।। কবিতার কাব্যিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ।।

কবিতা- অসময়ে অবসর
কবি-এম. মাহবুব মুকুল

প্রথমেই বলে রাখি আমি এখনো ঠিক ঠিক ভাবে কবিতার বিশ্লেষণ করতে পারি না। বার বার কবিতাটি পড়ে তার ভাববস্তু উদ্ধার করার বা অন্তর্নিহিত অর্থ অনুভব করার চেষ্টা করি। সব কবিতা যে বুঝতে পারি তেমনটাও নয়। অনেক সময় এমন হয়েছে কবিতার অলিতে গলিতে প্রবেশ করেছি আবার শব্দের ল্যাম্প পোস্টে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেছি অনেকবার। আমি এটা বিশ্বাস করি যে একজন কবি যখন একটি কবিতা সৃষ্টি করেন তখন তিনি কিছু না কিছু একটা উপহার সমাজকে দেওয়ায়র চেষ্টা করেন। সেটা  জীবনবোধের মাধ্যমেই হোক বা প্রেমের মাধ্যমে বা রম্যের মাধ্যমে বা প্রতিবাদী সুরে। কবিতা যে শ্রেনীর হোক না কেন সমাজের কল্যাণের স্বার্থে কবির কলম চলবে এই বিশ্বাসটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে এবং সমাজের ভালো খারাপ উভয় দিক কবিরা জনসমখ্যে তুলে ধরে সমাজকে সঠিক পথ দেখাবেন এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এবার আসি সম্মানীয় কবি ‘এম. মাহবুব মুকুল’ মহাশয়ের সৃষ্টি “অসময়ে অবসর”  কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে। সম্মানীয় কবি তাঁর  কবিতায় কাব্যিক সৃজনশীল, রচনাশৈলী এবং সুশীল শব্দবন্ধন বিষয়ে যদি বিচার করা হয় তবে তিনি একটি বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদী সুরে কবিতাটি রচনা করেছেন এবং সমাজকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন যে বাইরে যা দেখা যায় ভেতরে কিন্তু সেটা তার বিপরীত হতে পারে।  এই ভাবে যদি চলতে থাকে তবে  সমাজ অবক্ষয়ের দিকে যাবার সম্ভাবনায় বেশি। তাই তিনি কবিতাটি প্রকাশ করেছেন তার “ সভ্যতার আড়ালে” বইতে। অর্থাৎ সভ্যসমাজের আড়ালে অনেক অন্যায় কাজ হয় বা হচ্ছে সেটি তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।  তিনি আবার একটা বার্তা দিয়েছেন যে বদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত জীবনের আনন্দ অনেক বেশি তাতে যদি অভাবের সঙ্গে দিন যাপন করতে হয় তাও ভালো। তাই তিনি সৈনিকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বন্ধনহীন জীবন উপভোগ করার জন্য।   কবি আবার বার্তা দিয়েছেন বিবেকহীন তোষামোদকারী হয়ে তিনি থাকতে চান না। অনিয়ম সহ্য হয়নি তাই তিনি অসময়ে অবসর জীবন গ্রহণ করেছেন মুক্তবিহঙ্গের মতো পথ চলার উদ্দ্যেশ্যে। একজন সৈনিকের করুন জীবনশৈলী সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন কবিতার মাধ্যমে এবং অসাধারণ প্রতিবাদী সৃজনশীল জীবনবোধ ফুটে উঠেছে নান্দনিকভাবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।  

এবার আসি কবিতার অন্য একটা দিক তুলে ধরার জন্য। পাঠকগন মনদিয়ে একটু বিশ্লেষণ করবেন একজন সাধারন দেশবাসী হিসেবে, কাব্যিক মনটাকে কিছু সময়ের জন্য আড়ালে রেখে।  
সম্মানীয় কবি তার  “অসময়ে অবসর”  কবিতার ৫ এবং ৬ নং  লাইনে তিনি লিখছেন-  
“ তাছাড়া তৃতীয় শ্রেনীর চাকরি----(৫)  
তাও আবার সৈনিক পদবীর”---(৬)  
এই লাইন দুটি কোথাও যেন একটু তাচ্ছিল্যের সুরে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি মনে করি সৈনিকের চাকরীর মতো আর গর্বের চাকরি হয় না। সে তৃতীয় শ্রেনীর হোক বা প্রথম শ্রেনীর। সৈনিক নামটার সঙ্গে একটা দেশ সেবার আত্মিক বন্ধন জড়িয়ে থাকে। তাই  “তাও আবার সৈনিক পদবীর” এটা আমাকে কোথাও যেন ব্যাথা দিয়েছে। এই লাইনের মধ্যদিয়ে সৈনিক পদবীটা’কে কোথাও যেন ছোট করে দেখান হয়েছে যেটা আমি মানতে পারছি না। একজন দেশের নাগরিক যখন সৈনিক হয়ে যায় তখন সে আর কেবল মাত্র বাড়ির ছেলে থাকে না। সে হয়ে যায় দেশের সম্পদ।  দেশ মাতৃকার উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশ মাতৃকার সেবায় সবসময় আত্ম বলিদানে প্রস্তুত বীর সৈনিক। তাই প্রত্যেক সৈনিকের মাথার টুপিতে লাগানো হয় দেশের সর্বচ্ছ সম্মানের লোগোটি। যেটাকে দেশের প্রত্যেক নাগরিক সম্মান করে। তাই সৈনিক কখনো মারা যায় না, তারা হন শহীদ।  জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে শেষ যাত্রার সৌভাগ্য সবার সবার হয় না। যাদের সৌভাগ্য হয় তাদের নাম লেখা থাকে স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায়। সকল দেশের সৈনিক’কে আমি সমমর্যাদা জ্ঞাপন করি। তাই দয়া করে “  সৈনিক পদবীটা’কে  তাচ্ছিল্যে করবেন না।    

আবার কবিতার ৭ নং ৮ নং এবং ৯ নং লাইনে কবি লিখছেন-
“ প্রায় সারাটা সময় ন্যায় এর চেয়ে ----(৭)
অন্যায় আর নীতি বিরোধী ---(৮)
আদেশ পালন করা”-----(৯)  
একবার ভাবুন তো, দেশের একটা সৈনিক-এর মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর সত্যি কি এই অবস্থা? তাও আবার বিমান বাহিনীতে,  আমার তো মনে হয় না। যারা দেশের রক্ষাকারী তাদের ভেতরে এতো ঘুন ধরে আছে এটা বিশ্বাস করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে  মনে হতে পারে যে, যা হচ্ছে তা অন্যায় হচ্ছে কিন্তু তা অতিব নগণ্য। যদি বিশাল আকারে হতো তবে  বাহিনীটা টিকে থাকা মুস্কিল ছিল, কিন্তু টিকে আছে। কারন সকলের পখ্যে সব সত্য জানা বাহিনীর নিয়ম বিরোধী। এটাই হচ্ছে বাহিনীর কনফিডেন্সিয়াল ইনফারমেশান। তার পরেও যদি মনে হয় অন্যায় হচ্ছে তবে দেশের সিকিউরিটি এডভাইজারী  কমিটি কে চিঠি লিখে  জানান।  একজন অবসরপ্রাপ্ত দেশের সৈনিক হয়ে কবিতার মাধ্যমে নিজের  দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর নগ্ন রূপ তুলে ধরে আসলে নিজের দেশেরই ক্ষতি করছেন। কবিরা হচ্ছেন সমাজের আয়না তাই কবি বা সাহিত্যিকে চোখ দিয়ে একটা দেশের অবস্থান বোঝা অনেক সহজ। মনে রাখা উচিত দেশ সুরক্ষিত থাকলে তবেই সব ঠিক থাকবে।    

আবার কবিতার ১৪ নং এবং ১৫ নং লাইনে কবি লিখছেন-
“ ক’জনে জানে সৈনিকে নাম লেখালে---(১৪)
জীবনে বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ!—(১৫)  
আমি বুঝতে পারছি না কবি এখানে বড় বলতে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন। যদি ভাবেন আর্থিক দিক থেকে বড় হতে চাই তবে,  সত্যি ক্ষীণ। আর যদি সম্মানের দিক থেকে আমি বলবো কখনোই ক্ষীণ নয় বরং গর্বের। আবার আমি সেই একেই কথা বলবো সৈনিকের চেয়ে আর বড় সম্মান কি আছে। এই দুটো লাইন আমার মনে হয় সমাজের পখ্যে খুব একটা সুখকর নয়। দেশের যুব সমাজের কাছে দেশাত্মকবোধক চিন্তার বাধা সৃষ্টি করতে পারে। দেশের যুব সমাজ আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার প্রবণতাকে তরান্বিত করতে পারে।  তাই সমাজের বার্তা হওয়া উচিত “নিজেরে বিলায়ে দিয়ে সুখী যেই জন, সেই তো পূজিত হয়, কয় গুণীজন। ক্ষুদ্র এ জীবন যেন, কচু পাতায় জল, ঢলিয়া পড়িলে রবে, শুধু কর্মফল ।

আবার কবিতার ৩৬ নং এবং ৩৭ নং লাইনে কবি লিখছেন-  
“ যারা বিবেকহীন নীতিহীন তোষামোদি—(৩৬)
তারা পারে। ----(৩৭)
এখানে কবি বলতে চেয়েছেন তিনি অনেক দিন অন্যায় সহ্য করে চোখ কান বন্ধ করে অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে তিনি সৈনিকে চাকরি করছিলেন। পরে আর অনিয়ম সহ্য হয়নি তাই তিনি “অসময়ে অবসর’ নিলেন।  বেশ ভালো কথা। ভলেন্টারী রিটারমেন্ট সামরিক বাহিনীর একটা নিয়ম। কবি নিয়মের মধ্যে থেকেই অবসর নিয়েছেন কিছু অন্যায় নেই। কিন্তু কবি যেটা লিখলেন কবিতার ৩৬ নং এবং ৩৭ নং লাইনে “ যারা বিবেকহীন নীতিহীন তোষামোদি তারা পারে”। অর্থাৎ যারা বিবেকহীন নীতিহীন তোষামোদি তারা এখনো চাকরি করছেন। একবার ভাবুন তো দু’এক জনের আচরণের মধ্যদিয়ে বাহিনীর সবাইকে দোষারোপ করা যায়?। আর যাদের বাড়ীর লোকটি এখনো সৈনিকে চাকরি করছেন সতভাবে, তাদের হৃদয়ে কতটা ব্যাথা অনুভূত হবে।  

কবি সবার শেষে লিখছেন-
তাই অবসরে চলে আসা’ মুক্তজীবনে।
বেসামরিক জীবনে চলে আসা
মুক্ত বিহঙ্গের মতো পথ চলা।
জীবনকে নতুন করে চেনা।
গাড়ী-বাড়ি নাই, দিন আনি দিন খাই
কোন মানসিক টেনশান নাই।  

কবির শেষ কয়েকটা লাইন পড়ে মনে হল কবি মুক্তজীবনের স্বাদ এখন অনুভব করছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “সংকল্প” কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল-
থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
মানসিক টেনশান বিহীন জীবন সবাই চায়। গাড়ী-বাড়ি ধন সম্পত্তি যতই থাক মানসিক শান্তি যদি না থাকে তবে সুখের অনুভূতির উপ্লব্ধি করা বড়ই কঠিন। এখানে আমি শ্রদ্ধেয় কবি মোঃ সানাউল্লাহ্ (আদৃত কবি) –র মন্তব্যটি উল্লেখ করতে চাই।
“মুক্ত জীবনের আনন্দ  অন্য কোথাও নাই।
তবে, সুশৃঙ্খল জীবনও কল্যাণময়”।


আর সব থেকে বড় কথা সেনাবাহিনীর কাঠামো গত ভাবে র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী চলে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী নয়। যিনি উচ্চ র‍্যাঙ্কে আছেন তার আদেশ নিচু র‍্যাঙ্কের বাহিনীকে মেনে চলতে হবে এটাই নিয়ম। যদি উচ্চ র‍্যাঙ্কের কোন অফিসার অন্যায় আদেশ দেন সে ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানোর নিদ্রিস্ট পদ্ধতি আছে সেনাবাহিনীর রুলের মধ্যে। আর একটু বলে রাখি সেনাবাহিনীতে এমন অনেক কাজ আছে যে গুলি আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে এগুলি আমার উপর অন্যায় করা হচ্ছে। আবার যারা সাধারন মানুষ, এমন কি সেনাবাহিনীর বাড়ীর লোক পর্যন্ত আনেক সময় ভেবে বসেন এগুল ঠিক না। কেন সেইসব কাজ তাদেরকে দিয়ে করানো হয় বা কেন বাইরের লোককে দিয়ে করানো হয় না সেই ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।


আমার যে জায়গাটা নিয়ে বিশেষ ভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা সেটি হচ্ছে প্রত্যেক চাকরির পরিকাঠামোগত বা পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু ফাঁক থেকে যায়। সব সময় হুবহু যা রুল বইতে লেখা আছে তা মেনে কাজ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার (যেমন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ, সেনাবাহিনী, পেরামিলিটারি, সি আই ডি, ইত্যাদি ) কর্মীরা সবাই যদি নিজের তিক্ত অভিঞ্জতার জন্য বিষোদ্গারন করে অফিসিয়াল ইনফরমেশান বা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার ভেতরের খবর প্রতিবাদের নামে বাইরে লিখতে থাকে তাহলে তো দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপদ। অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্যই করা উচিৎ কিন্তু তা পদ্ধতিগত এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।


এবার যদি আচার আচরণের দিক বলেন তো একটাই কথা বলবো সব মানুষের কাছ থেকে সবসময় ভালো ব্যাবহার পাবেন এটা আশাকরা যায় না। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সে যত উচ্চপদে আসিন হোক না কেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু ব্যাক্তি উচ্চপদকে ব্যাবহার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছেন সেই উদাহরণও কম নয়। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্র বিশেষে নিচু তলার কর্মীদের বা তার পরিবার বর্গকে মাঝে মাঝে আহত করেছে যেটা খুবই মর্মান্তিক।


[যাই হোক কাব্যিক চিন্তাধারা থেকে একটু বেরিয়ে নিজে যতটুকু উপ্লব্ধি করতে পেরেছি সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এটা আমার প্রথম কবিতা নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার প্রার্থনা রাখলাম। সকলকে ধন্যবাদ! ]  

কবিতার লিঙ্কঃ https://www.bangla-kobita.com/mmahbubmukul/untimely-reirement/

নীচের দেওয়া আইনগুলি বিশেষ ভাবে পড়ার অনুরোধ রইল সকলের কাছে আশা করছি অনেকটা মনের ধন্ধ কেটে যাবে।      
Army Act, 1952.
Navy Ordinance, 1961
Air Force Act, 1953,  
Official Secrets Act, 1923.