উত্তপ্ত বর্ণচোরা
মাহিনের মন খারাপ। খারাপ বলতে অনেক মন খারাপ। ট্রেনে কাটা দেহের অস্থির কাঁপনের দৃশ্য দেখার পর যতোটা খারাপ লাগে, তার থেকেও বেশি খারাপ। কিন্তু কেনো খারাপ তা কাউকে বলতে পারছে না। মাহিন জানে, দুখের কথা বললে অনেকে মজা নেয়। করুনার চোখে দেখে। সে চোখে লুকিয়ে থাকে মজা। উপর উপর অনুভবের মিথ্যা জাল বুনে মনে মনে তাচ্ছিল্য করে। এজন্য মন খারাপের কারণ শেয়ার করতে চায় না মাহিন, বুকের উপর দিয়ে পাথুরে ঝর বয়ে গেলেও চায় না।
বিছানায় একটু পর পর এপাশ ওপাশ করতে থাকে। রাত গভীর হয়। গভীরতা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তার কাছে। শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এক সময় রাতের আঁধার ধুয়ে নেমে আসে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে। সিগারেট হলে ভালো হতো। নিকোটিন পছন্দ না, তবে সময় সাপেক্ষে চাহিদার তালিকায় চলে আসে। এখন এসেছে। রবীন্দ্রের বিরহ সংগীত শুনতে শুনতে চাহিদা তৈরি হয়েছে। কিন্তু হাতের কাছে নেই, এতো রাতে পাওয়াও যাবে না।
রাতের গভীরতা কমছে। বৃষ্টির নাচন থেমেছে আগেই। নাচন থামিয়ে রনিঝিনি গাইছিল। এখন তাও নেই। রাতের আঁধার ধুয়ে ধুয়ে সেও বোধ হয় ক্লান্ত। ধীরে ধীরে পুবাকাশে আলো দেখা দিচ্ছে। কালসিটে আলো। ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। এখন সোনালি। মাহিন রাতের রঙ পাল্টানো দেখছে। তার মনের রঙও পাল্টাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছেÑ রঙ পাল্টাচ্ছে। কালো থেকে এখন লাল হতে শুরু করেছে তার হৃদয়।
সকালের সূর্য এখন বেশ তরতাজা। সূর্যের আলো জানালা গলে মাহিনের কালো চেহারা ছুঁয়েছে। ওম ওম ভাব। সে উষ্ণতার ছোঁয়ায় কালো চেহারা বেড়ে গলে গলে পড়ছে লবণাক্ত জল। সে জলে মাহিনের বালিশ ভিজে যাচ্ছে।
এখন সূর্যের তেজ ফুটেছে। গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছে সে। তারপরও বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না। রাতের আঁধারের রঙ বদলে মনের রঙ বদলেছে ঠিকই, কিন্তু তা রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত। সেখানে বারবার প্রশ্ন করছে কেউÑ কেনো প্রাণ দিতে হলো প্রিয় বন্ধুকে? বর্ণ বৈষম্য কী মানববর্ণের থেকেও শক্তিশালী? এতোটা সহজ সরল ছিল নীরুপমা, তারপরও কেনো? প্রশ্নের সাথে সাথে আরও জড়সড় হয়ে বিছানার সাথে গুটিসুটি মেরে যায় মাহিন। এর মধ্যে পার হয়েছে বেশ খানেক সময়।
কলিংবেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই অজানা অচেনা মানুষের হুড়োহুড়ি। ঘরভর্তি হয় সাংবাদিকে। একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত হয় মাহিন। উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তীর্যক প্রশ্নকেও হজম করে যেতে হয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বর্ণ। সে বর্ণকেও যেনো কেউ চুরি করে গেছে। চুরি করে হয়ে গেছে আকাশের তারা।
প্রশ্নের সাথে সাথে দরজায় পোষা কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।