স্নেহের নীলেশ…
আশা করি ভালো আছিস। অনেক দিন ধরে তোর কথাটা পড়ছে মনে,-তোর ও কি আমার মুখটা পড়ছে,মনে, পড়ছে।
একটা চিঠি লিখবো লিখবো করে হচ্ছে না লেখা , হতে পারে তুই ও হয়তো ভাবছিস আমার কথা।
দীর্ঘ ২৫ বছর সেই যে গেলি, একবার না হয় ভুলে ও আমার বাসায়, এলি।
আজকাল তোর মুখটা খুব মনে পরে , সেই কোঁকড়ানো চুল , দাঁত ফোকলা হাসি ,আর সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশব।
কি যেন একটা তাঁরের অফিস এ কাজ করিস তুই, প্রাশ্চাত্বে এরই বুঝি কয় "ইন্টারনেট।
আমি ওত বুঝি না বাপু, শুধু এই টুকুই বুঝি - যে তাঁরের বাঁধনে নিজেকে বেঁধেছিস , তা করা যায় না এড়ানো ,কারণ তা বড়োই কঠিন যে ছাড়ানো।
ও তোকে তো বলা হয়নি , কিছুদিন হলো তোর মাসিমা চলে গেলেন, পরলোকের রেলগাড়ি ধরে ইচ্ছামতো ইহলোক ত্যাগ করলেন।
তোর হয়তো বাড়ির সামনে সেই কুল গাছ তার কথা মনে পরে- শৈশব থেকে কৈশোরে প্রায়ই অলস দুপুরে কুল পারতাম, একবার তো কি বোকাটাই খেলাম, কান মোলা ও খেলাম,
স্বরস্বতী পুজোর আগে কুল খেয়েছি বলে। মনে পরে।
এখন জীবনের প্রায় মধ্য গগন অতিক্রান্ত, সেই কুলপাড়া ও নেই,কানমলাও নেই,বকাঝকাও নেই,
সেই দুস্টুমি ভরা শৈশব আমাকে আর কেউ ফিরে দেবে না।
দুঃখ-সুখে, আনন্দে-নিরানন্দে, চলে যাচ্ছিলো।
কিন্তু আবার বাঁধ সাধলো , তাঁর ছিড়লো---
অনেকদিন ধরেই বেনু , আমার স্ত্রী বেণুবালা অসুস্থ , এই মফঃস্বলে অনেক বৈদ্যই দেখলুম কিন্তু কেউ সাথিলক রোজ নিধারণ করতে পাচ্ছিলো না। ভাবছিলুম , এই বৈশাখে কলকাতা যাবো , একটু চেঞ্জ ও হবে , কলকাতা ডাক্তারবাবুকে দেখানো ও যাবে।
এখন আছি বলতে আমি,,বেনু, আর বেনুর সাজান বাগান - এই আমাদের সংসার।
সেদিন সবে বসন্তের শুরু, পূর্ণিমার সন্ধ্যে, আজ যেন চেনা বাতাসটা আপন চেনা ছন্দ হারিয়ে একটু জেরে ছুটছিল, হয়তো বা ওদের জন্যে কেউ প্রতীক্ষা করে আছে।
আমি বসে উঠোনে পূর্ণিমার সন্ধ্যে বাগানটাকে ভারী অদ্ভুত লাগছিল, যেন তারা স্বপ্নের মায়াজাল বুনছিল।
ঘরের ভিতরে অসুস্থ বেনু শুয়ে ছিল খাটে।
বসন্তের শুরুতে তেমন একটা কালবৈশাখী ঝড় দেখা যায় না বটে - কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যায়ের ঈশানকোনে কালো মেঘের ভ্রূকুটি দেখা গেলো,
মুহূর্তে একঝাঁক কালো মেঘ পূর্ণিমার চাঁদ তাকে আস্ত গিলে খেলো - বাতাস আপন চেনা ছন্দ হারিয়ে দ্রুত বেগে বইতে লাগলো - হটাৎ একটা দমকা হাওয়া বাসার লম্ফ নিবিয়ে দিলো -আচমকা একরাশ কোলো নিকষ অন্ধকার দানবীয় উল্লাসে বাসার প্রতিটি কোন দখল করে নিল।
চারিদিকে একটা শ্মশানএর নিস্তব্ধতা, তার মাঝে একটা চাঁপা মৃদু আওয়াজ-----এ আওয়াজ আনার খুব পরিচিত , এ তো বেনু - বেনুর দীর্ঘনিশ্বাস -দৌড়ে ছুটতে যাবার আগে ঘরে নিস্তব্ধতা ভেঙে একরাশ ঘন অন্ধকার চিৎকার করে জানিয়ে দিলো ----বেনু নেই -- বেণুবালা আর নেই।।
একরাশ ঠান্ডা হাওয়া আমায় স্পর্শ করে করে আমার নিঃসঙ্গতা সুযোগে যেন সন্ধি করে গেল।
আর মফঃস্বল থেকে কাজ থেকে ফিরে বেনুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের নিচে কালো তিল বরাবর চুমু খেয়ে বলা হবে না -আমি ফিরে এসেছি তোমার ভালোবাসার প্রেমিক -তোমার ভালোবাসার প্রেমিক ।
আজ ও বসন্ত, পূর্নিমা, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, বেনুর নিজের হাতে পোতা মাধবীলতার চারা শৈশবহ থেকে যৌবনে পা রেখেছে , এই গাছটি ছিল বেনুর খুব প্রিয়,
আজ হয়তো এই বাগান, এই গাছ অস্থিরতার সুবাদে তার অভিভাভবেকের অনুপস্থিতে হয়তো বা আমার মতো নিঃসঙ্গতায়…..মাধবীলতার বিকশিত ফুলগুলি তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে , মাধবীলতার ডালপাতাগুলো বাতাসের স্পর্শে প্রাণভরা সৌন্ধর্যে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
যেন বেনুই তার আপন অঙ্গ সঞ্চালনায় তার অস্তিস্ব জানান দিচ্ছে , গাছের পাতাগুলি যেন বেনুর কেশসজ্জা - আমি কাছে গেলে এখনোও বেনুর শরীরের গন্ধ পাই।
সেই গন্ধ আমাকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রাখে ভালোবাসায়, স্মৃতিতে।
যাই হোক , আমি তো আমার কথা বলেই গেলুম, তোর কথা তো কিছু জানা - কিছু হোক না হোক তোর তো সাথে সেই ২৫ বছর ধরে তো যোগাযোগ, তুই বলবি " ইডিয়ট " করিস নি কেন যোগাযোগ , আমি বলি, এখন আর যোগ কোথায়, সব বিয়োগ।
যদি সময় পাস একবার আয় না রে , কতদিন, কতকথা হয় নি, দেখি-ও নি।
কথা দিলাম তুই যদি তোর অফিস এর তাঁরের কঠিন বাঁধন কাটিয়ে আস্তে না পারিস-- আমি না হয় একদিন জীবনের তাঁরের মায়াজাল কাটিয়ে আসবো।
চিঠিটা অনেকটা দীর্ঘ হয়ে গেলো রে - একে চিঠি না বলেও ছোট্ট উপখ্যান বললেও চলে।
শেষ করলাম "জীবনানানন্দের" দুই লাইনে লিখে -
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির  তীরে -- এই বাংলায়।।“
ইতি - পুলু
-পুলক কুমার রায় --
সরিষা, সাউথ ২৪ পারগনা।।।।