বহুদিন পরে  বাবুদের ঘরে  গেনু কাজ ফিরে পেতে ;
কহিলাম,“আজ  দাও কিছু কাজ--তবেই পাবোগো খেতে ।”
চা-চুমুক শেষে  বাবু কন হেসে,“লেগেছে মড়ক দেশে ;
কত শত মরে  এর তার ঘরে ! দাঁড়াসনে পাশ ঘেঁষে ।
হল বড় জ্বালা  লেগে গেল তালা  দরজাতে আদেশে ;
সরকার বলে, সব ঠিক হলে  খুলে দেব ফির এসে ।
চালু কারখানা  লাভ হত টানা,  ছিলতো সবই ঠিক ;
বন্ধ হল চাকা  বিক্রিবাটা ফাঁকা  আঁধার সকল দিক ।
যদি খুলে,তবে  বিক্রিবাটা হবে, হলেই লাগাবো কাজে ।
এখানে আসার  কেন দরকার ?” বাবু কহিলেন ঝাঁঝে ।
বলি, “সবে ঘরে  অনাহারে মরে, ধারে দ্যান্ কিছু টাকা--
চাল কিনে যাবো, তবে খেতে পাবো  নয়তো পেট খাঁ খাঁ ।
না পাইয়া দুধ,  ছোটটিকে খুদ  মাতা দেয় হাহাকারে;
চোখে আসে জল,  নাহি দেখি থল  এই অকূল পাথারে ।
বড়টি যে ভোগে  কি জানি কি রোগে  প্রতিদিন আসে জ্বর;
কানাকড়ি নাই  পথ্য কোথা পাই--  কাঁপে খালি থর থর ।
ঘোলা চোখে চায়  কাঁদে যে খিদায়,  দেখে বুক ফাটে সেথা;
নাহি কিছু আর  মোর করিবার  তাই ছুটে এনু হেথা ।
বধূ কাঁদি’ কয়  পাবে কিছু নিশ্চয়  বাবুরেই কও গিয়ে;
টাকা কিছু পেলে  চাল কিনে এলে ফোটাবো তাহাই দিয়ে ।”
বাবু শুনে কন, “নারায়ণ নারায়ণ  ওরে,এত কষ্ট তোর !
তবে কেন তুই  ত্যজিলি না ভুঁই,  দায় কি শুধুই মোর ?
যা রে তোরা চলে  এই দিনু বলে  যেথা তোর কাজ আছে;
ঘটি বাটি বেচে  যারা চলে গেছে  ঠিক তারা প্রাণে বাঁচে ।
চলে যা সবাই  আর পথ নাই  কথা মোর খুব খাঁটি ।”
চমকালো পিলে  কি কথা কহিলে ! কাঁপিয়া উঠিল গা-টি ।
আছে কি বা মোর  শুধু বড় জোর  ফুটপাতে কুঁড়েঘর;
আমি পরিযায়ী  স্বল্প উপায়ী,  হায়, ভরে না উদর ।
খান দুই শাড়ি  অতি বাড়াবাড়ি  গৃহিণীর সম্বল ;
ঠিকে কাজ করে  দুই খানি ঘরে,  নই তবু স্বচ্ছল ।
বুড়া বাপ ঘরে  একে তাকে ধরে  খেতে পায় কিছু ;
জমি জমা নাই  ছোটে এক ভাই  গাঁজা ভাঙ পিছু ।
কি করিব আমি  ভেবে শুধু ঘামি  পাঠাতে পারিনে টাকা--
এ স্বাধীন দেশে  এই হল শেষে  ভাগ্য রহিল ফাঁকা ।
ঘর নেহি গিয়া ?  কুছ নেহি খায়া ! শুধিয়ে কোমল স্বরে
দিল রোটি-সবজি;  ডুবিয়ে যেন কব্জি  খেনু কতদিন পরে !
একদিন শুধু   তারপর ধূ ধূ,  আর কেহ তো এলো না ।
ভগবানে ডাকি--স্বর্গধামে থাকি’ বিপদে আর ফেলোনা ।
দিন দুই পরে  তালা দিয়ে ঘরে  চলিনু দেশের গাঁয়ে ।
আপনারে বলি--যাচ্ছো তো চলি, সেথা খাবে কি উপায়ে ?
গাড়ি ঘোড়া বন্ধ  হাঁটি যেন অন্ধ  কারো পায়ে নাই বল;
বধূ পুঁটুলি কাঁধে, বাচ্চারা কাঁদে  চল্, থামিস্ নে, চল্ ।

চোখে নাই দিশা  বুকে ক্ষুধা তৃষা,  জানিনে কোথায় যাই ।
দীনহীন হয়ে   এই পরিচয়ে  জন্মের মানে নাই ।
কিসের দরকার  এমন সরকার-- নাগরিক খুঁজে মরে;
ভোট শুধু এলে  তুমি ভালো ছেলে,  চেনেনা আর পরে ।
দল বেঁধে চলি  বাংলায় কথা বলি,  বাংলা আমার কোথায় !
রেল লাইন ধরে  ছেলে কোলে করে  চলি ফোস্কাপড়া পা-য় ।
কেহ দেয় খেতে  কেহ যায় তেতে  কভু যদি ভিখ মাগি ।
গুনি শুধু দিন  শ্রমিক পরাধীন,  গৃহিণী মোর অভাগী ।
শূণ্যে ওড়ে চিল,  ভরা সূর্য্যের কিল  মাথাটি দেয় ফাটায়ে ।
কে কার ভার নেবে  এই ভেবে ভেবে  দি’ রাতদিন কাটায়ে ।
রেলপথ কমে না  নেয়ও যমে না;  কেঁদে ভাগ্যকে দুষি ।
ভাগ্য করে খেলা  শুধু হেলাফেলা  মোরে লয়ে যত খুশি ।
কে যেন কহিল,  অপেক্ষা রহিল  মাত্র এক দিন আর;
বলে ঘুরে ঘুরে  আর নাই দুরে  দেখা পাবেগো বাংলার ।
শ্রান্ত দেহে রাতে  সবে একসাথে  ঘুমোলাম লাইনেই;
প্রকৃতির ডাকে  গেনু কিছু ফাঁকে  পাঁচহাত তফাতেই ।
এল বেগবান,  হায় ভগবান  পলকের নিমেষেই--
আঁধারে পাষণ্ড করিল লণ্ডভণ্ড,  সব শেষ। কেহ নেই !
হল অবসান  অতি তুচ্ছ প্রাণ  পরিযায়ী শ্রমিকের !
এমনি চুপিসাড়ে  সংখ্যা দ্রুত বাড়ে এই মৃত্যুমিছিলের ।
ছেঁড়া পোড়া রুটি  গিয়েছিল জুটি’, দাগ তায় রক্তের ।
এ কি পরিহাস !  হবেনা ইতিহাস   লেখা,ওই জীবনের ।
১২।০৫।২০২০