বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের  'নিষিদ্ধ পণ্য' কবিতাটি নিয়ে কিছু লেখার সাহস  করলাম।  কবিতাটি পাঠক প্রাণ স্পর্শ  করেছে।একজন কবির একটি কবিতা আলোচনার
প্রচল বাংলাভাষায় কম।তবে জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে অনেক
আলোচনা হয়েছে- বোধ,গোধূলি সন্ধ্যার নৃত্য।
পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি অলোকরন্ঞ্জন দাশগুপ্ত ডব্লিউ ইয়েটসের দ্য ক্যাসল এবং টি এস এলিয়টের বার্নট নর্টন এই দুটি কবিতার অনুবাদ ও অনুষঙ্গ- প্রসঙ্গ লিখেছেন।এমন কি এও জানা যায়
মৃত্যুর দুএকদিন আগে সুধীন্দ্রনাথ
দত্তের বাড়িতে এলিয়টের বিখ্যাত কবিতার লাইন নিয়ে দীর্ঘ আড্ডা হয়েছিলো: Only through time - time is conquered.
এলিয়টের FourQuartets পড়লে
কেন  আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হই,কেন বিশ্ব
সাহিত্যে তার এতো কদর। প্রধান কারণ হয়তো পাঠকের প্রাণস্পর্শী ক্ষমতা।
কাব্যালোচনার ক্ষেত্রে দার্শনিক হেরাক্লিটাসের কথাটি খাটে, উপরে
ওঠার এবং নিচে নামার সিঁড়ি কিন্তু
একটাই।রেজাউদ্দিন স্টালিনের নিষিদ্ধ পণ্য কবিতাটি পাঠকের
জন্য প্রথমেই কবিতাটি তুলে ধরা হলো :

বাংলাদেশে বরফ নেই
আগুন নাকি আছে,
কিনতে গেলাম সন্ধাবেলা
দোকানিদের কাছে।

শপিংমলে পণ্য অনেক
আগুন কোথায় পাই,
র‍্যাকগুলো খুব চমকে ওঠে
না না ওসব নাই।

আগুন সে তো অদৃশ্য নীল
বিক্রি কেন হবে
আতশবাজি কিনতে পারেন
বিবাহ উৎসবে।

ভুল শুনেছেন বরফ আছে
মৃত মাছের চোখে,
বলল তরুণ ফিসফিসিয়ে
চুমুক দিয়ে কোকে।

এক দোকানি ভীষণ চালাক--
আপনি কি ভাই কানা,
আগুন আছে বুকের মধ্যে
বিক্রি করতে মানা।

  

  রেজাউদ্দিন স্টালিনের এই কবিতাটি শারিরীক গঠনে খুব সরল মনে হলেও এই কবিতায় শব্দের জালে রয়েছে এক শাশ্বত রহস্য যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য  শব্দের মুখে লাগানো হয়। এই কবিতাতেও ঠিক অদৃশ্যভাবে সেই লাগাম রয়েছে।
সর্বসাধারণের ভাবনায় সময়ের একটি কবিতা যা পাঠক মনে অবশ্যই অনেক সমাদৃত।
ভেতর ও বাইরের রূপ এবং পার্শ্বরূপ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই সাথে একই চিত্রকল্প সন্নিবেশিত করেছেন কবি এই কবিতায়।
আমি আমার মতো করে কবিতাটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া উন্মোচনের প্রয়াস করছি মাত্র।

কবিতার শিরোনাম আর কবিতার বইয়ের নামের মধ্যে বিস্তর একটা ফারাক রয়েছে। গ্রন্থের নাম 'বরফের বই'। কবি কিন্ত বিখ্যাত হওয়া সত্তেও  গ্রন্হের নামকরণ করেননি   'নিষিদ্ধ পণ্য'। ফারাক বললাম এ জন্য কবিতায় জ্বলছে আগুন আর বইটি বরফের বই। আমি বিস্মিত হয়েছি বরফের বইয়ের পাতায় দৃশ্য অদৃশ্য আগুন রয়েছে সুন্দর, সাবলীল শব্দবিন্যাস ও রূপকের মধ্যে। আমি নির্দিষ্ট আলোচনা থেকে একটু বোধ হয় সরে যাচ্ছি তবে সরে যাওয়াটা আলোচ্য বিষয় থেকে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়। আমি বরং আমার আলোচ্য বিষয় 'নিষিদ্ধ পণ্যেই 'ফিরে আসি।

'নিষিদ্ধ পণ্য ' শিরোনামটি রহস্যে ঘেরা। পাঠক মন অবশ্যই ব্যকুল শিরোনাম দেখেই কবিতাটি পাঠের জন্য। এখানে 'নিষিদ্ধ পণ্য' কাকে বলেছেন কবি? কোন পণ্যটি নিষিদ্ধ?  প্রথমে এই প্রশ্নগুলো আরও বিভিন্ন প্রশ্ন সৃষ্টি করে পাঠক হৃদয়ে তোলপাড়।
শুরু হয়  শিরোনামটি নিয়ে কৌতুহল
শিরোনামটিই টেনে নিয়ে যায় কবিতার দিকে কবিতার শরীর খুলে দেখার জন্য।
কবিতাটি প্রচলিত ছন্দের স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন কবি। কবিতাটি  অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। কবিতার শুরুতে কবি দুটি শব্দে দুটি বিষয়ের ওপর বিবৃতি দিয়েছেন একটি সংকট আর একটি সুলভ। যেমন-'নেই' শব্দে সংকট আর 'আছে' শব্দে সুলভ।

বাংলাদেশে বরফ নেই
  আগুন নাকি আছে,
খুব সরল দুটি পঙক্তিতে বাস্তবতার চরম কষাঘাত।

শপিংমলে পণ্য অনেক
আগুন কোথায় পাই,
র‍্যাকগুলো খুব চমকে ওঠে
না না ওসব নাই।

এখানে কবি উপরের পঙক্তিতে শ্লেষমিশ্রিত শব্দের ব্যবহার করেছেন। কারণ কবি জানেন  আগুন কিনতে
পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমজনতা আগুন কিনছে দোকানে বা শপিংমলে যা অদৃশ্য।  এটা বাজার
নিয়ন্ত্রণকারীরা জানেন তাই চমকে ওঠেছিলেন র‍্যাকগুলো অর্থাৎ দোকানদার।

আগুন সে তো অদৃশ্য নীল
বিক্রি কেন হবে
আতশবাজি কিনতে পারেন
বিবাহ উৎসবে।

পরক্ষণেই আবার এই পঙক্তিতে বলছেন আগুন অদৃশ্য নীল বিক্রি কেন হবে অর্থাৎ দুঃখ, কষ্ট, বেদনা বিক্রি হয়
না, বিক্রি হয় সুখ তাই আতশবাজি কেনার কথা বলেছেন। এই অংশটুকু গভীরভাবে হৃদয়ে রেখাপাত করে। এটি মানবজীবনের একটি বাস্তব উদাহরণ।

ভুল শুনেছেন বরফ আছে
মৃত মাছের চোখে,
বলল তরুণ ফিসফিসিয়ে
চুমুক দিয়ে কোকে।

কবি এখানে মুলতঃ বাকস্বাধীনতার কথা বলতে চেয়েছেন। 'বরফ আছে মৃত মাছের চোখে' এই মৃত মাছ কি কবি শুধু মাছকেই বুঝেয়েছেন না-কি আরও অন্যকিছু! রোদে পুড়ে, ঘাম শুকিয়ে কৃষক -লেবার এক টুকরো বরফ তারা পায় না আত্মা ঠাণ্ডা করার জন্য। আবার তারাই তাদের উৎপাদনকৃত পণ্য জলের দামে বিক্রি করে ডাল-ভাত খাচ্ছে কিনে আগুন দামে।
কিন্তু বরফ মৃত মাছের চোখে যা মাসের পর মাস গুদামজাত করে রাখে। এটা একদিকে যেমন চড়া দামে বিক্রির ব্যবস্থা অন্যদিকে অসতেজ পণ্য জনগণের হাতে
তুলে দেওয়া। ' বলল তরুণ ফিসফিসিয়ে চুমুক দিয়ে কোকে'  এখানে তরুণ  সামান্য সাহস যুগিয়ে চুপিসারে বলেছে, আওয়াজ তুলে এই অন্যায়ের বিরোধিতা করতে পারেনি। বাস্তবতার হাত ধরে কবিতাটি যেন দাঁড়িয়ে আছে।

এক দোকানি ভীষণ চালাক--
আপনি কি ভাই কানা,
আগুন আছে বুকের মধ্যে
বিক্রি করতে মানা

এখানেও দেখা যাচ্ছে আক্ষেপে শ্লেষাত্মক বাক্যের ব্যবহার করেছেন কবি দোকানির চরিত্রে। কবিতার প্রতিটি শব্দ সিন্ডিকেটের গালে যেন ব্যঙ্গাত্মকভাবে কষে চাবুক মেরেছেন।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন সবসময় অন্যায় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্হার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন তাঁর কলমে।কখনো ভয়ে থমকে থাকেনি আর সেইজন্যই তিনি অগ্রগণ্য কবি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি।
পৃৃথিবীর সেইসব মহৎ কবিদের উত্তরসূরী রেজাউদ্দিন স্টালিন,যারা মানুষের জন্য কবিতা লিখেছন।
সবশেষে কবির সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবংবৈশ্বিক সফলতা কামনা করছি।