//খোকার খোলা চিঠি //
(মায়ের কাছে চির কাংগাল খোকার খোলা চিঠি)
মাগো তোমায় বড্ড মনে পড়ে,
সকাল দশটায় চোখ মেলে যখন দেখি
যান্ত্রিক সভ্যতার কোলাহলে,
ছুটছে মানুষ কি যেন এক
নেশার ঘোরে।
অলস দুটি চোখে তাকিয়ে থাকি নিস্পলকে
যেন কাক ডাকা ভোরে, তুমি এসে পাশে
ডাকছো, "খোকা ওঠ বাবা, বেলা যে হয়ে গেলো
কখন যাবি মাঠে?
বাবা যে তোর গিয়েছে মাঠে
সেই কোন...... বিয়েনে!
খাবার পোঁটলা হাতে নিয়ে, উঠোন পেড়িয়ে দেখি,
দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমাদের ছোট্ট দিঘীর পাড়ে
শুন্য দৃস্টি প্রসারিত করে, দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতের পড়ে।
সীমানা পেড়িয়ে যাওয়ার আগে, পিছন ফিরে দেখি,
মা তুমি দাঁড়িয়েই আছো সংকা আর মমতার
সেই ডালী বুকে নিয়ে।
ক্ষেতে পৌছেই দেখি
বাবা তার হালের বলদ দুটি বেধে,
চেয়ে আছে আমার আসার পানে, ঘর্মাক্ত কলেবরে।
কাছে যেতেই, ঘার-গামছা দিয়ে,
ঘামে ভেজা মুখুখানি মুছে
বলতো "আজ বড় বেশী রোদ পরেছে বাছা"
খেতে বসে পাতে, নিত্য সেই একই ব্যঞ্জনে
কি যে মধু মাখানো আছে,
পান্তাভাত আর একটু লবন-মরিচের সাথে।
নিজের মুখে দেয়ার আগে, একটু হেসে
দীর্ঘশ্বাসটি চেপে রেখে,
হাতটি বাড়াতো আমার দিকে।
মাগো, বড্ড বেশী মনে পড়ে তোমাকে।
সকাল নয়টা বাজার সাথে
যখন নাইন ও ক্লোক ফুলগুলি ফোটে,
ন্যাংটো পুটু হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম
দীঘির জলের বাটে।
অনেকগুলো ন্যাংটো পুটু
ডুব সাঁতারের বাহাস খেলে
সময় যে যেতো কখন চলে,
হুস ফিরতো, যখন দেখতাম,
যাদুর লাঠি মা তোমার হাতে।
মনে মনে বলি, কখনও পেরেছো
ঐ লাঠি দিয়ে, তোমার দুষ্টু খোকাকে মারতে?
আধভেজা গায়ে, স্কুল ড্রেস পড়ে
খেতে বসতাম মাগো,
একহাতে তোমার আঁচলটি ধরে।
ধোঁয়া উড়ানো ভাতে, খাঁটি সরিষার তৈল তাতে,
কেমন করে যেন মেখে দিতে তুমি,
অমৃতও বুঝি হার মেনে যেতো
তোমার মমতায় মাখানো ভাতে।
কতদিন দেখেছি, শুন্য পাতিলে
নেই কিছু অবশিষ্ট,
নিজে না খেয়ে, খাইয়েছো খোকাকে
হয়েছো পরিতুষ্ট।
মনে পড়ে মা? মিষ্টি বিকেলের সোনা রোদে
সব কাজ শেষ করে, তোলা শাড়ী পড়ে
বেড়াতে যেতে যখন কাকীমাদের সাথে,
এবাড়ী-ওবাড়ীতে?
তোমার তোলা কাপড়ের মৌ মৌ গন্ধে
শাড়ীর আঁচল জড়ায়ে ধরে পিছু পিছু
হাঠতাম।
আমি জানতাম, তুমি খুশী হয়েছো,
তবু কপোট শাসনে বলতে,
এই খোকা, এখানে কি তোর?
যা এখান থেকে, যা মাঠে খেলতে।
জানো মা? আজও খুজে ফিরি
সেই অতি চেনা সুখের সুবাস,
শ্রাবন শেষে শরতের বৃষ্টিস্নাত
শুস্ক, সচ্ছ মাটির রন্ধে।
মা, মাগো, বড্ড মনে পড়ে আজ
তোমার মিষ্টি বারনগুলোর শব্দ।
বাবুদের ঊঁচু দালানের কার্নিশ ধরে
ঝুলতে দেখে, কতদিন বলেছো,
"খোকা ওখানে ঝুলিসনে,
পড়ে যাবি হাত ফসকে"।
তোমার খোকা আজ অনেক বড় হয়েছে মা,
একটিবার, যদি তুমি এসে দেখতে?
ইচ্ছে করলেই ছুঁতে পারি,
অমন অনেক উঁচু দালানের কার্নিশ।
না, মা, ভুল বুঝনা,
তোমার খোকা তোমারই আছে
তোমার আদেশ বুকে ধারন করে
তোমার স্নেহেরই আলো দিয়ে,
জ্বলছে অহর্নিশ।
তুমি জানো মা?
তোমার খোকা একটুও বদলায়নি,
শহস্র যান্ত্রিকতার কোলাহলে
লক্ষ আলোর রংগীন ঝলকে,
আর হাজার অট্টালিকার ভীরে
তোমার খোকা ঠিক তেমনি আছে,
যেমন ছিল তোমার মমতার বাঁধনে
ধুলো-বালি, নাটাই-ঘুড়ি আর'
গাছের ডালের বাঁকে বাঁকে।
হাজার তারার ভিরে, ঐ একটি তারা
মাগো, জ্বলছো তুমি খোকার প্রানে।
কেমন করে ভুলবো মাগো?
তুমি যেদিন চলে গেলে,
তোমার এই ছোট্ট খোকাকে
একা ফেলে।
দুচোখে জলের বন্যা ধরে
অনেক আদরে কাছে নিয়ে
বললে শুধু, বাবার দিকে খেয়াল রেখো,
কষ্ট যেন না পায় মনে।
মনে আছে মা? তোমার চোখের
বন্যা আমি, শুষে নিয়েছিলাম
আমার কচি দু'ঠোট দিয়ে?
মা, মাগো........আজও লেগে আছে
সেই দু'টি ঠোটে, তোমার চোখের
শেষ উষন পানির স্বাদ।
আর, ঐ যে তোমার সুখের
ছোট্ট সেই শালিক পাখীটা?
কি করেছিল, জানো মা?
নিজের মাথা নিজেই ঠুকে
পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছিল,
গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে।
কখন যেন দেখি,
তোমার পায়ের উপর বসে, তার
লাল টুকটুকে ঠোট দুটি দিয়ে, চুমু দিচ্ছে
তোমার নিথর পায়ের উপর,
ডুকরে উঠেছিল মাগো, পাড়ার সবাই
এ দৃশ্য দেখে।
না, মা, একটু কষ্টও দেইনি বাবাকে
অবাধ্যও হইনি কখনও,
আগলে রেখেছিলাম, অনেক.......
অনেক....ভালোবাসায়।
এলো রক্ত ঝরা ৭১।
স্তব্ধ করে দিতে চাইল, বাংগালী জাতীকে
পাকি হায়নারা, তার সাথে যোগ দিলো
দেশী কিছু পা চাটা কুকুরের দল।
নৃসংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো
সাধারন নিরাপরাধ মানুষের উপর,
সৃষ্টি করলো পৃথিবীর ঘৃন্যতম
নৃসংস মানুষ হত্যার ইতিহাস।
রক্তাক্ত করলো বাংলার পবিত্র মাটিকে,
বারুদের গন্ধ, আব্রুহারা নারীর নিভৃতে রোদন,
সন্তানহারা মায়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে
ভারী হয়ে গেলো বাংলার আকাশ বাতাস।
এক নিকষ কালো সন্ধায়.............
আজও বুক ফেঁটে যায় মাগো,
বাবাকে হারানোর ব্যাথায়।
বাবাকে ধরে নিয়ে গেলো,
কিছু দেশী ণেড়ী কুকুরের দল।
সেই যে গেলো বাবা,
ফিরে আসেনি আর
মাগো, কেমন করে লিখি তোমায়,
বুক যে আমার ফেঁটে যায়।
ক্ষমা কর মা তোমার খোকাকে
পারেনি রাখতে তোমার কথা।
তারপর, কি যে হল মা,
তোমার খোকার তরুন রক্তে
জ্বলে উঠলো, প্রতিশোধের আগুন।
তোমার আদরে ছোঁয়া নরম হাতে
গর্জে উঠলো মেশিনগান,
কুকুরের রক্ত আর বারুদের গন্ধ
একাকার হয়ে তৈরী হলো
স্বাধীনতার গান।
লক্ষ শহীদের রক্ত আর, মা-বোনের সম্ভ্রমের
বিনিময়ে পেলাম একটি গান, আর
লাল-সবুজের একট নিশান।
তুমি যদি দেখতে মা?
কেমন করে গেয়েছিল তোমার লক্ষ খোকা
সব হারিয়ে, সব পাওয়ার সেই মুক্তির গান।
লাশের গন্ধ, আর স্বজনহারা আহাজারিতে
মলিন হয়ে গেলো বিজয়ী বীরের বেশ।
তন্ন তন্ন করে খুজে ফিরলাম
লাশের পাহাড়, আর বদ্ধভুমির প্রতিটি কংকাল,
কোথাও খুজে পেলামনা বাবার
হারিয়ে যাওয়া স্নেহের রেশ।
শত নক্ষত্রের কক্ষপথ থেকে
ছুটে পড়া এক নি:সংগ নক্ষত্র আমি,
ছুটে চললাম মাগো তোমার আলোর
কক্ষপথে, যেখানে তুমি আর বাবা
মিশে আছো আকাশের সাথে।
আজ জীবন সায়েহ্নে দাঁড়িয়ে
বড্ড বেশী মনে পড়ছে মা তোমাকে,
তোমার টগবগে দুষ্টু খোকা
আজ ক্লান্ত, ধুসর।
এখানে বাতাসে ঝরা বকুলের
গন্ধ নেই, শিউলি দোলানো
ভালোবাসা নেই,
রক্ত জবার ডগায় রংগীন প্রজাপতির
গুঞ্জন নেই,
তোমার তোলা কাপড়ের মৌ মৌ গন্ধে
মমতার সুবাস নেই,
ভিজে মাটির সোদা গন্ধে
বিস্তৃত দিগন্তে ছুটে বেড়ানোর
মুক্ত আনন্দ নেই।
আছে শুধু, রংগীন কাগজে মোড়া
সুবাসহীন চকচকে ফুল,
মিথ্যে বলার চমৎকার অপকৌশল।
বাতাস ভারী হয়ে যায়
পারফিউম আর প্রসাধনীর
জৈবিক উগ্র গন্ধে।
তুমি নেবে মা আমাকে, তোমার এই ছোট্ট খোকাকে,
তোমার ঐ ছোট্ট ঘরে?
না হয়, মা-বেটা মিলে
জড়িয়ে থাকবো, অনন্তকাল
তোমার সাদা কাপড়ের
স্নেহের আঁচলে?
নেবে মা তুমি, নেবে তোমার এই
চির কাংগাল আদরের খোকাকে ?????????????????????