সালেহা
— হাসান মাহমুদ
গাঁয়ে গেলে ডাক যে শুনি, "আইছো বাবা তুমি!"
হাসি দিয়ে জবাব দিতাম, "আছেন ভালো আপনি?"
কাঁপা কাঁপা গলায় বলতো, "আর আর থাকা,
চোখটা গ্যাছে, রতও গ্যাছে, আয়ু হচ্ছে ফাঁকা।"
গেলো ইদেও দেখে এলাম, আগের মতো নাই।
দেখে একটু মায়াই হলো, মনেতে দোয়া চাই।
হঠাৎ সেদিন খবর পেলাম, সালেহা আর নাই।
দুঃখে হৃদয় কেঁপে উঠলো, চোখে জলের ঠাঁই।
ছেলে আছে, মেয়ে আছে, সবই ছিলো পর।
আপন ছিলো খোদা তালা, বিশ্বাস রবের উপর।
মেয়ের বাড়ি থাকতো বেশি, নিজের বাড়ির কম।
বৌরা একটু কম বুঝিতো, দোষতো একদম।
ঝগড়া-ফ্যাসাদ বেশিই হতো, শক্তি যখন ছিলো।
ভিক্ষা করে পেট চালাতো, একটু আয়ও ছিলো।
ভিক্ষার টাকায় জমি কিনেছে, বিশাল করেছে বাড়ি।
স্বামীটা ছিলো ফকির মানুষ, আল্লাহ ভিরু তারি।
স্বামীটা তার অন্ধ হলো, ছেলেরা দেখে না আর।
সবার কাছে কঠিন বোঝা, আদর-স্নেহের ভার।
একদিন পরে পা ভাঙলো, কষ্টের সীমা নাই।
সারাদিন সারা পথে ঘুরে, রাতে বাড়ি ঠাঁই।
চোখের জলে দিন যায় স্বামীর ব্যথার দেখে,
তবু সে তো ছাড়ে না হাল, রবের বিশ্বাস রেখে।
একদিন স্বামী হারায় মায়া, পৃথিবীর সকল সাধ।
সালেহা তখন নিঃস্ব হয়ে, বক্ষ ভাসা রাত।
সম্বল তার মেয়ে দুটি, তাদেরই দয়ার ছায়া।
ছেলে-বউরা ফিরায় মুখ, বৃদ্ধা মায়ের মায়া।
যে মা তাদের জন্ম দিলো, করলো কত ত্যাগ।
তারই জায়গা হয় না ঘরে, মা আজ ভিক্ষার ভাগ।
এ বাড়ি ক-দিন, ও বাড়ি ক-দিন, এমনি দিন কাটে।
যুবতী সালেহা বৃদ্ধ আজ, হাতে লাঠি হাঁটে।
আদরের এক নাতি ছিলো, খুবই আদর মাখা।
পুষিতে পুষিতে বড় করেছিলো, তারও নেই দেখা।
বিয়ে দিলো, সংসার হলো, সুখের আশা ছিলো।
সে সুখেও তার ভাটি পড়লো, সুখ শকুন খেলো।
স্নেহ মমতার নাতবউ তার, পিষিলো স্নেহ পাটায়।
দুঃখ বুঝি এমনি হয়, দুঃখ স্নেহ ঘুচায়।
সেখানেও হলো না ঠাঁই, অভাগা বলে দোষে।
অভাগা নাকি যেখানেই যায়, সবই নেয় চুষে।
এভাবেই ফুরালো তার দিন, পৃথিবীর তার ঋণ।
আস্তে আস্তে সোনার দেহ, মাটিতে মিশে ক্ষীণ।
ভারি ব্যথা বুকে ছিলো তার, আত্মার গহীন বনে।
খেয়ে না খেয়ে থাকতো তবু, আপনা বলিত আপনে।
তবু সালেহা চেয়ে থাকতো, রবের দয়ার দিকে।
এই দুনিয়া তো ক্ষণস্থায়ী, মিছে মায়া ফিকে।