অনেকদিন থেকেই
আমার একটা বাগান করার ইচ্ছা।
ঠিক সাধারণ বাগান নয়, অন্য কিছু ভিন্ন কিছু ।
একটা বন,
বিশাল একটা অরণ্য।
যেখানে  বিশাল গাছেরা ছায়া দেবে।
তারই ছায়ায় বেড়ে উঠবে হাজার রকমের ফল ফুলের গাছ।
অজস্র পাখির কলরবে মুখরিত হবে নির্জন পায়ে হাঁটা পথ।
প্রজাপতি রঙে রঙিন হবে সবুজের বুক।
তারি মাঝে এক টুকরো জলাধার,
জলাধারে সারারাত জুরে ভেসে বেড়াবে ব্যাঙের কোলাহল
সেখানে থাকবে আমার জন্য একটা ছোট্ট ঘর,
যার সামনে থাকবে এক টুকরো উঠোন
যেখানে বসে আমি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় কবিতা লিখব।

অনেকদিন আগে
একটা ছোট্ট নদীর পাশে এক টুকরো জমি কিনেছিলাম,
ভাবছি ঐ জমিটা দিয়ে দেব বাগানকে।
জমির এখানে সেখানে কিছু গাছের চারা  
পুতে দেব অগোছালো ভাবে,
গ্রামের ছেলে মধুকে বলবো
জমি জুরে ছড়িয়ে দিতে হাজার রকম ফুল ও ফলের বীজ।
আস্তে আস্তে ওরাই বেড়ে উঠবে,
ডালে ডালে, পাতায় পাতায় ভরে উঠবে,
ডেকে নেবে পাখিদের, প্রজাপতিদের।
খরগোশ খুঁজে নেবে তার আবাস।
জন্ম নেবে একটা বাগান,
বাগান থেকে বন এবং বন থেকে অরণ্য।

এ অরণ্য জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য।
এখানে মৌরীর গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে
ক্লান্ত শালিকেরা হেটে যাবে নরম পায়ে।
এ অরণ্য মাটির যত্ন নেবে, প্রকৃতির যত্ন নেবে।
সবুজেরা  মিসে যাবে মায়াময় নীলের চাদরে।
এ অরণ্য মানুষকে খাদ্য দেবে, প্রাণীদের জন্য
হবে এক অভয়ারণ্য।
পাখিরা  নীড় খোঁজে পাবে
মানুষ পাবে খাদ্যের বিশাল ভাণ্ডার।
কাঠবিড়ালিরা বাদামের গন্ধে ছুটে যাবে গাছে গাছে,
ফুলের গন্ধ আর রূপে মুগ্ধ প্রজাপতি ছড়াবে স্নিগ্ধতা।
রাতের আকাশে ঝিঁঝিঁপোকার সম্মিলিত সংগীত
মূর্ছনায় মুগ্ধ আমি নিদ্রাহীন থেকে যাব সারা রাত।

বন্ধুরা আমার কথা শুনে হাসে
কেউ সাহস দেয় না, দেয় না উৎসাহ ।
আমাকে পাগল বলে,
আমার বয়সের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমি ওদের দোষ দেই না,
আমার এ স্বপ্নটার মধ্যে কিছু বিলাসিতা আছে;
আছে কিছুটা পাগলামো।
ওদের বলতে পারিনা স্বপ্নটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
জানি এই বয়সে ইচ্ছেটা বড় বেমানান
কিন্তু ওদের বলতে পারিনা স্বপ্নের কোন সীমানা নেই,
সৃষ্টির নেই কোন গন্তব্য।
এ এক নদী, কেবলই বহমান ।
ওদের বলতে পারিনা এটা কোন গান নয়
নয় কোন কবিতা,
এটা একটা জীবন
যেখানে থাকবে মানুষ, থাকবে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ,
বহুবর্ষজীবী ছোট বড় গাছের সারি।
এখানে ছায়াময় স্নিগ্ধ পরিবেশে মানুষ বিশ্রাম নেবে,
ফুলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবে।
এখানে জলাধারে থাকবে  মাছেদের কলরব,
মুরগিরা ঘুরে বেড়াবে সারা বন ময় ।
বাচ্চা ছেলে-মেয়রা প্রকৃতিকে জানবে,
প্রকৃতির জীবনচক্র সম্পর্কে শিখবে।
এটা হবে একটা বিশাল  প্রাকৃতিক স্কুল
যেখানে কোন শিক্ষক থাকবেনা,
থাকবেনা ক্লাস রুম ।
পুর বনটাই হবে একটা স্কুল;
ঘাস ফুল থেকে গাছের পাখিরা
সকলেই  হবে এর শিক্ষক ।



আমার ছেলে বলে বাগান করবে তো এখানে করো
যেখানে ত্রিশ বছর ধরে আছো,
বাংলাদেশ কেন,
সেখানে তোমার কি আছে !
আমি আশ্চর্য বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি,
তাইতো বাংলাদেশ আমার আছে কি যে টানবে ওদের।
ত্রিশ বছর আগে যে শিকর ছিঁড়ে এসেছি
তাকে কি আবার নতুন করে বোনা যাবে!
ওকে বলতে পারিনা বাংলাদেশ আমার স্মৃতির পাহাড় আছে,
আছে মমতাময়ী মায়ের আদর।
ওখানে রেখে এসেছি একটি বিশাল মাঠ
যেখানে আমার শৈশব দোল খায়
জোছনা রাতে যেখানে নেমে আসে পরীরা,
অন্ধকার রাতে ভুতেরা লড়াই করে।
ওখানে আছে আকাশ ভরা সোনার আলো,
আছে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল নীলাকাশ;
মাঠ ভরা প্রজাপতি।
গাছে পাকা আম্রপালি, লাল ঘুড়ি
মায়ের হাতে বোনা এক টুকরো অহংকার।


আমার স্ত্রী বলে
করো বাংলাদেশেই কিছু কর,
তবেই না ছেলেদের দেশের জন্য টান বাড়বে ।
তখন থেকেই ইচ্ছেটা আরও প্রবল হোল,
শেষ জীবনটা দেশের মাটিতে কাটাবার
একটা প্রবল টান ক্রমশ আমাকে অস্থির করে তুলল।
একটা বাগান কিংবা বন অথবা অরণ্য,
সবই কেবল মাত্র ফিরে যাবার জন্য।
শিকড়ের টান ক্রমশ সংক্রামিত হতে থাকলো শিরায় শিরায়,
হয়তো কিছুই না তবু তো একটা কিছু।
ইচ্ছেটা পুষে রাখি প্রবল আবেগে
গুগোলে এ দৃষ্টি  বোলাই,
সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে থাকে ক্রমশ
সম্ভব, ফিরে যাওয়া সম্ভব।
সৃষ্টির উন্মাদনায় ভুলে যেতে থাকি সময় এবং বাস্তবতার কথা,
কেবল সম্ভাবনা ডাকতে থাকে আমাকে।
দিগন্তে দাঁড়িয়ে কে যেন আমায়  ডেকে নিতে চায়,
বলে আয় ফিরে আয়।
ফিরে যাওয়া কি এতই সহজ!
ফিরতে চাইলে কি ফিরে যাওয়া যায়!
তবু যেতে হবে,
হাতে তুলে নিতে হবে সম্ভাবনার হাতিয়ার।
মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার এইতো সময়।
উত্তরাধিকারীদের জন্য খুলে দিতে হবে
একটি সম্ভাবনার দুয়ার,
যার ভেতর দিয়েই তিলে তিলে তৈরি হবে
নিজের শিকড়কে খুঁজে নেবার নতুন যাত্রা।