জীবনের সঙ্গে পরিবার, সমাজ, দেশ তথা পৃথিবী অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাই কবিরা যা লিখেন জীবনের সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড, চিন্তা, চেতনা, কল্পরূপ ও বিভিন্ন উপ্রেক্ষার মাধ্যমে কবিতা সৃষ্টি করেন এবং তা তুলে ধরেন। সব ঋতুই কবিদের কাছে মূল্যবান কিন্তু বর্ষা ঋতু চিত্তাকর্ষক। বর্ষার অগ্রদূত হলো মেঘ। তাই বর্ষা এলে অসহ্য ভ্যাপসা গরম দূর হয়, ছেঁড়াছেঁড়া পাল থেকে নেমে আসে বৃষ্টির এক অনন্য বারিধারা, কমে যায় মানুষের কষ্ট, ভরে যায় ধানখেতগুলো। শান্ত, সিন্ধতায় ভরে ওঠে সমাজ, বসুন্ধরা অর্থাৎ মানুষের মন। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রমুখ কবিরা মনোজ্ঞ কবিতা লিখেছেন। কারণ বর্ষা হলো প্রাণভোমরা, মানসপ্রেম।
এই ঋতুতেই মানুষের মনে প্রেম একটু বেশি আঁকিবুঁকি করে, আর কবিদের মনে মানসপ্রেম এবং প্রকৃতি প্রেম দুটোই অত্যন্ত বলশালী আকার ধারণ করে হৃদয়ের মাঝে। প্রকৃতিতে যে কতরূপ আর কত ঐশর্য ছড়িয়ে রয়েছে তা কবিরা এক জীবনে উপভোগ করে আত্মতৃপ্তিলাভ করে শেষ করতে পারেন না। যেমনটি পারেননি জীবনানন্দ দাশ। কারণ তাঁর পরবর্তী যাপিত জীবন কলকাতায় থাকলেও মন সেখানে কারারুদ্ধ করতে পারেননি। মন পড়ে থাকত— র্কীতনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত বরিশালের দেশজ ও গ্রামীণ উপাদানের কাছে। আর প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের একটি অংশ হয়ে ওঠে।
কবির জীবন দুটি সত্তায় বিভক্ত । তাই কবির প্রাণপ্রদ প্রকৃতির রূপ ও ঐশ্বর্য এক জীবনে উপভোগ করা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি বরিশালের প্রকৃতির অপরূপ লীলা আপন আলয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লালন করেছিলেন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের রূপকল্পে, দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে চিত্রায়িত করেছেন বিভিন্ন ঋতুর। এখানে জীবনানন্দে কবিতায় সরাসরি পাওয়া যায় না। যেমনটা পাওয়া যায় বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের: ‘বৃষ্টিপড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।’। তাঁর বর্ষার কবিতা চিত্রকল্পের মাধ্যমে টুকরো টুকরো মেঘের মত ভাসমান অবস্থায় ধরা দিয়েছে। তাঁর মেঘের ভেলার মত ভেসে আসা কবিতার মধু থেকে ‘এই জল ভালো লাগে’ এই কবিতাটি আমাদের ভীষণ হৃদয়ঙ্গম করে। এই কবিতাটি চিত্তে দোলা দেয়। প্রসঙ্গত: কবিতাটি সম্পর্কে কিছু বলার আগে অবশ্যই কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
‘এই জল ভালো লাগে’ কবিতাটি ২২ মাত্রা বহনকারী সনেট। মাইকেল মধুসূধন দত্ত ১৪ মাত্রার অন্তমিলযুক্ত মধ্যযুগের পয়ারকে সনেটে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। তারপর থেকে সনেট উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলায় একটি সৃষ্টিশীল কাব্যিক মাধ্যমে পরিণত হয়। মাইকেল মধুসূধন দত্ত ইতালীয় এই অপরিবর্তিত জিনিসটিকে গঙ্গার তীরে এনে রোপণ করেন। আর বেড়েও ওঠে, ফুলও দিয়েছে, বাংলাও তুলে নিয়েছে এটিকে ঘরে।১
তাঁদের মধ্যে একজন হলো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি কবিতায় ‘এই জল ভালো লাগে’ উচ্চারণেই মন যেন আনন্দ–উদ্বেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই কবিতা দু’টি দিক দেখা যায়। কবি এই জলকে শুধু জল নয় রূপালি জল বলেছেন। আকাশ থেকে বৃষ্টি যখন ঝরতে দেখা যায় তখন রূপার রঙের মতই লাগে। এই জল কবির যেমন ভালো লেগেছিল জলও কিন্তু কবিকে খুব ভালোবেসে কবির দেহ ধুয়ে দিয়েছে, চুল বুলিয়ে দিয়েছে, জলের শান্ত–সিগ্ধ হাত রেখে খেলেছে আবেশ ভরে চোখের ওপর। আবার ঠোঁটে চুমো খেয়েছে কুমারীর ভালোবাসার মতো। কবি এই পর্যায় জলকে প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন কিংবা প্রেমিকা মনে করেছেন। কবি এই ভালোবাসাকে অন্তরালে বা গোপন অর্থাৎ উদাহরণস্বরূপ ফিঙ্গার কথা বলেছেন। ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে বনের ভেতরে এবং বারবার উড়ে যায় সেখানে। আর এই আবেশ থেকে যায় ধানের আবেশে তথা ধান হওয়া পর্যন্ত এ ভালোবাসা বিদ্যমান। কবির মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় যখন হলুদ ধানের ভরাখেত ঝরে পড়েছে। আবার শীতও বিছিয়েছে তুষার চাদরে। আর এই শীতে পেঁচার আগের মতো গান শুনতে পান না, শুনতে পান নরম হিম গান। অর্থাৎ কবি মর্মবেদনায় ভোগেন বর্ষাঋতু চলে যাওয়ায়। আবার বলেছেন বনের কিনারে ঝরে পড়া সেই ধান শান্ত করে শালিক্ষুদে, ঐ ধানের মতোই ঝরেছে চোখে, ঠোঁটে, চুলের ওপরে। এই ঝরে পড়াকে তিনি হারিয়ে যাওয়াকে বুঝিয়েছেন। ‘অপরাহেৃর রোদ সবুজ আতায়’ বিকেলের মৃদু লাল রোদকে নরম হাতের সহিত হয়ত তুলনা করেছেন। আর সেই নরম হাত রেখেছে সবুজ আতাফলে, আতার ভেতরে অংশটুকু দুধের মতো সাদা এবং সুমিষ্ট। তাই কবি বলেছেন, ঢালছে বুকের থেকে দুধ। কবি শেষের ষষ্ঠ স্তবকে রসনাবিলাসের বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ ভোগের বাসনার সঙ্গে তুলনা করেছেন । প্রবল আনন্দধারার পরই কবির মনে বেজে ওঠে বিয়োগ বেদনা।
‘র্মাচ ১৯৩৪ তারিখে সংবলিত এগুলোর একটিতে রয়েছে ৬০ সনেট।’২ আবার রবি দাশগুপ্ত জীবনানন্দ দাশের কাব্যসাহিত্য নিয়ে ‘বাংলার প্রাণ’ নামক প্রবন্ধে যা বলেছেন : তিনি ধূসর পাণ্ডুলিপির রচনাকালেই রূপসী বাংলার সনেটগুলি লিখেন। এই গ্রন্থের ৬০টি কবিতা তিনি কেন প্রকাশ করার কথা ভাবেন নাই সে বিষয়ে কোনো অনুমান না করাই শ্রেয়। কবিতা ১৯৩২ সালে রচিত।’৩ তাহলে দুজন আলোচকের আলোচনা থেকে আমরা ধরে নিলাম কবিতাগুলি ১৯৩২ সালে রচিত হয়েছে । কবিতাটি উল্লেখ করা হলো :
‘এই জল ভালো লাগে’
এই জল ভালো লাগে;---বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ---বুলায়ে দিয়েছে চুল--চোখের উপরে
তার শান্ত সিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে--আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চ’লে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে;—নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে--বনের ভিতরে
বারবার উড়ে যায়,--তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের ’পরে আমার চোখের ’পরে ধানের আবেশে
ঝ’রে পড়ে;--যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ,
যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়,
বনের কিনারে ঝরে যেই ধান বুকে ক’রে শান্ত শালিক্ষুদ.
তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের ’পরে-চোখের পাতায়
আমার চুলের ’পরে;---অপরাহেৃ রাঙা রোদ সবুজ আতায়
রেখেছে নরম হাত যেন তার-ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।’ ৪
আলোচনার সর্বোপরি বলা যেতে পারে, কবি জীবনানন্দ দাশ একজন প্রেমিক এবং প্রকৃতি প্রেমিক। ‘জল ভালো লাগে’ কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন বর্ষার জলের প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসার কথা। তিনি হয়তো সেই ভালোবাসার কথা সরাসরি বলেননি তবে ভিন্ন এক ধারায় তিনি বলে গেছেন।
তথ্যঋণ
:১. ক্লিটন বি সিলি, অনন্য জীবনানন্দ, প্রকাশক, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল, প্রথম প্রকাশ জুলাই ২০১১, পৃ. ১০৮
২.ঐ, পৃ. ১০৭৩. জীবনানন্দ দাশ, রূপসী বআংলা, প্রকাশক, শিক্ষা প্রচার, ঢাকা, প্রকাশকাল, জুলাই ২০১৮, পৃ.২৮-২৯
৪. ঐ, পৃ. ৯৬