এই ক'দিন হল একজন সুহৃদের সাথে সাহিত্য আলোচনায় মগ্ন ছিলাম। তিনি ছিলেন একজন স্বনাম ধন্য অধ্যক্ষ, কবি, লেখক ও কর্মী। তিনির শহরে তাঁর নাম শোনেননি সাহিত্য ও শিক্ষা অঙ্গনে এমন লোক খুবই কম।
তাঁর নতুন কবিতার বই থেকে আমাকে অনেক কবিতা পড়ে শোনালেন। এগুলো ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং রসে পূর্ণ। মাঝে মধ্যে কিছু পাঠকের মন্তব্য পড়ে শোনালেন। যা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। আমিও একমত হতে পারলাম। অতঃপর উদ্যত হলাম তাঁকে একটি কাব্য গল্প শোনাতে। তবে ঘটনাটি বাস্তবেই ঘটেছিল ভারতে।
তখন মোগল আমল। একজন মহাজন হঠাৎ শুনতে পেলেন তার জানালার ফাঁকে ভেসে আসছে এক টুকরিওয়ালা হকারের হাঁক। সে বলেছিল কে কিনবে আমার হৃদয়ের এক টুকরা। তিনি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন। এবং লোকটিকে হাত ভর্তি রুপি দিয়ে তার এই কাব্য কলির কপিরাইট কিনে নিলেন। এই শর্তে যে পংক্তিটা আর সে কখনও তার বলে দাবি করতে পারবে না। সে শর্তে রাজি হয়ে চলে গেল।
পরের দিনই মহাজন তার রচিত নতুন পংক্তির সংবাদ ছড়ালেন। সেটা হল কে কিনবে আমার হৃদয়ের এক টুকরা। কাব্যটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলো। এমনকি খবরটি গিয়ে পৌঁছুল প্রাদেশিক আমিরের কানে। আমির তাকে তাঁর দরবারে গিয়ে দ্বিতীয় লাইন শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। বিষয়টা তিনি আঁচ করতে পেরেই এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
মহাজন মশাই এবার আদাজল খেয়ে মাঠে নামলেন সেই এক ক্ষুদ্র ক্রেতারা সন্ধানে। হন্যে হয়ে খুঁজলেন। তাকে যে পেতেই হয়! তা না হলে তার ছন্দ মিলবে কোথা থেকে। কি শোনাবেন আমিরের দরবারে। রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার এমন সোনালী সুযোগ কি আর মিলবে? কিন্তু হারালে রতন তা কি এতো সহজে মেলে? মহাজনের ভাগ্যেও তা আর জুটলো না।
তখন অধ্যক্ষ সাহেবের দিকে লক্ষ্য করে আমি সবিনয়ে বললাম, আমার যে একটি ছোট্ট অনুরোধ আপনাকে রাখতে হয়। তিনি সম্মতি জানালেন। আমি বললাম, আপনি যত সময় লাগে লাগান আর এই কাব্যের দ্বিতীয় পংক্তিটা রচনা করে আমাদেরকে উপহার দেন।
কিন্তু সেটা হলো না। তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সাড়া মিলেনি। আরেকটি অনুষ্ঠানে বহু নামি দামী কবি সাহিত্যিক জড়ো হয়েছিলেন। আমি বিষয়টি খুলে বললাম। পরের দিন একজন লেখক লিখে পাঠালেন:
কে কিনবে আমার হৃদয়ের এক টুকরা,
যদি নাও, পেয়ে যাবে ভালোবাসার কামরা।
এই দ্বিতীয় পংক্তিটা আমার মনপুত হলোনা। প্রত্যুত্তরে আমি তাঁকে লিখলাম: খুব ভালো প্রয়াস। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বিক্রেতা এবং ক্রয়কারী উভয়ই লাভবান হন। এখানে শুধু ক্রয়কারী লাভবান হচ্ছেন। সাদে তো আর কেউ হৃদয়ের টুকরার কিনা-বেচা করেনা। বিক্রেতা তার জীবন যাতনা থেকে কাব্যটা লিখেছেন। সে কি আশা করতে পারেনা তার আবেগের মূল্যায়ন হবে?
কে কিনবে আমার হৃদয়ের এক টুকরা অভিব্যক্তি হৃদয় পরশে বিপুল।
যদি নাও, পেয়ে যাবে ভালোবাসার কামরা নিছক এডভার্টাইজমেন্ট মনে হয়। একমাত্র হৃদই, হৃদয়ের প্রতিদান হতে পারে
তিনি জানালেন এটা শুধু লাইন মিলানোর জন্য লিখা চিন্তা করেন নি এত।
হ্যা এমন হয় যখন তখন আমরা দু' একটি লাইন লিখি। এতে ভাবনা সাগরে ডুব দিতে হয়না বা করিনা। গোলাপের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে দু' একটি কবিতা লেখা যায়। কিন্তু তত সহজে কি কাব্যের বুলবুলি ধরা যায়? চাইলেই কি কবি হওয়া যায়? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি বলে খ্যাত রুমি বলেন আলো দেওয়া সহজ না। প্রথমে নিজে জ্বলতে হয়। তেমনি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি'।
প্রশ্নটা থেকে গেল। কে কিনবে আমার হৃদয়ের এক টুকরা এর দ্বিতীয় পংক্তি কি হতে পারে?