স্কুলে পড়ার সময় 'আমার প্রিয় কবি' শিরোনামে রচনা লিখতে গিয়ে আমরা অনেকেই কাজী নজরুল ইসলামের কথা বলেছি। অবশ্য কবির সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে যায় একেবারে ছোটবেলায়। ক্লাস টু-তে পড়েছি, 'আমি হবো সকাল বেলার পাখি'। তারপর বড় হতে হতে তিনি অন্য ও ভিন্নমাত্রায় আমাদের সামনে ওঠে এসেছেন। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক উইনস্টন ই. ল্যাংলির নজরুলপ্রীতি নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আয়োজনে আমি এই ব্যাপারটি জেনে এই সম্পর্কে পড়তে উৎসাহী হই।  কী করে নজরুল সম্পর্কে অধ্যাপক উইনস্টন ই. ল্যাংলি  আগ্রহী হলেন এবং লেখকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্কের বিবরণ আমাকে টেনেছিল। প্রসঙ্গক্রমেই চলে এসেছে নজরুলকে মূল্যায়ন করে অধ্যাপক ল্যাংলি কর্তৃক রচিত Kazi Nazrul Islam and the voice of poetry in the affairs of human kind প্রবন্ধটি। এ পরিচ্ছেদে লেখক ল্যাংলি কর্তৃক নজরুলের সৃষ্টির বিভিন্ন গবেষণা এবং বিশ্লেষণকে তুলে ধরেছেন। এখানে অবাক করা ব্যাপার হলো, ল্যাংলি যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেভাবে বিশদ আকারে নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন, সেভাবে আমাদের দেশীয় কোনো পণ্ডিত কখনো পারেননি।
যাই হোক, আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যাকে অনেকগুলি অভিধায় অভিহিত করা হয়- বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, সাম্যের কবি, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কবি। সবগুলি বিশেষণই তাঁর ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি হচ্ছেন, লড়াকু একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিয়েছিলেন। যিনি হার মানিয়েছিলেন সময়কে, নিজের জন্মগত দুর্ভাগ্যকে। আমার কাছে নজরুল মানে লড়াই করে যাওয়া- সকল পরিস্থিতিতে, সকল স্থানে, সকল সময়ে।  এই দ্রোহ, সাম্য আর প্রেমের কবিও প্রেমে পরেছিলেন। বাজিয়েছিলেন বাশি, লিখেছেন কবিতা, গান, গল্প আর কিছু অসাধারণ চিঠি- রমণীর মন পাবার আশায়। তার জীবনে তিনজন নারীর আগমন সুস্পষ্ট। তারা হলেন-  সৈয়দা খানম; প্রমীলা সেনগুপ্তা এবং ফজিলতুন্নেসা জোহা।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।  কারো কারো মতে, তাদের পরিচয় হয়, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে নৌশেরার ট্রেনিং শেষে ১৯১৯ সালের দিকে নজরুল করাচিতে অবস্থান করছিলেন। সম্ভবত তখনই আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। পরিচয়ের শুরু থেকেই তিনি চাচ্ছিলেন, নজরুলকে হাতে কব্জায় রাখতে, কারন শিশু সাহিত্যে নজরুল সিদ্ধহস্ত। তাকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে, আর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নজরুল চিরকালই উদাসীন। তাই নজরুলের সাথে সম্পর্ক গভীর কিংবা তার উপর প্রভাব বিস্তার করার মানসে আলী আকবর খান নজরুলকে কুমিল্লায় নিয়ে আসেন বেড়ানোর নাম করে। কলকাতা থেকে ট্রেনে কুমিল্লা আসেন তারা, সেইখানে আলী আকবর খান প্রথমে নজরুলকে নিয়ে উঠেন তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন।
বীরেন্দ্রকুমারের সাথে থাকতেন তার মা বিরজা সুন্দরী দেবী (যার আদর-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নজরুলও মা ডাকতেন ) আর তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার  মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তাকে নিয়ে, যিনি দোলন নামেও পরিচিত ছিলেন। চার-পাচদিন এখানে কাটিয়ে তারা দৌলতপুরে চলে আসেন।  খাঁন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে মুন্সী বাড়িতে বিয়ে দেন আলী আকবর খাঁনের বোন আসমতের নেসাকে। বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় এবং আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আসমতের নেসা প্রায়সই বাবার বাড়ি থাকতেন, সেই সাথে তাঁর মেয়ে সৈয়দা খাতুনও। এক পর্যায়ে সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ের দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)। সেই বিয়েতে যোগ দেন নজরুল। জনশ্রুতি আছে এবং ঐতিহাসিকদের মতেও ওই দিনই যুবক নজরুলের প্রথম দেখা হয় ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নজরুল ইরানী ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম। নার্গিসের রূপ মাধুরী ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে দৌলতপুরে দীর্ঘ ৭১ দিন অবস্থান করেন নজরুল। অন্য আরেকটি মতে, নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে।
নার্গিসের প্রতি নজরুলের মুগ্ধতা চোখ এড়ায় না চতুর আলী আকবর খানের। তারই একান্ত ইচ্ছায় ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। ধুমধাম করে বিয়েও হয়, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সেইখানে। আর নজরুলের পক্ষে তার অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী।  কিন্তু বিয়ের আসর থেকে আকদ হবার পরে পরেই তিনি রহস্যজনক কারনেই তিনি উঠে চলে আসেন। কারো কারো মতে কাবিনের শর্ত নিয়ে ঝামেলার কারনে রগচটা নজরুল রাগ করে চলে আসেন। কাবিনে শর্ত ছিলো তাকে ঘর জামাই থাকতে হবে। সেই যে চলে আসেন তিনি আর ফিরে যাননি দৌলতপুরে। অনেকে মনে করেন, রগ কমলে হয়ত নজরুল ফিরে যেতেন দৌলতপুরে কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবীর প্ররোচনার কারনে আর তার ফেরা হয়নি। নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। এক পর্যায়ে মামাতো ভাই নোয়াজ্জস আলী টুক্কু খাঁন (তৎকালীন  ইউপি ভাইস প্রেসিডেন্ট) কোলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছ থেকে এক প্রকার জোর পূর্বকই বিয়ের তালাক নামায় স্বাক্ষর আনেন (১৯৩৭ সালে)। অতঃপর জোর করেই নার্গিসকে বিয়ে দেন ঢাকার হাসানবাদের ছেলে, কবি আজিজুল হাকিমের সাথে। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে ডা. আজাদ ফিরোজ ইউরোপের মেঞ্চেস্টারে চিকিৎসক এবং মেয়ে শাহানারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নার্গিস মারা যান ১৯৮৫ সালে, তাকে সমাহিত করাহয় ম্যানচেস্টারে।
বলা যায় নার্গিসই একমাত্র নারী, যার কল্যাণে পৃথিবীতে নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছিলো।এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কবিতা গুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অ-বেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
প্রমীলা সেনগুপ্তা বা দোলন বিয়ের পর যার নাম হয় প্রমীলা দেবী তার সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় পর্ব আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। আকবর আলী খান ছাড়া কুমিল্লাতে নজরুলের পরিচিত বলতে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (কিভাবে পরিচয় আগেই বলা হয়েছে)। তাই নজরুল রাগ করে বিয়ের আসর থেকে উঠেন বীরেন্দ্রকুমারের বাড়িতেই। রাতে তিনি ও বীরেন পায়ে হেটে চলে আসেন, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। আর  বিরজা সুন্দরী দেবী ও অন্যরা (প্রমীলা দেবীসহ) নজরুলের বিয়ে দাওয়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন দৌলতপুরে। তারা পরের দিন বাসায় ফেরেন।  দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে এসে এবং কয়েকদিনের মানসিক পরিশ্রমের কারনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেন বাড়ির সবার যত্নে তিনি সেরে উঠেন। এইসময়ই নজরুল কিশোরী প্রমীলার প্রেমে পড়েন। এটা হতে পারে প্রমীলার সেবা যত্নে মুগ্ধ হয়ে কিংবা তার প্রথম প্রেমের স্মৃতি হতে মুক্তি পাওয়ার আকুলতা।
১৯২১ সালের নভেম্বর মাসের দিকে কবি কান্দিরপাড়ে এক মাস সময় থাকেন। এই সময়ই কবি সৃষ্টি করেন তার অমর সৃষ্টি “বিদ্রোহী” কবিতা, পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনি আবার কুমিল্লা আসেন। এইবার তার যাত্রা নির্বিঘ্ন ছিলো না। হিন্দু বাড়িতে মুসলিম ছেলের আসা যাওয়া বা হিন্দু মেয়ের সাথে তার প্রেম গোঁড়া হিন্দু সমাজের যুবকেরা মেনে নিতে পারে নাই, তাদের আক্রোশে স্বীকার হন তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও হেনস্তা করেন তাকে।  ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। পরে তিনি কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ১ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কবি চিন্তা করেন তিনি এইবার প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করবেন। কিন্তু প্রথমেই সমস্যা হয়, বিয়ে কোন ধর্মমতে হবে, সিভিল ম্যারিজ আইনে বিয়ে হতে গেলে পাত্র-পাত্রী একই ধর্মের হতে হয়। আবার ইসলাম ধর্মমতে বিয়ে হচ্ছে না, যেহেতু প্রমীলা দেবী তার ধর্ম ত্যাগে রাজী নয়। কিন্তু প্রেম তো জাতি-ধর্ম মানে না। কবি তখন যুক্তি দেন, “আহলে কেতাবিদিগের সংগে ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম আইন মনে অসিদ্ধ নয়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগন ‘আহলে কিতাব’ কিনা? একচলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে হওয়া সম্ভবত আইন মনে অন্যায় হবে না”। (খান মুহাম্মদ মাঈনুদ্দিন)
অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল খুব সাদামাটাভাবে কলকাতায় তাদের বিয়ে হয়। এই বিয়ের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ভীষণভাবে খেপে উঠে, অনেক পত্রিকায় (যেমন প্রবাসী পত্রিকা) তার লেখাও নিষিদ্ধ করা হয়।  ১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।  
হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে। (কবিতাঃহার-মানা-হার)
নজরুল বিয়ে করেন প্রমিলা দেবীকে। কিন্তু তিনি কি ভুলতে পরেছিলেন নার্গিসকে, তার প্রথম প্রেমকে?? চলুন জানি তার নিজের মুখেই-  
''তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ‘ধূমকেতুর’ বিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না...''( নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশ)।
তাছাড়া-
''যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে''।

নার্গিস আর প্রমীলার পর যদি কারও নাম আসে, সেটি মিস ফজিলাতুন্নেসার। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী। ইতিহাস বলে, এই প্রেম ছিল একতরফা, মানে শুধু কাজী নজরুল ইসলামের দিক থেকেই। ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের আকুতিতে সাড়া তেমন একটা দেননি। কিন্তু তাতে কী? কবির মন তো প্রেমের জলে কানায় কানায় পূর্ণ। তাই তিনি বেশ কিছু চিঠি পাঠিয়েছিলেন মিস ফজিলাতুন্নেসাকে। নজরুল আসলে সেসব চিঠি দিতেন তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে। ফজিলাতুন্নেসা মোতাহার হোসেনকে শ্রদ্ধা করতেন বড় ভাইয়ের মতো। কাজী মোতাহার বন্ধুর হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন কবির প্রেমময় চিঠিগুলো। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ‘ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছি—আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।’
ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কবি তখন মুসলিম সাহিত্যসমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ঢাকায়। কবি একটু-আধটু জ্যোতির্বিদ্যা জানতেন। কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। ব্যস! শুরু হয়ে গেল হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কবি চলে গেলেন ঢাকা ছেড়ে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তার পর থেকে নজরুল লিখে চললেন একটার পর একটা প্রেমপত্র।
নজরুলকে ঘিরে আরও কিছু নারীর নাম এসেছে। তাঁদের একজন রানু সোম। পরে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করেন এবং প্রতিভা বসু নামে খ্যাত হন। সংগীতজ্ঞ দীলিপকুমার রায় রানুকে নজরুলের গান শেখাতেন। তাঁর কাছেই নজরুল রানুর কথা শোনেন। উৎসাহী নজরুল নিজেই ঠিকানা খুঁজে ঢাকায় রানুদের বাড়িতে হাজির হন। শুরু হয় রানুকে গান শেখানো। এই গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক পাড়ার যুবকদের সহ্য হয়নি। একদিন রানুদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারা নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুলও পাল্টা আক্রমণ করেন। ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়।
শিল্পী কানন দেবীকেও নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। কলকাতার পত্রিকা শনিবারের চিঠি এ নিয়ে নানা রসাল কাহিনি ছাপতে থাকে। রটানো হয়েছিল যে কবিকে কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতেই পাওয়া যাবে। গান শেখাতে গিয়ে রাত হয়ে গেলে কানন দেবীর বাড়িতে কবির থেকে যাওয়ার ঘটনাকে নিন্দুকেরা গুজব ছড়ানোর জন্য বেছে নেন। ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্রের সাথেও নজরুলকে নিয়ে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো। আবার, “বর্ষবাণী” নামক একটি বার্ষিক পত্রিকা বের করতেন পশ্চিমবজ্ঞের মেয়ে জাহানারা বেগম চৌধুরী (ডাকনাম মীরা), যাতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সব লেখকেরই লেখা ছাপা হয়েছে। মীরার সাথে দার্জিলিং এ গিয়ে নজরুলের পরিচয় হয়। তার কাছে নজরুলের কয়েকটি কবিতা ও গানের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, যেখানে তাকে নিয়ে লেখা কবির কয়েকটি কবিতাও ছিলো। যাই হোক, আমরা সাধারণ পাঠকেরা মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস আমাদের কবি নজরুল বার বার প্রেমে পড়েছিলেন, না হলে এমন সুন্দর সুন্দর প্রেমের গান আমরা কোথায় পেতাম। আর নজরুল জীবনে প্রেম নিরবে নয়, সরবেই ছিল।