-অপ্রকাশে ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না ।-১৫

আরোহী পঞ্চদশঃ

আরোহী পঞ্চদশ ধারাটি অবরোহীর বিপরীতক্রমে অর্থাৎ ১৫ শব্দে শুরু হয়ে এক শব্দে এসে শেষ হবে, এটির আকৃতির সাথে পিরামিডের কোন মিলও থাকবে না বা এই ধরনের কোন কাজ বাংলা বা ইংরেজি কোন ভাষার সাহিত্যেই হয় নি । আরোহী পঞ্চদশ প্রকরনের প্রথম কবিতা “তৃতীয় পক্ষ” । এটি অবরোহীর বিপরীত ক্রমে বা লাইন ও বর্ণসংখ্যা একে অন্যের বিপরীত অনুক্রমে বসবে । “তৃতীয় পক্ষ” কবিতাটিকেক লাইন অনুসারে বিশ্লেষণ করে দেখানো যেতে পারে । তার হৃদয় ভেঙে চলে যাওয়া অথবা

লাইন-কবিতা-বর্ণসংখ্যা

০১-তার হৃদয় ভেঙে একাকী চলে যাওয়া-১৫
০২-কিম্বা নিছক প্রয়োজনে ফিরে আসার-১৪
০৩-সাদামাটা কষ্টের কাহিনীতে আমি-১৩
০৪-শুধুই উপেক্ষিত তৃতীয় পক্ষ-১২
০৫-অথচ আমার জীবন গল্পে-১১
০৬-সে ছিল জীবন্ত জলছবি,-১০
০৭-একসাথে পথ চলেও-০৯
০৮-আমাদের জীবনের-০৮
০৯-গল্পটি প্রেম নয়-০৭
১০-এক চতুষ্পদী-০৬
১১-কষ্টের গল্প,-০৫
১২-বোঝাপড়া,-০৪
১৩-জীবন,-০৩
১৪-আমি,-০২
১৫-সে ।-০১


প্রকরণ বিশ্লেষণঃ

অবরোহী শব্দটি এসেছে অবরোহ শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ উপর থেকে নিচে নেমে আসা, এর বিপরীত শব্দ আরোহী । এই কবিতা পর্বতারোহীর মত অবরোহী কবিতা উপর থেকে নীচে স্ফীত হয়ে নেমে এসেছে বলে এই নাম, আর উল্টোটি হল আরোহী । শাব্দিক অর্থ ছাড়াও আরোহ এবং অবরোহ যুক্তি বিদ্যায় বিশ্লেষণ ও সত্য অনুসন্ধানে শব্দ দুটির ব্যবহার হয়, এই কবিতায়ও আছে গঠনগত আদলের সাথে ভেতরে এক অন্ত নিহিত সত্য খোঁজার প্রয়াস। অনিশ্চিত পৃথিবীতে মানুষ যুগে যুগে বিভিন্নভাবে সত্য খুঁজেছে। অনুসন্ধিৎসু মন বারবার মানুষকে নানা গোলক ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। এ ধাঁধা মানুষকে সত্যে উপনিত হতে সাহায্য করেছে। সত্যের আপাত-স্ববিরোধীতায় দার্শনিকদের আসল মজা। Soren Kierkegaard বলেছিলেন “ The thinker without paradox is like a lover without feeling, a paltry mediocrity.” কোন তত্ত্বীয় আলোচনায় না গিয়ে আজকে যুক্তিশাস্ত্রের দুটি সাধারণ বিষয়ের উপর একটু দৃষ্টি দিব।

বিজ্ঞান-গবেষণা-যুক্তিশাস্ত্রে দুটি স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে
১) অবরোহ (Deductive)
২) আরোহ (Inductive)

অবরোহ (Deductive): একটি চূড়ান্ত সত্যের মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত/ প্রমানিত একটি সত্য থেকে কতোগুলো সরল সত্যে উপনিত হওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে অবরোহ।

উদাহরণঃ ০১
-মানুষ মরণশীল
-আবুল একজন মানুষ
সুতরাং আবুল মরণশীল

উদাহরণঃ ০২

মাছ জলজ প্রাণী
রুই একটি মাছ
সুতরাং রুই জলজ প্রাণী

আরোহ (Inductive) এটা হচ্ছে কতোগুলো সরল সত্যের মাধ্যমে একটি সাধারণ সত্য বা চূড়ান্ত সত্যে উপনীত হওয়া।

উদাহরনঃ ০১
আবুল মরণশীল
রহিম মরণশীল
করিম মরণশীল
চুড়ান্তঃ সব মানুষ মরনশীল

উদাহরণঃ ০২

শিং মাছ জলজ প্রাণী
কৈ মাছ জলস প্রাণী
রুই মাছ জলজ প্রাণী
চূড়ান্তঃ সব মাছ জলজ প্রাণী ।

এভাবে আরোহী ও অবরোহী কবিতায়ও থাকতে পারে জীবন ও জগতের ভাল মন্দের গোলক ধাঁধা থেকে সত্য খোঁজার প্রয়াস । এই ঘরানার পরবর্তী প্রকরণগুলোর ভেতর রয়েছে, সমারোহী, উভরোহী
দ্বিরোহী ইত্যাদি । পনের লাইনকে আদর্শ ধরা হলেও এই ঘরানার কবিতা হতে পারে যে কোন সংখ্যক লাইনের । তবে শর্ত একতাই লাইন সংখ্যা ও বর্ণসংখ্যার এই সম্পর্ক বজায় থাকতে হবে ।
আমি আবারও বলছি লাইন এবং বর্ণ সংখ্যার  সমতা রেখে অবরোহী ঘরানার কবিতা অনেকটা পিরামিডের আকৃতি নেয়, পিরামিড আকৃতি কবিতা বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যে নতুন কিছু নয়, তবে প্রচলিত পিরামিড কবিতায় লাইন ভেঙে পিরামিড বা পাহাড়ের শেপ দেয়া ছাড়া আর কোন সুনির্দিষ্ট বাহ্যিক বা অন্তঃস্থ গাঠনিক কাঠামো না থাকায় এটিকে কোন ঘরানা হিসাবে দাড় করানো সম্ভব নয় যা Reproduce করা যাবে, সেই জায়গায় একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও আকর্ষণীয় সুনির্দিষ্ট বাহ্যিক বা অন্তঃস্থ গাঠনিক কাঠামো নিয়ে এলো এই অবরোহী ঘরানার লেখা, অবরোহী ধারণা থেকে পরে বিবর্তিত হয়ে এসেছে আরোহী ও সমারোহী কবিতার ধারণা । আরও বিবর্তিত হয়ে এসেছে উভরোহী ও দ্বিরোহী । এখন তাহলে আসি এই ঘরানার সাথে প্রচলিত পিরামিড আকৃতির  লেখার মুল পার্থক্যের জায়গাটি আসলে কি, দশজন পিরামিড কবিতা লিখলে ভাব ও আকৃতিতে দশ রকম হবে কিন্তু সনেট বা হাইকুর মত অবরোহী, আরোহী ও সমারোহীর সুনির্দিষ্ট বর্ণভিত্তিক বাহ্যিক ও  যুক্তিনির্ভর অন্তঃস্থ গাঠনিক কাঠামো থাকায় এটি একটি সুনির্দিষ্ট ঘরানা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, এই ধারায় লেখার সাফল্য সংশ্লিষ্ট লেখকের শব্দের দখলের উপর নির্ভর করে, আকৃতি ঠিক রাখতে গিয়ে বিকল্প শব্দের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ বেছে নিতে হয় বলে এই ঘরানা চর্চায় শব্দের উপর দখল বাড়ে । এই ধারা এখন সম্প্রসারন পর্যায়ে, আরও অনেক গবেষণা ও চর্চা দরকার আছে এই বিষয়ে । এই প্রকরণের লেখাকে এটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কাজ করতে হবে সবাইকে,কবিতা প্রেমী বন্ধুদের কলমে অবরোহী বা আরোহী লেখা হতে পারে এই অগ্রযাত্রায় একটি শুভ পদক্ষেপ । ধন্যবাদ ও ভালোবাসা ।