খবরটি আমার এখনো মনে পড়ে। সন্ধ্যা ঝেঁকে বসেছে তবে এখনো আঁধার ঘনিয়ে আসেনি। আকাশে মেঘেরা গোধূলি বেলার সোনা ঝরা রঙ ভাগাভাগি করে নেবার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। খবরে বলা হলো কলন কেন্সার চিকিৎসার জন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকা যাচ্ছেন।
তখন কেন জানি আমার মনে হলো এটা কোনো বড় খবর না। কিছু হবেনা। তিনি বাঁচবেন। হুমায়ূন আহমেদের ঝুড়ি বর্তী কৃষ্ণচূড়া। তাঁর জীবনে রঙের বেশুমার। রঙের খেলা দেখানো যেন বাঙালীর কাজ।
আমাদের সবচেয়ে চমকপ্রদ অর্জন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের শিকড়, আমাদের মাটির নৈস্বর্গীয় রঙে রঞ্জিত। ঘটনাটি ঘটেছিল ভরা বসন্তের রংঘর ফাল্গুনে। এটাতো দিবালোকের মতো সত্য ইতিহাস। এভাবে কপালে সোনার রঙ নিয়েই উদয় হল আমাদের মহাকা্ব্যীয় মাতৃভাষা দিবস।
আমাদের লাল শালুকের গুঞ্জন কি একা করা যায়? তা শুনতে পারি উপমহাদেশের তিন তিনজন নোবেল বিজয়ী বাঙালির কাছ হতে। আমাদের সোনালী পুথি পাঠ করে শেষ করার নয়।
তবে হুমায়ূন আহমেদ নিজের জাদুগিরি পুথি সারা দেশবাসীকে পড়ে শোনালেন। তৃপ্ত চিত্তে নবাব বাড়ির জর্দা খেয়ে খাওয়ালেন হালকা রসের সদর ঘাটের পানকিলি। তাঁর রুপালি পর্দায় বেসে উঠলো পানকৌড়ি আর সারসের কাকতালীয় এক অভিনব যোজন। পাতাহীন শূন্য পথে বকুল চাঁপার কলি অনুসন্ধান আর শুকনো পাতায় পাওয়া নূপুর। সাধারণের মাঝে অসাধারণের সন্ধান প্রয়াস হুমায়ূন নাট্য রচনাকে প্রসংশার দাবিদার বানিয়েছে। পেলেনও প্রচুর। সাবাসির ঠাসা তাকে ঘরবর্তী করলেন। সাথে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বেড়ে হলো তাল গাছ উঁচু।
এমন হুমায়ূন আহমেদকে অকালে কোনো আঁধার গোধুলিতলায় পা ফেলতে হবে এটা ভাবা যায়না। চিকিৎসার আশ্চর্য প্রদীপ তিনি কিনবেনই । তাঁর রচিত বিশাল বট বৃক্ষের শাখায়, শাখায় অনেক আজগুবি ভূত কাহিনী তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু এবার দেশবাসীকে দিবেন সবচেয়ে বড় উপহার। টাকার গরম ঘষায় আলাদিনের চেরাগ হতে বেরিয়ে আসা এক বাস্তব নিরাময়-দৈত্য গল্প। এমনটাই ভেবে ছিলাম।
কিন্তু হলো কি? যা হবার তাই হলো। যেমন ইংরেজিতে একটি কথা আছে que sera, sera অর্থাৎ যা হবার তাই হবে। পৃথিবীর তাবত শক্তির উপরে এক মহা শক্তির যখন যে ইচ্ছা হয় তখন que sera, sera তাই হয়। চিকিৎসকরা ছিলেন বিশ্বসেরা কিন্তু সম্ভব হলোনা। তাঁরা কোনো রঙের বাড়ই খেলা দেখাতে পারলেন না। সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেলেন আমাদের হুমায়ূন আহমেদে।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় শৈশবে তিনি বেড়ে উঠেন অন্যোন্য শহর সহ সিলেটে। বাংলাদেশের রূপ কাহিনীর বাট, এই সিলেটের আছর তাঁর উপর ভালোভাবেই পড়েছে মনে হয়। এখানে দেখা চান্নি রাতের নৈস্বর্গীয় রূপ তাঁকে সারা জীবন মোহিত করে রেখেছে। ছোট্ট বেলার এই প্রাপ্তি যেন ছিল শরৎ-প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলিফুলে। তাই দুহাত ভরে তোলে আমরণ বুকে আঁকড়ে রেখেছিলেন । এমনকি তিনি মরতেও চেয়েছেন এমনি এক চান্নি পসর রাতে।
ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।
আমরা শুনেছি তাঁর এই বিখ্যাত গান। শুনেছেন দেশবাসী। কিন্তু আজীবন একটা জোছনা ফুল ধরার প্রত্যাশী হুমায়ূন আহমেদের জ্বলন্ত পিদিম সহসাই নিভে গেল। হিমু সরসীর নাবিকের অন্তিম পানসি ভিড়লনা কোনো সাঁঝের বেলা জোছনা জ্বালা ঘাটে। পূর্ণিমার আকাশের তারার পারের আধো চাঁদের বাঁকা উঁকিতে মেতে উঠা কোনো ধানসিঁড়ি নদীর তটে।
চন্দ্র কারিগরের চন্দ্র খেলা চলতেই রইল। খেলা চলবে। কেননা আল্লাহ পাকের লীলা বড়ই অসীম। তাইতো জীবন বড় বিচিত্রময়। চিত্রকরের কাছে চিত্র কি ছাই। স্রষ্টা সৃজন করলেই রঙের বাড়ই হন রঙ্গিলা। দিব্য ইচ্ছাটাই মুখ্য তাই আমরা বলি ইনশাহ আল্লাহ।
আল্লাহর সৃষ্ট আকাশ অনেক উঁচু। ঐ চান্নি পসর রাতের চাঁদের দেশে যাওয়ার পথও নিশ্চয় আছে। কিছু হেটে অতঃপর না হয় কিছু হুমায়ূন আহমেদের ধবল পঙ্খী নায়ে। তবে বাকিটুকু যাবো কিভাবে? বলা যেতে পারে যে অবশিষ্টটুকু স্পেশক্রাফ্টে পাড়ি দিব। আসলেই কি তাই?
চন্দ্রলোকের যে মৃন্ময়ী নয়নাভিরাম নীলাক্ষেত্র যুগ যুগ ধরে মানব চেতনায় খেলা করে। কবির কলমে ধরেও ধরা যায়না বিজ্ঞানের বেলায়ও এমন একটি শূন্যতা দেখা যায়। সৌর বলয় plantery disc একটি perfect circle হতে পারেনা কারণ pi পাই।
বিজ্ঞানীদের কাছে একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বে প্রথম কোনটির আবির্ভাব হলো 'সারকুল না পাই'। পাইর দশমিক সংখ্যা অফুরন্ত কোনো সুপার কম্পিউটারে অঙ্ক খসেও এর শেষ সংখ্যা নির্ণয় করা যায়না। তাই সৌর জগতের ঐ অনন্ত শূন্য বাঁকে কোনো স্পেসক্রাফট উড়ানো যাবেনা কারণ মানব রচিত অঙ্কই ইহার চালিকা মন্ত্র।
সৃষ্টজীব ক্ষুদ্র এবং আমাদের এই সীমা পদে পদে পরিলক্ষিত হয়। একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহর মনোনীত পথেই স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করে অসীমের লক্ষ্যে পাড়ি দিতে পারা যায়। তাই বিজ্ঞান, সাহিত্য বা দর্শন যে পথেই চলুন সত্যের সন্ধানে ধর্ম যে অপরিহার্য।
রম্য উল্লাসে সাগর সৈকতে সুকুমার নৃত্য নেচে জোছনার ফুল ধরা যায়না। কৌণিক মিম্বরতলে নতজানু হয়ে চন্দ্রকলার অনঘ জ্যামিতি সন্ধান করতে হয়।