কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা বৈষয়িক প্রায় সব দিকেই খুব সচেতন। কোন কিছুতেই তারা কারো চেয়ে কম যান না। সমাজে ঘাগু লোক হিসেবে পরিচিত এরকম অনেকেরই ছাতা বিষয়ক একটি কমন সমস্যা আছে, একবার ছাতা হাতে ঘর থেকে বের হলে তারা হয়তো সব কাজ ঠিকঠাক মত সেরে ঘরে ফিরবেন কিন্তু ছাতাটি ঘরে ফিরবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমি নিজেও কিঞ্চিত এই গোত্রভুক্ত একজন মানুষ, আমার কবলে পড়ে অদ্যাবধি কত নামী বেনামী ছাতাকে যে জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতসারে হাতে বেহাতে পড়ে অকাতরে সতীত্ব বিলিয়ে দিতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই । সেইসব কাহিনী লিখতে গেলে বিশাল কলেবরের একঘেয়ে ছাতা উপাখ্যান হয়ে যাবে। তাই সেদিকে না গিয়ে আজ ছাতা বিষয়ক একটি ভিন্নধর্মী কাহিনী বলব । তখন আমি সি এ আর্টিকেল স্টুডেন্ট । অডিটের কাজে সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয় । একবার গিয়েছিলাম এল জি ই ডি মিনিস্ট্রির পক্ষ থেকে এন জি ও কেয়ার বাংলাদেশকে দেয়া রুরাল মেইন্টেন্যন্স ফান্ড অডিটের কাজে । আমার দায়িত্ব পড়েছিল চট্টগ্রাম জোনে । তৎকালীন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয়টি ব্যাংক সোনালী, রুপালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী এবং কৃষি ব্যাংক আকউন্ট থেকে এই লোনের টাকা দেয়া হয়েছিল, ওখানে আমাদের মুল কাজটি ছিল কেয়ার বাংলাদেশ থেকে দেয়া ফান্ডের হিসাব ব্যাংক হিসাবের সাথে রিকনসিলেশন করা । এজন্য বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরে কাজ করতে হত আর প্রতিদিন সন্ধায় ব্যাংক থেকে পাওয়া হিসাবের কপি ঢাকা অফিসে পাঠানো। তখন বর্ষাকাল সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এই বিবেচনায় কাজের স্বার্থে সি এ ফার্ম থেকে আগেই রেইনকোর্ট কিনে দেয়া হয়েছে, প্রথমে আকাশের অবস্থা ভালোই ছিল কিন্তু কাজের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে খুব জোর বর্ষণ শুরু হয়ে গেল । শুধু রেইনকোর্ট পড়ে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না তাই বৃষ্টির অসহযোগের তোড়ে শেষ পর্যন্ত একটি ছাতাই কিনে ফেলতে হল। এর আগেই বহু ছাতা হারানোর রেকর্ডে আমার ব্যক্তিগত প্রোফাইল অতীব সমৃদ্ধ । তাই প্রথম দিন বেশ ভয়ে ভয়ে ছাতা নিয়ে বের হলাম এবং অতি সাবধানতা বশত সারাদিন ছাতা আগলে আগলে রাখাতে সন্ধ্যায় কাজ শেষে আমি এক নতুন রেকর্ড স্থাপন করে ছাতা সাথে নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ফটিকছড়ি শাখা থেকে বের হলাম। এখন কাজ সারাদিনের সংগৃহীত রিপোর্টগুলো ঢাকায় কুরিয়ার করে পাঠানো । বাইরে যথারীতি অবিরাম বৃষ্টি ঝড়ছে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বৃষ্টি অব্যহত থাকলে সাধারনত ছাতা হারানোর ভয় কম থাকে কারন বৃষ্টির মধ্যে বের হতে গেলেই ছাতার কথা মনে পড়ে যায়। সমস্যা হয় যদি কখনো বৃষ্টির ভেতর কোথাও গিয়ে ফিরে আসার সময় বৃষ্টি থেমে যায়, তখন ছাতার কথা কিছুতেই আর মনে থাকে না। এরকম ক্ষেত্রে বেশীরভাগ মানুষেরই সাধারনত ঘরে ফেরার পর ছাতার কথা মনে পড়ে, এই বিচারেও আমি এককাঠি সরেস, আমার এটি মনে পড়ে সাধারনত পরবর্তীতে যখন ছাতার প্রয়োজনে খুঁজতে গিয়ে ছাতা না পাওয়া যায় তখন। ব্যাংক থেকে আমি ছাতা হাতে নিয়ে রেইনকোর্ট গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলাম পার্শ্ববর্তী কুরিয়ার সার্ভিসের দোকানের উদ্দেশ্যে। দোকানে গিয়ে দেখলাম বেশ ভীর, যাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে তারাও বৃষ্টির কারনে বের হতে পারছে না । আমি ভীর ঠেলেই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম, ভেজা ছাতাটি কোথায় রাখা যায় ভেবে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি সামান্য দূরে কার্নিশ মত একটি জায়গায় সবুজ বাটের একটি বহু ব্যবহৃত পুরনো ভাঙা ছাতা ঝুলিয়ে রাখা আছে, আমি ঐ ছাতাটির পাশে আমার সদ্যকেনা নতুন ছাতাটি রেখে রিপোর্ট কুরিয়ার করার জন্য কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম, ভীর থাকাতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল কাজ শেষ করতে । কাজ শেষ করে ছাতা নিতে এসে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, আমি যেখানে আমার ছাতাটি রেখেছিলাম সে স্থানটি ফাঁকা কিন্তু সেই সবুজ বাটের পুরনো ছাতাটি সগৌরবে তার নিজের স্থান দখল করে রেখেছে । বাইরে বৃষ্টি একটু কমে আসাতে দোকানেও ভীর কিছুটা কমে এসেছিল । আমি ঘটনা দেখে ঐ পুরনো ছাতাটি নিয়ে কাউন্টারে বসা কুরিয়ারের লোকটিকে ঘটনা খুলে বললাম । সে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এই সবুজ ছাতাটি কার বা কার্নিশের কাছ থেকে কেউ একটি কালো ছাতা নিয়েছেন কিনা । কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও এই ছাতার মালিক বা আমার ছাতার কোন খোঁজ না পাওয়াতে কুরিয়ারের লোকটি আমাকে বলল মনে হয় ঐ ছাতার মালিক তার পুরনো ছাতাটি বদলে আপনার নতুন ছাতা নিয়ে গেছে, আপনার ছাতাটি মনে হয় আর ফেরত পাবেন না, কি আর করবেন বলুন, আপনিই বরং এই পুরনো ছাতাটি নিয়ে যান । আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কোন উপায় না দেখে বিরক্তি সহকারে আমি ঐ সবুজ বাটের ভাঙা ছাতাটি নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে এলাম। এরপর ঐ কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরতে আরও সাতদিন লাগলো । সাতদিনে ভুল করে ঐ ছাতাটি একবার ব্যাংকে এবং আরেকবার খাবার হোটেলে ফেলে এসেছিলাম, দুইবারই ছাতার খোঁজ করতে গিয়ে ফিরে পেয়েছি । ঢাকা এসে দেখলাম ঐ ছাতাটি আসলেই একটি বিস্ময় । ঢাকা ফিরে প্রথমবার ছাতাটি ভুল করে ফেলে এলাম একটি চুল কাটার সেলুনে, পরদিন গিয়ে যথারীতি ফেরত পেলাম । এরপর ফেলে এলাম চায়ের দোকানে এবং পরে গিয়ে ফেরত পেলাম । এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকলো । যেখানেই ছাতাটি ফেলে আসি গিয়ে ফেরত পাই। কেউ ভুল করেও এই ছাতাটি কখনো নিয়ে যায় না । এরপর একবার অডিটের কাজে গেলাম গাজীপুর, এবং কাজ শেষে আমার নিজস্ব স্টাইলে যথারীতি ছাতাটি ফেলে ঢাকায় ফিরে এলাম । পরদিন ক্লায়েন্টের অফিসে ফোন দিয়ে কাজের কথার ফাকে একটি ছাতা ফেলে এসেছি কিনা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পিওনকে ডাকিয়ে জেনে আমাকে জানালেন যে সে ছাতাটি পেয়েছে । তিনি আরও বললেন আপনাকে তো সামনের মাসে আবার আমাদের এখানে আসতে হবে তাই আমি ছাতাটি রেখে দিচ্ছি আপনি তখন নিয়ে যাবেন । বলাই বাহুল্য আমি একমাস পর গিয়ে ঐ ছাতাটি বহাল তবিয়তে ফেরত পেয়েছিলাম। এই ছাতাটি আমি আরও বছর দুয়েক ব্যবহার করেছিলাম এবং দুই বছরে আরও অসংখ্যবার ছাতা হারিয়েছি এবং ফেরত পেয়েছি । আসলেই এ এক বিস্ময়, এখন পর্যন্ত আমার কোন ছাতা ব্যবহারের রেকর্ড সময় । অনেকের মনেই বোধহয় প্রশ্ন জাগতে শুরু করে দিয়েছে আসলেই তো ঘটনা কি। এটি কি কোন অলৌকিক ছাতা । যদিও আমি নিশ্চিন্ত নই তবুও আমার মনে হয় ব্যপার সেরকম কিছু নয় । ছাতাটি এতো বেশী পুরনো ও ভাঙা যে কেউ ভুল করেও নিতে আগ্রহবোধ করে না । একসময় ঐ ছাতাটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে আরেকটি ছাতা কেনার সময় ছাতার দোকানীকে মজা করে এই কাহিনী শোনালে সে আমাকে বলল এই খবর পেলে তো ছাতা কোম্পানিগুলো পুরনো ছাতা উৎপাদন শুরু করবে আর ক্রেতারাও নতুন ছাতার বদলে পুরনো ছাতাই কিনতে চাইবে । এখন তো আপনি কোথাও পুরনো ছাতা কিনতে পাবেন বলে মনে হয় না, এখন বরং নতুন একটি ছাতা নিয়ে যান গতবারের মত কোথাও কারো ব্যবহার্য পুরনো ছাতা দেখলে আপনার নতুন ছাতাটি তার পাশে রেখে দিয়ে চুপিসারে সটকে পরে দেখতে পারেন ঐ ছাতার মালিক সদয় হন কিনা । তবে দূর থেকে লক্ষ্য রাখবেন, নাহলে বেশী সদয় হয়ে দুটো ছাতাই নিয়ে যেতে পারে । আর এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে কোন ছাতা সারাইয়ের লোকের কাছে কিছু টাকা দিলে সেই আপনার ছাতাটিতে নতুন কাপড় বদলে ফেলে পুরনো কাপড় লাগিয়ে দেবে । ফলে আপনি আবার পেয়ে যাবেন আরেকটি পুরনো অক্ষয় ছাতা । যারা সচরাচর ছাতা হারিয়ে ফেলেন তাদের জন্য এটি আসলেই হতে পারে একটি মূল্যবান পরামর্শ ।
বিদ্রঃ বাইরে এখন একটানা ঝমঝম বৃষ্টি, ছাতা এখন একটি নিত্য অনুষঙ্গ তাই আজ আলোচনা সভায় দিলাম ছাতা নিয়ে আমার পুরনো অভিজ্ঞতামূলক এই লেখাটি ।