এই ক'দিন হল আধুনিক বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ পাড়ি দিলেন অনন্ত দেশে। তাঁর সাথে আমার দেখা মাত্র দু'একবার হলেও আমাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠে অতি ঘনিষ্ঠ। পরিচিতি অল্প দিনের হলে আর কতটুকু নিকটতম হওয়া যায়। কিন্তু না তিনি দাওয়াত দিয়ে বসলেন তাঁর ঢাকার বাসায়।
সকাল শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু রুদ্রে এখনও মিটা ভাব। মধ্যাকাশে এখনো সূর্য ঝলসে উঠেনি। আমি একজন সঙ্গীকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম তাঁর বাসায়। সোনালী কাবিনের এই দেশবিখ্যাত যশস্বী লেখক ইতিমধ্যে আধুনিক বাংলার অন্যতম প্রধান কবি রূপে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্যবহারে একটুও গরিমা দেখলাম না। আমরা তাঁর মনখোলা সমাদরে অভিবুত হলাম।
অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একটি বেবিটেক্সি চড়ে আমরা তাঁর সাহিত্য আড্ডায় আসলাম। নোবেল বিজয়ী ইংরেজ কবি সিমাস হিনীকে নিয়ে তিনি আমার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। যদিও আমরা এ আলোচনায় পুরোপুরি একমত হতে পারিনি।
সিমাস হিনী ছিলেন অক্সফোর্ড ও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার অধ্যাপক। প্রত্যেক দেশের একটি আঞ্চলিক বোধ রয়েছে। এটা সে অঞ্চলের জন্য শোভনীয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা অর্থ বোধক না হতে পারে। যেমন ব্রাজিল দেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা আমাদেরকে আদৌ স্পর্শ না করতে পারে। কিন্তু এমন ও কবিতা রয়েছে যা যে ভাষাই লেখা হয়না কেন তা ভিন্ন দেশের লোকদের কেও আকৃষ্ট করে থাকে। এমন আন্তর্জাতিক মানের কবিতা, যেমন সিমাস হিনীর অনেক কাব্য কোনো এক দেশের জনপ্ৰিয় কবিতার সহিত তুলনা করা টিক নয়।
আমাদের খোশালাপ বেশ জমেছিল। তিনি আমাদের সাথে অনেক্ষন থাকলেন। তাঁর অতি মূল্যবান সঙ্গ দিলেন। এ জন্য তাঁকে বেশ ধন্যবাদ জানালেও কম হবে মনে করি। কিন্তু এই অল্পটুকু সাধুবাদও কি আর এখন পৌঁছানো যায়। তিনি যে একেবারেই চলে গেছেন এই ক্ষুদ্র ক্ষণ কালের জীবন ছেড়ে। কিন্তু যে পথ অবশেসে সবাইকে অতিক্রম করতে হবে। যেখানে সবার স্থান হয়। মৃত্যপুরীর এই বিশাল গন্তব্যেস্থলের শেষ কোথায়?
এর জবাব দিতে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ, কোনো মৃতযাত্রী, কোনো দিন ফিরে আসেনি। আসবেও না। সেখানে কারো বাস করার জায়গার কমতি হয়না। অতঃপরও প্রশ্ন হয়। মনে জানতে ইচ্ছে হয়। যদিও জানা যায়না। কবি, কবিতার বেলায় তো এ প্রত্যাশা আরো প্রবল হয়। কেননা জীবনের গভীরতম অনুভতি , চাওয়া পাওয়ার অভিব্যাক্তি ও ব্যাঞ্জনা নিয়ে হয় কাব্য পদ যাত্রা। সুতরাং কাব্যঙ্গনে এমন প্রশ্ন রাখা আদৌ অহেতুক নয়।
বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল তারকার কথা বারবার মনে হচ্ছিলো। ইচ্ছে হল হাতে কলম ধরি। আল মাহমুদের মতো একজন বড় কবির সাহিত্য আলোচনা হুট্ করে করা যায়না। তবুও ভাবলাম একটা কিছু লিখি। একটু শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
পৃথিবীর এক ব্যস্ততম নগর লন্ডন। এখানে নিজের কাজ নিজেকে করে নিতে হয়। বিলেতে বাংলাদেশী মিলিওনারদের সংখ্যা প্রচুর। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবুও এখানে নিজের একজন গাড়ি চালক থাকা আরব্য রজনীর গল্পের মতই। একটি জরুরী কাজে সেদিন হ্যাম্পস্টেডে গিয়েছিলাম। আমার গাড়িটি অনেকটা দূরে পার্ক করা ছিল।
ইতিমধ্যে মাগরিব হয়ে গেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমি হ্যাম্পস্টেড হিথের পাশ দিয়েই হেঁটে আসছি। হ্যাম্পস্টেড হিথ, বিলেতের এই অভিজাত এলাকাটি অত্যন্ত সুনামি। এখানকার বনানী, নগরের ভিতরেই সবুজ তৃণের বিশাল ছড়াছড়ি, মাঝে মধ্যে সাঁতার কাটার লম্বা পুকুর, ছিমছাম কুঞ্জ, একটি চিড়িয়াখানা ও একটি প্রজাপতি ঘর দর্শককে নয়নসূখে প্লাবিত করে।
তবে বিলেতে এখনও শীত মৌসুম। বসন্তসুধা ফাগুনের রঙে সেজে উঠেনি এখানের আকাশ বাতাস। যেটি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। হটাৎ আমার চোখ পড়ে আকাশের দিকে। আমি বিমুগ্দ্ধ হলাম। কি এক অভিনব মনোরম দৃশ্য আমার সামনে ভেসে উঠলো। আমি মাটি ভরে হাঁটছি। কিন্তু এ কি, আমার পা দুটো মাটিতে সচল থাকলেও আমার দু'টি চোঁখই আটকে থাকলো গগন পারে।
না আমি মুগ্ধ নয়নে দৃষ্টি হারাইনি কোনো চৈতি আকাশের মন মাতানো তারার মেলায়। এমনও নয় যে মেতে উঠেছে মন দেখি আঁধার নিশির বুকে আঁকা দ্বাদশী শশীর চিত্তকর্ষী জেরিন আলপনা। এ যেন আবহমান বাংলার রাতের মায়াবী কালো উত্তরীর ভিতর হতে উঁকি দিয়ে চাওয়া চিরায়ত মধুচিত্রের এক আলগা চিত্র প্রতীয়মান হল আমার চোখের সামনে। এক্ষণে বিলেতের সান্ধ্য আকাশে। তাই আমি চেয়ে আছি আঁখিভরে।
আমি দেখলাম এক গুচ্ছ হালকা মেঘের মাঝখানে এক আলতো সফেদ পূর্ণ চাঁদ। পুরোপুরি প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ঐ মেঘমালার উপর। তাতে মেঘের ভিতরের তুলতুলে নরম ধূসর পরত গুলোর অপরূপ মিহিন রূপ ভেসে উঠেছে। আবালবৃদ্ধবনিতা যে কারো দৃষ্টিগোচর হলে মনে হবে এ যেন মেঘের ওপর চাঁদের চক।
আমি ওদিক সেদিক সব দিকেই থাকলাম। কোথায়ও বাংলার হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া চোখে পড়ল না। তবে কি সত্যিই এই নৈসর্গিক দৃশ্যটা আমি বিলেতেই দেখছি। আমি হাঁটছি আর ভাবছি কেমন করে এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায়। কি হতে পারে মেঘের ওপরে চাঁদের চক আঁকার উপমা?
এখানকার তথা ইউরোপীয়ান শিল্পী দা ভিঞ্চি, পিকাসো বা ভ্যান গঘ লন্ডন হ্যাম্পস্টেড হিথের মাথার উপর এই অমাবস্যার চাঁদ দৃশ্যটা চিত্রায়ন করে জগৎ সভায় পৌঁছে দিতে পারতেন।
তবে আমি নিশ্চিত এর উপমা পেতে চোঁখ রাখতে হবে আবারো এই একই চাঁদের দিকে। একটুক্ষণের জন্য হলেও তখন যেন খুলে গিয়েছিলো দুর নীলিমার বন্ধ বাতায়নটি। তখনি অলৌকিক ওপারের এক চিলতে মসলিন রূপরেখা বুঝি প্রতিফলিত হয়েছিল ঐ চাঁদ জড়ানো অপূর্ব হালকা মেঘের মিহিন পরতে পরতে।
আমি বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভাবছিলাম। মাঝ পথে এই দৃশ্য দেখা। এমন বুজি হয়? এ পথে চলতে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙে আঁধার সায়র সৈকতে। বাংলার দূরে হলেও অনুভবে নেমে আসতে পারে কাশবন। যেখানে নেমে জোছনার ঢল। তৃপ্ত হয় পূর্ণ চিত্তে।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সমূহ যেমন জল, দখিন হাওয়া, চাঁদ ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে নিবিড় ভাবে জড়িত। আল মাহমুদ লিখলেন:
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
মায়ের সোনার নোলক খুঁজতে গিয়ে যে কবি সোনার বাংলাকে আরেকবার মাতিয়ে তুলিয়েছিলেন। তাঁর যাত্রার শেষ হোক কোন এক সোনালী ঠিকানায়।