এহ্ কি বিচ্ছিরি গন্ধ,
দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
সে'কি আমি তো এই মাত্রই মারা গেলাম
দম বন্ধ হয়ে আসবে কি করে!
মরে গিয়েও ,
উদ্ভট সব ভাবনা মাথা থেকে গেলো না আমার।
কলমের দোয়াত উল্টোনো কালির মতো অন্ধকার একটা রুমে,
আমাকে শোয়ানো হয়েছে।
মর্গে!
স্ট্রেচারে শোয়ানো আমি।
মাথার ওপর একটা ফাটা বাল্ব ঝুলে আছে,
ভেতরে মাকড়শার জাল।
আশপাশে স্ট্রেচারে,ফ্লোরে ছড়ানো ছেটানো মৃতদেহ।
ব্যাটা ডোম সেই কখন আমাকে রেখে চলে গেলো,
আসার আর নামগন্ধ নেই।
এদিকে মর্গের কি গন্ধ,
আধগলা একটা লাশ, পচে গেছে বোধয়।
বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে কারা যেন মেরেছে ওকে।
কপালে কোপের দাগ।
হিংসা নাকি শোধ তোলা, কে জানে!
আমি উঠে গিয়ে, হাটতে শুরু করলাম।
অনেক লাশ।
একটা লাশের দিকে চোখ গেলো
কাছে গিয়ে দেখি, গণধোলাইয়ে মরা কেউ।
শরীর মাথা বুক পিঠে, মানুষের লাথি ঘুশির ছাঁপ
বোধয়, কারোর পকেট মারতে গিয়েছিলো।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আবার,
স্বভাব আর ঠিক হলো না।
আমি আবারও হাটতে শুরু করলাম।
পায়ের কাছে কিসে যেন হোঁচট খেলাম,
উপুড় হয়ে থাকা একজন ব্যক্তি, হাত জড়ো।
তার স্পর্শে, চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার দৃশ্য।
দু হাত জড়ো করে দারে দারে ধর্ষিতা মেয়ের বিচারের জন্য
ঘোরা।
তার মেয়ে হৃদয় বিদারক সেই চিৎকার,
নরপিশাচদের লোলুপ চাহনি, নখের আচড়
যন্ত্রণা।
রক্তাক্ত যোনী, পাঁচ দশ মিনিটের যৌন লোভের জন্য
একটা গোটা জীবন বরবাদ করে দেয়া।
যেন নারী দেহ কেবলই একটা মাংসপিণ্ড মাত্র,
ওদের খোড়াক মেটানোর জন্য।
ধর্ষিতা মেয়ের চিৎকার, বাবার বুকে লোহার আঘাতের চেয়েও বেশি কষ্টদায়ক।
পাঁজর ভাঙার শব্দ আসে ও থেকে।
লোকটা বিচার না পেয়ে, মেয়ের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে
গেলো।
মর্গে নানান জীবনের দর্শন মেলে
মেলে নানান গল্প, বাস্তব চরিত্রের কথা।
কিছু গল্প পৃথিবীতে নামধারী চরিত্রের কথা বলে,
কিছু গল্প, মর্গে উন্মুক্ত হয় ডোমের হাত ধরে।
যেমনি ঐ বাচ্চা ছেলেটা,
সাদাকালো আকাশের বুকে রঙিন ঘুড়ি ওড়ানোর
তাড়নায় রোজ লাটাই হাতে ছাদে চলে যেত।
কাটাকুটি মাঞ্জা দেয়া নিয়ে কতোই না সুখকর,
হাসিমাখা ছেলে সে।
পাগলামোটা বেশিই ছিলো,
নইলে ঝড়ো বাতাসে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে কেউ ঘুড়ি
ওড়াতে ছাদে যায়।
সেই কাল হয়ে দাঁড়ালো।
পা পিছলে সোজা নীচে।
হাফপেন্টের পকেটে এখনও দুটো লাটাইয়ের সুতোর গুটি।
ঘুড়ির সাথে সাথে প্রাণটাও উড়ে চলে গেলো।
ভাবতে ভাবতে একটা মৃতদেহের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম,
বেশ পরিপাটি কাপড়চোপড়।
দেখে মনে হচ্ছে সদ্য পাশ করা কোনো যুবক।
চাকরির পেছন ছুটতে ছুটতে জীবনের অনেকটা সময়,
পার করে দিয়েছে।
বয়সের সাথে সাথে বেড়ে ওঠা দায়িত্ব, কর্তব্য
সেই সাথে বয়স্ক সার্টিফিকেট।
বোনের বিয়েটা দেবার ছিলো,মা'য়ের চোখের অপারেশন
বাবার বন্ধক দেয়া জমিটা ছাড়ানোর কথা ছিলো।
নিষ্ঠুর পৃথিবী দুদন্ড সময় দিতে পারলো না ওকে।
আর ক'টা দিন হলেই হতো।
এক বেলা খেয়ে না খেয়ে চাকরীর পেছনে ছুটতে ছুটতে
রোগ যেন বাসা বেঁধে বসেছিলো।
মা বোধয় জানতো না ওসব।
ছেলেটার মুখে স্বপ্ন জ্বল জ্বল করছিলো।
হাহ্ নিয়তি।
না জানি তারা কতজনকে কতো কথা দিয়ে রেখেছিলো,
ফেরার কথা।
নিজের সাথে অন্য কাউকে জড়ানোর কথা।
মাইনেটা পেলেই নতুন শাড়ি কিনে দেয়ার কথা,
কারোর হাতের মেহেদী রাঙিয়ে তোলার কথা,
কিংবা ক'টা টাকা বাঁচিয়ে মাসের শেষে পরিবারের মুখে
এক টুকরো মাংস তুলে দেবার কথা।
এই কথাগুলো আর বলা হবে না, কেউ অভিমানে ফুঁপিয়ে
কাঁদবে, কেউ প্রিয়জনের কবরের পাশে জায়গা করে নেবে।
বলতে বলতে নিজের স্ট্রেচারে ফিরে এলাম।
এখনই বোধয় ডোম চলে আসবে
আমাকেও এফোঁড় ওফোঁড় করতে।
আর ভালো লাগছে না, কাজটা হয়ে গেলেই হয়
ওদিকে কবরও ডাকছে।
এতদিনে নিজের স্থায়ী একটা ঠিকানা তো।
যত দ্রুত যেতে পারি আরকি।