সাহিত্য সমালোচনা যেনতেন কার কাজ নয়। আর কবিতা নিয়ে সুন্দর এবং ভাবগাম্ভীর্যপুর্ণ আলোচনা করাটা আরো বেশি কঠিন। বলতে দ্বিধা নেই এ বিষয়ে আমি একেবারেই অযোগ্য। এর আগেও  আসরের দু’জন কবির কবিতার উপর নিত্যান্তই  শখের বসে দু’এক কলম লেখার দুঃসাহস দেখিয়েছি এই  ভেবে যে, আমার অযোগ্যতাগুলো  গুণীজনদের নিকট  ধরা পড়লে তা  শুধরে চেষ্টা করব। আজকের লেখাটিও  সে ধরনেরই  একটি  লেখা। আসরের  একজন  স্বনামধন্য কবির  কবিতার  আলোচনা করতে গিয়ে যদি কোন ক্রটি হয় তবে এজন্য  প্রিয়জনদের  নিকট শুধরাবার পথ পাব বলে প্রত্যাশা রাখি। কবি অনিরুদ্ধ  বুলবুল আসরের গুণী ও  বোদ্ধা  কবিদের অন্যতম একজন কবি। তিনি আপাদমস্তক  কবি ।  অনিরুদ্ধ  বুলবুল নিসর্গ ও  প্রকৃতির কবি। তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত হয় প্রকৃতি ও নিসর্গের প্রেম, মানবিক মুল্যবোধের আহবান, প্রেম-প্রীতির  নিরঙ্কুশ স্বপ্ন। তার কবিতা অল্প-বিস্তর যতটুকু পড়েছি তাতে তাঁর কবি মনের স্বাতন্ত্র্যতা  তাকে  একজন  শক্তিমান কবি হিসেবে প্রকাশ করেছে। তার কবিতায় প্রকৃতি মগ্নতা ও নিসর্গের সাথে মিলেমিশে  একাকার হওয়ার নিসর্গবীক্ষা পাঠককে দারুনভাবে আলোড়িত করে। কবির নিসর্গানুভূতির  প্রবল প্রকাশ  ঘটেছে  এভাবেই-
“কাশফুল সুজনিতে বিছানো আভায় ভাসে
প্রণয়ের সুর - তোমার আঙ্গিনা যায় যে ভরে।
বিধিবদ্ধ সফেদ-ফেনিল জ্যোস্নার ফোটা ফুল
মানাবে কি ভাল তোমার ওই কাজল কুন্তলে?” (জ্যোৎস্নার ফুল)


বাংলার দেশজ প্রকৃতি, কোকিলের চেনাসুর, আমলকির কড়া স্বাদ, গ্রাম বাংলার  নীলিমার মায়াময়  হাতছানি কবি  মনকে আলোড়িত করে। তাকে ফিরে যেতে আহবান জানায় বার বার, সবুজ প্রকৃতির সাথে গভীর মিতালিতে  কবিও  যেন চাতক প্রেমিক। তাই তার কবিতায় আপন পথে ফেরার আকাঙ্খা-
যত সুখ যাপনের সুবাসিত বিলাসে
আমলকি কড়া স্বাদ স্বপ্নের প্রতিভাসে।
পথ সে তো একটাই - উদাসী আঙিনায়
বারবার ফিরে আসি ওই চেনা নীলিমায়... (ফিরে আসি)


বাংলার  নিসর্গালোকের  প্রাণসত্তা বসন্ত ঋতুর আবির্ভাবে  কবির স্বপ্নজগত সুবাসিত হয়  দখিনা বাতাসের মোহময় স্নিগ্ধ বৈকালিক রোদে। মৃদু সংগীতের তান  ছড়িয়ে যায় কোকিলের ঠোঁটে  আর প্রজাপতির হলুদ ডানায়।  গ্রাম বাংলার প্রকৃতির এই মায়াময়তার মাঝে  কবি আপন মনে খুঁজে  ফেরেন এক নিসর্গ-নিবিড় বিলাসিত আঙ্গিনা-
“সুরেলা দখিন হাওয়া আন্দোলিত হবে যখন
গায়ে মেখে বৈকালিক স্নিগ্ধ রোদ
“আয়েশি নৃত্যে লীলায়িত অঙ্গরাগের বাসন্তি কানন
পরাগায়নের মৃদু সংগীতে ফুলে ফুলে ছড়াবে সোহাগ
কোকিলের ঠোঁটে আর প্রজাপতি পাখনায়
বাজবে সেতারের গুঞ্জন -
আমি ঠিক উড়ে আসবো ডানা দুটি মেলে
তোমার ওই চারুহৃদের বিলাসিত আঙিনায়।“ (বসন্ত দিনে)


প্রকৃতি  প্রেমিক  কবি প্রকৃতি  ও  নিসর্গের  সাথে কখনো মিলেমিশে একাকার হয়েছেন   কখনো  বা প্রকৃতিকে দেখেছেন পথভোলা  এক চঞ্চল  কিশোরি রুপে ।  বৃষ্টি যেন প্রকৃতির অপরুপ নারী,  ডেকে যায় কবি মনকে ।  তাইতো  প্রেমিক কবির উচ্চারণ-
“আলভোলা এক বৃষ্টিমেয়ে
একশা হলো ভিজে নেয়ে
মন-খারাপের ঘোর অবেলায়
বৃষ্টিমেয়ে ধুম নেচে যায়।“ (বৃষ্টিমেয়ে কাঁদছিলো)


সুখ কখনো নিরঙ্কুশতা পায়না। মানব জীবনে সুখের পাশে দুঃখ,  প্রত্যাশার পাশে স্বপ্নভঙ্গতাও   শ্বাশত সাথী।   জীবন প্রাপ্তি  থেকে শুরু মৃত্যু  অবধি কতই না প্রতিকূলতা  অতিক্রম করতে হয়। স্ বপ্ন দেখে এগিয়ে চলা আবার স্বপ্নের ভাঙন, তবুও  থেমে থাকে না কিছুই কেননা গতিই  জীবন।  অনিন্দ্যসুন্দর কাব্যময়তায় তাই কবি বলেছেন-
“সোনামুখী রোদের ঝালরে ছাই, উড়ে বাস্পকণা
প্রত্যাশার ক্যানভাসে ছড়িয়ে তখনো স্মৃতির উষ্ণ আভা
শান্তির প্রহেলিকা তবু সুদুরেই থাকে
হাতছানি দিয়ে যায়, মোহন মায়ায় ডাকে –
আয়, আয় - এ-বেলা পরশটুকু নিয়ে যা।“ (প্রত্যাশার ক্যানভাস)

সন্ধ্যার প্রকৃতি আভা কবিকে  আত্নভোলা  করে তুলে, কবি মনে জাগে নতুন স্বপ্ন। সন্ধ্যার নিরব প্রকৃতি কবি হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে,  সন্ধ্যার অন্ধকারের মাঝে আশার  প্রদ্বীপ জ্বেলে মোহময়  এক অজানা সুরের ভূবনে নিজকে নিবেদন করেন কবি। স্বপ্নের  পরিপুর্ণ  প্রেমের প্রশান্তি  সমস্ত অভাব বোধের উর্ধ্বে  কবির সমস্ত সত্তা জুড়িয়ে দেয়-
“আজ, স্বপ্নের আবাহনে পেয়েছি খবর
মনের অতলে যেন কে খুঁড়েছে বিহ্বর
কূলহারা সন্ধ্যায় দীপ জ্বেলে যাই
কোথায় হারালো মন কোথা খুঁজে পাই।
চেনা সুর কেনা গান ঠোঁটে ভেজে যাই
সুরের ভুবনে ভেসে নিজেকে হারাই।” (জেগে থাকে স্বপ্নভাষা)


মানুষ  জন্মগত  ভাবেই অতৃপ্ত , একটু  পেলে  আরও পেতে  চায় । সুন্দরের  মাঝেও   শ্রী খুঁজে বেড়ায়। অঢেল তৃপ্তির পর  আরও ইতিউতি চায়।  এটাই তো সহজাত প্রবৃত্তি। জন্মিলেই  মরিতে হবে এটাই  চিরন্তন সত্য, তবুও  জীবন চলে চলতেই  হয়। কেননা জীবনের অপর নাম বহতার সংগ্রাম। পৃথিবীর  সকল কিছুরই  যেমন  পরিসমাপ্তি  আছে  তেমনি জীবনেরও সমাপ্তি  আছে  কিন্ত সে জীবনকে যদি আলোকিত করতে না  পারি ;  না পারি অন্যকে আলো দিতে তাহলে সে জীবনের সার্থকতা কোথায় ?  তাই কবির দ্বিধাহীন কন্ঠস্বর-
“এই ধরণীর পথে পথে কুড়াই প্রীতির ফুলগুলি
সোহাগ প্রীতির ধুলো গায়ে ভরি প্রাণের অঞ্জলি।
ফুল? সে তো পাঁপড়ি কেবল দল মেলা কলি
কী দাম আছে তার যদি প্রলুব্ধ না হয় অলি!” (প্রীতির ফুল)

কবির  বিশাল কাব্য  সম্ভার থেকে  মাত্র কয়েকটি কবিতার আলোচনা করে কবির পরিপুর্ণ মুন্সিয়ানার প্রকাশ সম্ভব নহে।   তবে তার কবিতার মৌলিকত্ব,  সুনিপুণ শব্দ চয়ন  গভীরভাবে  পর্যবেক্ষণ করলে সহজে বুঝা যায় কবি  অনিরুদ্ধ  বুলবুল  তার  কবিতায় একটি ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন,  যা তাকে একজন শক্তিমান কবি হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। প্রকৃতি ও নৈসর্গিক কাব্যময়তা এবং কবিতার ভাব,বিষয়  নির্ণয়ে   তার সৃষ্টি সাফল্য প্রশংসার দাবীদার।    সব মিলে বলতে হয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল প্রকৃতি  ও  নিসর্গ  প্রেমিক  কবি ।    আমরা কবির শুভ সাফল্য কামনা   করি ।