বাংলা কাব্যময় এ কথাটি রূপসী বাংলার প্রতি বলিলে কি বেশি বলা হবে? অন্তত আমরা প্রবাসীরা যারা দেশকে সেজে রাখি মনের মনিকোঠায় আমাদের কাছে স্বদেশ একটি সুন্দরতম কবিতা। বিলেত প্রবাসী অনেক বাঙালি এমনটি যে ভাবেন এতে আমার মনে সন্দেহ নেই।
এমন যখন ভাবছি হটাৎ আমার মনে প্রশ্ন হল যদি এই বিলেতের কাব্যঙ্গনের মহারথী শেক্সপীয়ার আসতেন শিমুল পলাশের সোনার বাংলায়। রঙের রানী ফাল্গুনী বাগানে শোনতেন ডালে ডালে কুহু কুহু গীতি আর নদী পারে ভাটিয়ালী গান। তিনি কী করতেন খেতেন কী সদর ঘাটের এক খিলি পান?
উত্তরটি টেমস নদী তীরে গ্লোব থিয়েটারে মিলেনা। এদিকে মনের হুদহুদ ছুঁটে যায় বাংলার হাওরে বাওরে নিরিবিলি দাঁড়ানো হিজল গাছের ডালে। আসেন আমার সাথে।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সুজন নাইয়ার ঘাটে ভাটিয়ালি নায়ে গহীনের গান বাঙালি মাত্র কেই মুগ্ধ করে। এই গানের প্রতি আকর্ষণবোধ আমাদের চিরন্তনী স্বভাব। তবে আমাদের জলে না নেমে পারে বসেই বুঝতে অসুবিধে হয়না যে ‘ভাবের মাহাত্ম্য’ এবং কথা ও সুরের লালিত্যই' এই মনমাতানো কলি গুলোর গুণের সীমা রেখা নয়। এর ব্যাপ্তি তার চেয়েও বেশী কিছু। এর মাঝে অনুরণিত করুন সুর আমাদের মন-মানসে সহজেই আবেদন করতে পারে।
ভাটিয়ালি গানে আমরা দুটো অনন্য জিনিস পাই। একটি হচ্ছে বিচ্ছেদ ব্যঞ্জনা যা আমাদের কেমন যেন চেনা জানা মনে হতে থাকে। অপরটি হল শাশ্বত বাংলার গভীরের এক অপার কুহক। আমরা তা একটু হলেও অনুভব করতে পারি। উভয়টির মধ্যেই বিয়োগান্ত ভাব প্রবল। বিয়োগান্ত সাহিত্য উৎকৃষ্টতম। এমনি বিয়োগান্ত নাটক রচনায় অমর হয়ে আছেন শেক্সপীয়ার। তবে এই বিশ্বকবির গীত বিতান বলা যেতে পারে চার দেয়ালে গড়া গ্লোব থিয়েটার। আর আবহমান বাংলায় সেটা উন্মুক্ত ওপেন এয়ার থিয়েটার।
বাংলার কবি ছুটে আসেন বাহিরে থিয়েটার মঞ্চ ছেড়ে। তাঁর ঘরের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে বাজে মেঘমেদুর আকাশের সিতারা। তিনি চলেন আগে শ্রাবণ ঝরে আসে তার পথে। শোনেন অদূরে স্তব্ধ চাঁপার বনে শুঁকনো পাতার নূপুর পায়ের শব্দ। তার আপ্লুত মন ডুবতে পারে শরতের এক ফোঁটা শিশিরে। তিনি শিউরে উঠেন দখিনা সমীরণে ভেসে আসা বেণু বাঁশির সুরে।
ফাল্গুনের টাটকা লাল গোলাপ কেড়ে নেয় তার নয়ন যোগল। হাতের নাগাদ মনমোহিনী বাহার বসন্তের রূপের ডালি ঘিরে বসে পাখিদের গানের মেলা। এমন রূপসী বাংলায় অকস্মাৎ কোথায় খুয়ে যান বাংলার বিদুষী শিল্পী? তাঁর সম্মুখে ছড়িয়ে ছিটে থাকে ফাল্গুনের পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরা বসন্ত। দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, বন-বনান্তে কাননে-কাননে, পাখিদের সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে নিমজ্জিত হয় মৃত্তিকার বুকে। এমন আনন্দ জাগানিয়া শিমুল গাছের তলে বনের কুসুমগুলি ঘিরা বাংলার কবি কোন খেয়ালে কোথায় যে উড়ান ঘুড়ি? বিরহী কুহূ কেকা গেয়ে উঠে দীপ সাখে।
ব্যাকুল করা কোকিলের মধুর কুহু কুহু ডাক, কেমন আকুল করে বিরহী অন্তর। তিনি সপে দেন ভরা বসন্তের ভ্রমর। ছাড়ি মেঘ মুলুক ছাড়ি সুদূর নীলিমা। ঝুরে তন, কেঁদে মন তিনি গেয়ে উঠেন 'ভ্রমর কইও গিয়া, প্রিয়তির বিচ্ছেদের অনলে আমার অঙ্গ যায় জ্বালিয়া'। এমনি না পাওয়া 'আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে/হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে, দেশ বিদেশে,/আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।' থেকেই তো 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানের উৎপত্তি।
এভাবে একটি বিয়োগান্ত গান থেকে আমাদের জাতীয় সংগীত গানের উৎপত্তি হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিক ভাবেই একটি বাস্তব ঘটনা। জীবনের বিচিত্র ও গভীরতম বাস্তবকে উপলব্ধি করে পাঠক সম্মুখে তুলে ধরার মধ্যে নিহত থাকে কাব্যের সার্থকতা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জীবনে মিলনের চেয়ে বিরহ টাই বেশি, এই সুরটা প্রবল এটাই বাস্তব। জীবন, ভালোবাসা, বিরহ এবং বাস্তবতা এগুলো যেন এক সূত্রে গাঁথা। জীবনের অন্তমূলে ভালোবাসার চেয়ে বড় রত্ন আর কি থাকতে পারে? ভালোবাসা আসলে কী এর সংজ্ঞা বর্ণনায় শব্দের পাহাড় পর্বত গড়েও শেষ করা যাবেনা।
আকাশ ছুঁয়ে নয় বিরহের মধ্যেই ভালোবাসা অনুভব করা যায় গভীর ভাবে। ভালবাসা খাঁটি হয় , শুদ্ধ হয় জ্বলে বিরহ অনলে।
মনের মানুষের সুলুক সন্ধানে শিল্পী নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অজানা দূরের পথে এক মুঠো সুখ খুঁজছেন। গেঁথেছেন বিরহীর জপের মালা। তা করুন শোনালেও মনে যে কেমন মধুর লাগে। তাই তা শোনে অকালে ঝরে পড়েনা কোন চাঁপা ফুলের কলি। মনে উদয় হয় বাঁধ ভাঙা ভাব। ঐ গান শোনে রবি ঠাকুরের এমন হয়েছিল। তিনি নিখিল বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটে থাকা সব বাহ্যিক রূপ একত্রে অনুভব করেছেন। শ্রাবণের সজল ছায়ায় নীলিমায় ভাসতে পানসি এঁকেছেন। পাল তুলতে দখিনা হাওয়ায় সুর তুলেছেন। রচনা করেছেন অমর আমার সোনার বাংলা কাব্য।
এ সবি নিশুতি রাতের শেষ তীরে প্রথম আলোয় ভেসে উঠা গোলাপের এক রঙ্গিন ঝলকের মতো। কিন্তু তখনও বাস্তব নিসর্গের অঙ্গনে ঊষার চকমকা সাজঘরে রাঙা গোলাপের ডালে বুলবুলি এক অনড় বিয়োগান্ত গায়ক। সে যেন গোলাপে রঙের মাঝে এক লাল রঙ্গই দেখছে সাত রঙা রংধনু নয়। সেটা যেন বিরাজ করে এই বর্ণময় ঊষার ওপারে। যেখান থেকে আলোর তরঙ্গে ভেসে এসে সূর্য তো প্রত্যহ সাজায় প্রথম আলো। কিন্তু কখনও নীড় বাঁধেনা এই সাজানো সাজঘরে। সর্বক্ষণই চলমান কোন এক মহা আলোকের পথে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অন্তরালের বাস্তব সন্ধানে এই বৃহত্তর পথে পাড়ি দেননি। অন্তত এই গানটি রচনা করতে যদিও এটার সূত্র ছিল বিয়োগান্ত। যেটা শেক্সপীয়ার করতে প্রয়াস পেয়েছেন তাঁর হামলেটে এবং তা অমর হয়ে আছে বিশ্বকাব্যে।
আমাদের বিচিত্র বাংলায় এমন বিরহী কুহূ কেকার তট যেন বড় নিবিড়। হয়তো তাই আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ও হাত মিলে নির্জন চাঁদের সাথে গেয়ে গেলেন গান 'শাওন–রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।' তখন কবির স্মরণে আসে কেহ। যারে যায়না ভুলা নিশীথ–স্বপন সম। বিজলী দীপ শিখা জ্বলে আঁধারে যমুনা–নদীপারে কে যেন ডাকে। বাহিরে বারি ঝরে, ঝরবে অবিরল। কেননা ভিতরে অশ্রুসিক্ত কার যে দুটি নয়ন।
এটা প্রায় হলফ করে বলে যায় এমন যদি কেহ বলেন, পথ চলি দৃঢ় পায়। এই সোনার বাংলায়। শেষ প্রান্তে পৌঁছে রূপ সাগরের তীরে মালা গাঁথা হয়ে গেছে আমার। এটা সঠিক হবেনা।
আমদের পদভার বহনকারী এই নিশ্চুপ পৃথিবী একটি নিখুঁত উদাহরণ। রাতের ঐ দূর আকাশ থেকে ধেয়ে আসা জ্যোৎস্নার থৈ থৈ এই ভূতলের মাটির তটেই জমে উঠে। তিমির আঁধারে নিমজ্জিত পৃথিবীকে খুঁজে নিতে সুদূরের চাঁদকে বেগ পেতে হয়না। এটা শুধু চাঁদের আলো আছে বলেই সম্বভ হয়না। বলা যেতে পারে ইচ্ছাটাই প্রবল। কেননা বাস্তবে চাঁদের তো কোনো আলো নেই। এটা আসে সূর্য থেকে। মুদ্দা কথা হল ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। সুদূর প্রবাস থেকেও দেশের সেই বর্ষায় হাওরের শান্ত জলে শান্তশিষ্ট দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছে অনুভবের হুদহুদ ঝুলিয়ে দেওয়া যায়।
চির চেনা বাংলাকে, স্বদেশকে আমরা আবারো নতুন করে শত চোখে দেখতে উপলব্ধি করতে আমরা প্রবাসীরা এমনটি করতে পারি। তখন আমরা বিলেতের বাঙ্গালীদের সঙ্গী যদি হোন খোদ শেক্সপীয়ার। বাংলাদেশে তাঁর চোখ মেলে দেখার যখন অনেক কিছুই আছে তখন যদি প্রশ্ন করা হয় শেক্সপীয়ার কী করতেন যদি তিনি শোনতেন ভাটিয়ালি গান? তিনি কি খেতেন সদর ঘাটের এক খিলি পান? আমার মনে হয় উত্তরটি সহজ। যেহেতু তিনি ছিলেন বৃহত্তর বাস্তব সন্ধানী তাই তিনি এক স্বাদরে রসাল পান খেয়েই ক্লান্ত হতেননা ডুব দিতেন বাংলার অতল রূপ সাগরে।