"অামি ইথার;কবি নই
তবে অাজন্মকালের শিল্পী,
অামার চেহারা ঠিক নরম দেশলাইয়ের মত
যার অাছে জ্বালিয়ে দেয়ার ক্ষমতা।"
(ইথার)


"কাল-জ্ঞানহারা অামি,পেয়েছি শুধু তোমার রূপ-রস-গন্ধ,
তাই বিচূর্ণীত শিল্পচেতনায় নত হয়েছি তোমারি কাছে।

তবু কেন অস্তিত্বের অাহ্বানে সাড়া দিয়ে
নিজেকে ভেঙে পুনরায় গড়ে তুলছো তোমার শরীর?

অামি নির্দিষ্ট বলয়,বৃত্ত,বৈভব,উৎকর্ষতার মায়াবী অাঁচলে
তোমায় বেঁধে রাখতে পারিনি বলেই
কবিতা তুমি সংজ্ঞাহীন।"
(ইথার)


অামি ইথার,কখনোই শিল্পকে পণ্য হিসেবে কোথাও উল্লেখ করিনি।কেউ যদি শিল্প শব্দটির ভুল অর্থ করে বসেন, অামি অাফসোস ছাড়া  কিই-বা করতে পারি!!


অামার দৃষ্টিতে কবিতা অবশ্যই শিল্প।অাপনারাই তো বলেন-কবিতার শিল্পমান নিয়ে কথাবার্তা।কবিতা যদি শিল্প না হয় তাহলে শিল্পমান অাসলো কোথা থেকে?
তাই কবিতাকে শিল্প না বলাটা হাস্যকর হয়ে পড়ে।


অামি মনে করি কবিতা মানেই শিল্প।সকল যান্ত্রিকতা,প্রকৌশল ও প্রযুক্তির সহাবস্থানে কবিমনের ঝলকানি দ্বারা কবিতার সৌন্দর্যসৃষ্টির সহজাত প্রক্রিয়ায় যুক্তি ও বুদ্ধিকে অতিক্রম করে চিরন্তন বোধের ভেতর থেকে শুরু হয় সত্য ও সুন্দরের পথে অভিযাত্রা,ঠিক তখন থেকেই উন্মোচিত হয় জীবন রহস্যের বেড়াজাল;তৈরি হয় অাপেক্ষিক জগত,যেখানে বর্ণ অাদল ও অবয়ব অার অন্তর্গত ধ্বনির মাধ্যমে অবচেতন ভাবনায় অাসে সকল সৃজনশীল কর্মকান্ডের প্রতি প্রবল অাগ্রহ, যার জন্যে বিরল মুহূর্তের বাচনভঙ্গি ও অনির্বচনীয় ভাষা অার কল্পচিত্রের সহযোগে কবির গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হয় কবিতা নামক শিল্প।
(ইথার)


অামি অারো মনে করি,কবি মঙ্গলগ্রহের কেউ নন!ইতিহাস কিংবা সমসাময়িক প্রেক্ষাপট অার পারিবেশিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হোন জগতের সকল কবি।এমনকি কবি যা খান,কবি যেখানে হাঁটেন,কবি যেভাবে নিঃশ্বাস নেন,ঠিক সেভাবেই সকল পাঠকের ঘটে অবাধ বিচরণ।শুধুই শিল্প-অাশ্রিত কল্পনাশক্তির সীমাবদ্ধতাই কবিকে তফাৎ করে সকল পাঠকের নিকট হতে।
(ইথার)


অামি ইথার পুর্নবার মনে করি যে,কবিতা এই কারণে শিল্প,যেখানে কবি একটি অাকাশ এনে হাজির করেন,কেউ দেখে ভাসমান মেঘ,কেউ দেখে উড়ন্ত পাখি অাবার কেউ দেখে দশেরার চাঁদ।অাসলে এ এমন এক শিল্প যার পরতে পরতে অাছে অাপেক্ষিকতার ধুম্রজাল।
(ইথার)

এতক্ষণ শুধু নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলে গেলাম।
এবার অাসুন কবিতাকে কেন অামরা শিল্প বলবো তার একটা পর্যবেক্ষণ দেখা যাক।

কবিতা হলো শিল্প এই সম্পর্কে  কবি-সাহিত্যিকরা কি মতামত দিয়েছেন?চলুন তবে দেখা যাক------


" কবিতার সপক্ষে "শীর্ষক গদ্য রচনায় শেলী বলেছেন, "কবিতা হচ্ছে উপমায়িত শিল্প। "
শেলী আরও বলেছিলেন, “কবি হচ্ছেন নাইটিঙ্গল যে অন্ধকারে বসে থাকেন আর নিজের এককীত্বকে সুরে সুরে উদযাপন করেন।”

শেলী আরও বলেছিলেন : “কোনো মানুষ হুট করে বলতে পারেন না, “আমি কবিতা রচনা করবো।” মহৎ কবিরাও বলতে পারেন না এরকম কথা, কেননা অদৃশ্য অস্পষ্ট দূরাগত কোনো কিছুর প্রভাবে মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে কবিতা, যেন ঝাপট এসে লাগে কোনো অনিয়ন্ত্রিত তীব্র হাওয়ার, বিদ্যুচ্চমকের মতো আলোয় আলোয় ভাসিয়ে দেয় দিকচক্রবাল।”

"কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ"
(শেলী)


রবার্ট গ্রেভস-‘ইংরেজি কবিতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “কবিতা বলতে আমি বুঝে থাকি নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত এক সমন্বিত শিল্পকে, যার একটি অংশ অন্য অংশটি ছাড়া অসহায়, অর্থহীন।”


‘ডেডিকেশন’ কবিতায় পোলান্ডের বিখ্যাত কবি চেশোয়াভ মিউশ বলেছেন, What is poetry?
কবিতা সম্পর্কে তিনি তাঁর বিখ্যাত সেই কবিতায় বলেছেন : "The purpose of poetry is to remind us/ how difficult it is to remain just one person,/ for our house is open, there are no keys in the doors,/ and invisible guests come in and out at will".
"...that I’ve devised just one more means/ of praising Art with the help of irony।"


ডেড পোয়েটস সোসাইটি মুভিতে রবিন উইলিয়ামস বলেছিলেন – “Medical, Engineering, Business, Law...These are noble professions without which life would be impossible. But poetry, music, romancs....these are the things that make our life meaningful.With the previous professions we become able to live but with the later ones...that's what we live for!”


"Poetry is Love, Romance & Beauty"
(Bayron).


"When truth has no burning, then it is Philosophy, when it gets burning from the heart, it becomes Poetry."
(Allama M. Iqbal).


টিএস ইলিয়ট বলেছেন-" কবিতায় শিল্প কী? জীবনের আবেগ? না,কবিতায় শিল্প হচ্ছে জীবনের আবেগ থেকে মুক্তি।"


এজরা পাউন্ড -"অ আ ক খ "শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন," সময়কে নির্দিষ্ট মাত্রায় বিভাজিত করে কবিতায় ছন্দোস্পন্দ সৃষ্টি করেন কবি"।

★রবার্ট গ্রেভস বলছেন-" কবিতায় যে সাংগীতিক ছন্দোস্পন্দের সৃষ্টি হয় তা কবির মনোজগতের আবেগায়িত ছন্দোস্পন্দের ফল। "


"কবিতা হলো প্রবল অনুভূতির স্বতোৎসার, যার উৎস ‘ইমোশন রিকলেক্টেড ইন ট্রাঙ্কুইলিটি"
(ওয়ার্ডসওয়ার্থ)।


"কবিতাকে হতে হবে মহৎ এবং বাঞ্ছিত, যার যাতায়াত আত্মার ভিতরে, যা ভোলায় না বা চমকে দেয় না তার রূপে, চমকে দেয় বিষয়ে"
(কীট্‌স)।


"কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রণা"
(অডেন)।


"কবিতা আমার বহুকালের প্রেয়সী "
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


"কবিতা হচ্ছে, প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার"
(নির্মলেন্দু গুণ)।


"কন্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দাবলী কবিতা। যে কবিতা শুনতে জানে না, সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে"
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)।


পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি রণজিৎ দাশ বলেছেন "কবিতা হলো প্রেমানুভূতির শিল্প। তার উৎসে রয়েছে অপরের দুঃখ-যন্ত্রণাকে নিজের দুঃখ-যন্ত্রণা হিসেবে অনুভব করার ক্ষমতা। অর্থাৎ শিল্প কখনোই আমি-কেন্দ্রিক নয়, তুমি-কেন্দ্রিক। কবিতায় কবির নিজের দুঃখ-যন্ত্রণার যে প্রকাশ, তার মধ্যেও রয়েছে কবির তুমি কেন্দ্রিক নৈর্ব্যক্তিতার মানস। কোনো শিল্পই শিল্পের জন্য নয়, শিল্প পৃথিবীর জন্য।"

তিনি অারো বলেছেন-----
"কবিতা কী? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। যুগ যুগ ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার নিষ্ফল চেষ্টার পর, মোটামুটি এমনই সার্বিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে, এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। যেখানে হাতি-ঘোড়া গেল তল সেখানে মশা বলে কত জল।.. কবিতা যদি হৃদয়ের কথা হয়, তাহলে হৃদয় কী? কাকে বলে মানবহৃদয়?.. হৃদয় হলো প্রেমের শক্তি এবং স্বয়ং প্রেম।.. তাহলে এবারে আমরা ভাবব যে, কবিতা হল হৃদয়ের কথা, হৃদয় হল প্রেমানুভূতি, আর কবিতা হল সেই প্রেমানুভূতির শিল্প। প্রেমের বেদনা, মনুষ্যত্বের বেদনা, আমরা সারাজীবন কবিতায় বেদনারই গান গাই।".. রণজিৎ দাশ। বাতিঘর, ২৭ জুন ২০১৪


বর্তমানের অন্যতম কাব্য সমালোচক মুনশী অালিম বলেছেন--
"কবিতা কোন ভূঁইফোঁড় শিল্প নয়। তার বিকাশের পশ্চাতে নিহিত থাকে পারিপার্শ্ব সংলগ্নতার গভীর এক পরোক্ষ ও নিঃশব্দ ইতিহাস। "


বুদ্ধদেব বসুর কাজী নজরুল  ইসলাম সম্পর্কে একটি উক্তি---,"নজরুল ইসলাম ততটাই সচেতন কবিতাশিল্পী, যতটা শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয়।"

এবার ধরুন,অামি সবার উক্তি বর্জন করে দিলাম।কেবলমাত্র বুদ্ধদেব বসুর উক্তিটি নিয়েই একটু কথা বলি-----

অামার প্রশ্ন কবিতাকে যদি শিল্প না বলতে পারি তবে নজরুল কিভাবে কবিতাশিল্পী হলেন।কবিতা যদি শিল্প না হয় তাহলে ধরে নিব কবি বুদ্ধদেব বসু ভুল বলেছিলেন।


অালোচনাটি অার দীর্ঘায়িত করবো না।এটি অামার একান্ত ও নিজস্ব অালোচনা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ।অামার দৃষ্টির সাথে অাপনারা বিরোধীতা করতেই পারেন।শেষ পর্যায়ে অার তিনটে উক্তির কথা বলে যাই-------


সুধীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ব্যক্তিমানব কী উপায়ে বিশ্বমানবের সঙ্গে মিশবে, তার সন্ধানেই কবিপ্রতিভার একমাত্র স্বার্থকতা।"


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, "কাব্য গড়ে, বিজ্ঞান ভাঙে।"


সবাই ভালো থাকুন।

"আমাদের দেশে পাঠক নাই, ভাবের প্রতি আন্তরিক আস্থা নাই, যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহাই চলিয়া যাইতেছে, কোনো কিছুতে কাহারও বাস্তবিক বেদনাবোধ নাই; এরূপ স্থলে লেখকদের অনেক কথাই অরণ্যে ক্রন্দন হইবে এবং অনেক সময়েই আদরের অপেক্ষা অপমান বেশি মিলিবে।”--
( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)