https://dupurmitra.wordpress.com/2016/06/08/%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ad%e0%a7%8c%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4/
দুপুর মিত্রের ভৌতিক কবিতা
প্রথম প্রকাশ
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
বইটি বিক্রির জন্য নয়।
কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই যে কেউ নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন। এছাড়া বইটির ই-বুক সংস্করণ কেবল মাত্র ই-মেইলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে অথবা যে কোনও কপিলেফ্ট বা ফ্রি বুক সাইট থেকে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারবেন। ই-মেইল: mitra_bibhuti@yahoo.com
প্রকাশক
দুপুর মিত্র
প্রচ্ছদ
চারু পিন্টু
‘ভৌতিক কবিতা’ নিয়ে কিছু কথা
সুমন গুণ
ফরাসী সাংকেতিক কবিতার আসল লক্ষ্য ছিল সব কথা সরাসরি না বলে ভাঙনের কৌশলে, ইশারার আশ্রয়ে বলা। কবিতা নিয়ে যত মৌলিক তোলপাড় হয়েছে সারা পৃথিবীতে, তার মধ্যে সিম্বলিস্ট আন্দোলন সফলতম এইজন্য যে তা কবিতার নিজস্ব অন্তঃসঞ্চারের দিকে তাকাতে পেরেছিল। বাংলায় এই গোত্রের কবিতা কম লেখা হয়নি। জীবনানন্দের সাফল্য সাংকেতিক কবিতার কয়েকটি সূত্রকে অবধারিতভাবে অবলম্বন করে আছে। তারপরেও, বাংলা কবিতার বিকাশে সবচেয়ে প্রভাব পড়েছে এই মৌলিক সূত্রগুলির। দুপুর মিত্রর ‘ভৌতিক কবিতা’ শিরোনামে লেখা কবিতাগুলি সাংকেতিক কবিতা আন্দোলনের লক্ষ্যগুলোকে বিশেষভাবে আলোকিত করছে। প্রথমেই বলি, ‘ভৌতিক’ শব্দটিকে আমি ‘চিরকালীন’বা ‘চিরন্তন’ অর্থে পড়েছি। সংহত উচ্চারণে কিছু স্বাভাবিকতম ভাবনাকে আকার দেবার বাসনায় এই কবিতাগুলো রচিত বলেই মনে হয়েছে আমার। কয়েকটি কবিতা বেছে নিয়ে সেগুলোর সামর্থ্য বোঝানো যেতে পারে।
ভৌতিক কবিতা ৫০
সব ফুল ঘরে তুল না
সব ফুলের হাসি এক নয়
কোনো কোনো ফুলের হাসির
আড়ালে বেদনা
লুকিয়ে থাকে
আর সেই বেদনায় মিশে থাকে নীল
বিষ
নীল এই বিষ থেকে লাল রক্তাশ্রু ঝড়ে
যে মানুষ ফুলের রক্তাশ্রু দেখে
সে মানুষ পাগল হয়ে যায়
এই লেখাটি তুলনায় বড়ো। বড়ো না হয়ে উপায়ও ছিল না, কারণ হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনার ভঙ্গিমাটুকু বোঝাতে এই বিস্তৃতি জরুরি ছিল। শুধু বেদনা নয়, সেই সর্বনাশা বেদনার কবলে পড়ে পাগল হয়ে-যাওয়া মানুষের ছবিটি না দেখালে লেখাটি সম্পূর্ণ হতো না।
আরেকটি বড়ো কবিতা :
ভৌতিক কবিতা ৪৭
হাজার বছরের পুরুনো জিনিসের
সাথে
হাজার বছরের মানুষের আত্মাও
লুকিয়ে থাকে
তাই পুরুনো কোনোকিছু আমি সযত্নে
রাখি
পুরুনো বিষয় আমি বোঝার চেষ্টা করি
পুরুনো ইতিহাস আমি শ্রদ্ধার সাথে
স্মরণ করি
পুরুনো কোনো কিছুর অসম্মান হলে
আত্মারা টের পায়
ধীরেধীরে সেই ব্যক্তির শরীরে ঢুকে
পড়ে
ধীরেধীরে সেই ব্যক্তিকে আত্মহত্যা
করতে উদ্বুদ্ধ করে
তারপর ব্যক্তিটি নিজেই গলায় ফাঁস
দিয়ে মরে পড়ে থাকে
আত্মারা ওই ব্যক্তির আত্মা তাদের
রাজ্যে নিয়ে চলে যায়
ওই ব্যক্তির আত্মা তাদের রাজ্যে নিয়ে চলে যায় সুররিয়ালস্টিক মায়ায় কবিতাটি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এমনকি, কবিতাটিতে যে-প্রকাশ্য যুক্তির বিন্যাস ঘনিয়ে তোলা হয়েছে, তা-ও পুরোপুরি অতিবাস্তববাদী ঘোরে সাজানো। আমি এই লেখাটিকে ‘ভৌতিক কবিতা’ সিরিজের সবলতম লেখা বলে মনে করি। এইরকমই অনায়াস আর সম্ভাবনাময় আরেকটি লেখা :
ভৌতিক কবিতা ৪৫
লোকটা প্রতিদিন পুতুল কেনে
নানান রকম বাহারি পুতুল
লোকটার ঘর ভর্তি পুতুল
আর কেউ নেই
লোকটা একা একা
পুতুলদের সাথে থাকে
পুতুলদের ভাত খাওয়ায়
গান শোনায়
পুতুলদের সাথে কথা বলে
লোকটা টের পায় না যে
সে নিজেও পুতুল হয়ে গেছে
এই লেখায় আছে অতিরিক্ত এক ব্যঙ্গের নিঃশব্দ ধার। এই ব্যঙ্গ আর কৌতুকের চলন অনেকগুলো লেখাতেই পাওয়া যাবে। তাৎক্ষণিকের স্তর থেকে বেরিয়ে সেই সব লেখা আমাদের চেনা বাস্তবতাকে স্পর্শ করে।
যেমন, এই লেখাটি :
ভৌতিক কবিতা ৪৪
এ শহরে কোনো মানুষ নেই
এ শহরে মানুষ থাকে না কখনো
এ শহরে কোনো মানুষ এলেই
রক্তের গন্ধে নেচে ওঠে সবাই
সবাই মিলে কামড়াতে থাকে
মানুষকে
দাঁত থেকে বিষ মানুষের রক্তে
গেলেই
ওই মানুষটাও আর মানুষ থাকে না
হয়ে উঠে মানুষ খেকো মানুষ
ব্যঙ্গের চেয়েও এখানে বেশি প্রকাশ পেয়েছে রাগ। তাই এই লেখাটি অনেক বেশি স্পষ্ট, মুখর। এই মুখরতা যদিও এই সিরিজের লেখাগুলোর আসল ধরন নয়। বরং সীমিত কথায় গন্তব্যকে ধারণ করাই দুপুর মিত্রর লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে সফল কবিতাগুলির একটি :
ভৌতিক কবিতা ৩৩
চারপাশে কারা যেন লাল চোখে
তাকিয়ে থাকে
তীব্র চোখে অনুসরণ করে আমায়
গাছের পাতার ভেতরে দেখি একবার
লাল চোখ
তারপর মিলিয়ে যায় আবার
একবার দেয়ালের ভেতর থেকে
ভেসে ওঠতে দেখেছি
একজোড়া লাল চোখ
তারপর মিলিয়ে গেছে তারা
আমি খুব সন্তর্পণে লাল চোখ এড়িয়ে
ঢুকে পড়ি ঘরে
ঘরের আলনায় এসে দেখি কাপড়ের
বদলে
ঝুলছে একটি করে কাটা হাত
সমস্ত দেয়াল জুড়ে দেয়া লাল রক্তের
হাতের ছাপ
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়
বিছানা ফুলে ওঠল লাল রক্তে
হাসতে হাসতে কারা যেন
তুলে নিল আমাকে বিছানা থেকে
বিছানায় পড়ে রইল আরেক আমি
এই ‘আরেক আমি’র ইশারা দিয়েই কবিতা শেষ করতে পছন্দ করেন দুপুর মিত্র। আমিও, এই পর্যটনময় ইশারার টানেই ‘ভৌতিক কবিতা’ সিরিজের লেখাগুলোর প্রতি আসক্ত হয়েছি।
শামীম রেজা
যে কল্পনাবিশ্ব বাংলা কবিতায় অনালোকিত, বিশেষ করে কম ব্যবহৃত হয়েছে, তারই পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি দুপুর মিত্রের ‘ভৌতিক কবিতা’ গুচ্ছে। বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময় যেমন অনুভূতির সারৎসার, কবিতার রকমও তেমনি, কবি-সমালোচকরা অনেক কথাও বলেছেন কবিতার রকম, ধরন-ধারণ বোধ নিয়ে। শব্দ ব্যবহার ও ছন্দ প্রকরণে অভিনবত্ব না থাকলেও দুপুর মিত্রের ‘ভৌতিক কবিতা’ গুলো পাঠের পর পাঠক মনে করতে পারবে এই কবিতাগুলি দুপুরের একান্ত নিজস্ব জমির ফসল। এটা একজন কবির স্বতন্ত্র প্রকাশ, যা তার কণ্ঠস্বরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে। কখনো কবিতা পড়তে পড়তে মনে হবে বাংলা থ্রিলার বা হরর ছবি দেখছি, কখনো বাংলার প্রচলিত লোকবিশ্বাসকে ভেঙ্গে, কিংবদন্তিকে নতুনরূপে উপস্থাপনের মাধ্যমে দুপুর মিত্র নিজেকে নতুনরূপে প্রতিস্থাপন করেন পাঠকের কাছে।
গ্রামের মানুষের বিশ্বাস।
এই পুকুরের মাছ অনেক রাতে হাঁটতে পারে
পুকুরের আশেপাশে যে মানুষকে পায়
তাকে নিয়ে ডুব দেয় পুকুরের গভীরে
যে মানুষ একবার জলের রাজ্যে যায়
ডাঙ্গার রাজ্যে আসে না ফিরে আর
ভৌতিক কবিতা- ৩১
কিংবদন্তি আছে বাংলার অঞ্চলে অঞ্চলে, বিচিত্র রকম এই বিশ্বাস যা পুরাকাল থেকে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে। যাকে আশ্রয় করে মানুষ তার সভ্যতার বিস্তার করেছে। জোসেফ ক্যাম্বেল যাদের কথা বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন এই সকল লোক-পুরাণ।’ এই সকল বিশ্বাস শুধু যে সাধারণ মানুষের মনের ভিতর থাকে তা কিন্তু নয়; শিক্ষিত মানুষের মনের ভিতর কম বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে পুরাকাল থেকে। মনের ভিতর যে কাল্পনিক জগত আর এই জগতের মধ্যে যে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে ভয়ের ট্যাবু কম বেশি সংস্কারমুুক্ত মানুষের ভিতরও দোল খায়; এটাই দুপুর মিত্রের টার্ণিং পয়েন্ট। মূলত এই কাল্পনিক ভৌতিক জগতের আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে দুপুরের কবিতা।
আমি শুনেছি
ইতিহাসের প্রেতাত্মারা আমাদের ঘরে
বিড়াল হয়ে ঢোকে
আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে…
মাছ মাংসের ঘ্রাণে
ইতিহাসের প্রেতাত্মারা আমাদের
ঘরে ঢোকে…
ভৌতিক কবিতা -২৭
কিংবা
সারাক্ষণ ছায়াটা মানুষটির পেছন
পেছন ঘুরে
তারপর একদিন ছায়াটা মানুষটির
ঘার মটকিয়ে দেয়
মরা মানুষটিকে রেখে ছায়াটা
মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে।
তেমন কোন চিত্রকল্প নাই। চিত্রের ভিতরে চিত্র নাই ঠিকই কিন্তু পুরো কবিতা একটি গল্পের কথনে ছবি নির্মাণ করে, যা পাঠককে ভিন্ন জগতের স্বাদ পাইয়ে দেয়। ছায়া প্রতীকে প্রবল ধর্মের বিপরীতে অন্য এক বিশ্বাসকে সেটা লোক বিশ্বাস হতে পারে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা এই কবির।বিশ্বসাহিত্য পাঠের যৎসামান্য যে সুযোগ হয়েছে তাতে দেখেছি বিখ্যাত কবিতাগুলির ভিতরে কোনো না কোনো গল্প থাকে। ধরুন, রবীন্দ্রনাথ এখন আধুনিক কবিরা তেমন পড়েন না কিন্তু যেটুকু পড়েন তা যেন এক একটি সমাপ্ত-অসমাপ্ত গল্প। ক্যামেলিয়া, সাধারণ মেয়ে, হঠাৎ দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’, বনলতা সেন, বোধ, রূপসী বাংলার পরতে পরতে থোক থোক পুরাণ, গল্প, কিংবদন্তি। ইয়েটস কিংবা এলিয়টে, সেজার ভায়েহো কিংবা নেরুদায় এমনকি, অক্টাভিউ পাজ ও সীমাস হীনিতে লক্ষ করলে দেখবো দীর্ঘ কবিতায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিরই কোনো মুখ চিত্রায়িত করেছেন গল্পাকারে। দুপুর মিত্রের ভৌতিক কবিতাগুচ্ছ মূলত একটি দীর্ঘ কবিতা। এখানে আমার একটি প্রিয় কবিতার কিয়োদংশ তুলে ধরছি-
স্মৃতিরা সাদা কালো হয়
আবছা আলো আর আবছা অন্ধকারের
যে এসব স্মৃতির কাছে যায়
অন্ধকারের একটি কাটা হাত পা ধরে
————————————
না যে
হারিয়ে যাওয়া মানুষটা
অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
তাদেরই পাশে
মাঝে মাঝে শুধু তার স্ত্রীর মনে হয়
অন্ধকারের ভেতর থেকে
কেউ তাকে হাত নেড়ে ডাকে
ভৌতিক কবিতা -২৪
দারুণ কবিতা,এমন কবিতার সমালোচনা আলোচনা লাগে না। ভালো কবিতা, উত্তীর্ণ কবিতা, কালজয়ী কবিতা সকলেরই সমালোচনা আছে। সমালোচনা থাকবে- বিভিন্ন ইন্টারপ্রেটশন যদি না থাকে তবে ঐ কাব্য-কবিতা অনেকটা মৃত।দুপুর মিত্রের ভৌতিক কবিতা পড়তে পড়তে কখনো কখনো গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ এ- আদার ডেমন্ডের’ কথা মনে পড়বে, মনে পড়বে হরর মুভির কথা। দুপুর শিকড়ের খোঁজেই যেন তার বেড়ে ওঠা থেকে যৌবন পর্যন্ত পারিপার্শ্ব বিশেষ করে লোক বিশ্বাস, কিংবদন্তি ব্যবহার করেছেন তেমনি অযথাই মার্কস, গ্রামশি এদের নাম ব্যবহার করেছেন-এটা এক ধরনের উচ্চমন্যতা, যা হীনমন্যতার পরিচায়ক। দুর্বলতা যে নাই তাতো নয়, এখানে সে বিশ্লেষণ করতে বসিনি নতুন অভিজ্ঞতা শেয়ার করাই এই লেখার লক্ষ্য। বিশেষ করে আমি চিত্রকল্পময় কবিতার পূজারি অথচ এখানে তার দরকার হয়নি হয়তো, আমি একটি কবিতার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারপ্রেটেশন খুঁজি, খুঁজি কল্পনার নতুন বিশ্ব। তার অভাববোধ করেছি তবে এর বাইরেও এমন কবিতাও যে লিখিত হতে পারে তার উদাহরণ ভৌতিক কবিতা। সর্বোপরি,দুপুর মিত্রের এমন কবিতার নতুন জগতে পাঠককে স্বাগত।
সমর দেব
‘আর সেই বেদনায় মিশে থাকে নীল বিষ
নীল এই বিষ থেকে লাল রক্তাশ্রু ঝরে
যে মানুষ ফুলের রক্তাশ্রু দেখে
সে মানুষ পাগল হয়ে যায়।‘
এই লাইন পড়লেই সম্যক উপলব্ধি করা যাবে তথাকথিত ‘কবিতা’ লেখেন না তরুণ কবি দুপুর মিত্র। তিনি লেখেন আধুনিক মানুষের গোপন রক্তক্ষরণ। ফলে, তাঁর কবিতায় উঠে আসতে থাকে অন্ধকার রাত,নির্জন পুকুর বা একাকী নদীর জল, শেওড়া গাছের অকরুণ স্তব্ধতা। বাংলা কবিতার অবিরল স্রোতের সঙ্গে মেলে না তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর কবিতার নির্মাণে থাকে না সচতুর দক্ষতার নিপুণ আয়োজন। বরং দুপুরের কবিতায় এক ধরণের নির্লিপ্তি আপাত শান্তজলের গভীরে পাঁকাল মাছের ঘাই মারার মতো। ওপরের জলস্তরে যে শান্তভাব, সেটা নেহাতই উপরিতলের আবরণ মাত্র। তাঁর কবিতার অতল গভীরে লুকিয়ে থাকে মগ্ন চৈতন্যের গোপন তৎপরতা।
‘অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকো
পলক না ফেলে দীর্ঘক্ষণ
দেখবে যে কোনও পুতুলই
জীবন্ত হয়ে ওঠে।‘
এ রকম অজস্র লাইনে মূক এক বোধ যেন কবিকে তাড়া করে ফেরে। তিনি কোনও কবিতাতেই নিজেকে উচ্চকিত করে তোলেন না,সেরকম কোনও চেষ্টাই করেন না। বরং তিনি বোধের গভীরে মগ্ন এক জীবন বিলাসী যেন। সেকারণেই লেখেন-
‘একবার ফ্রেমবন্দি হয়ে গেলে
ফ্রেমবন্দি মানুষটিকে ছবিওয়ালার
কথামতো চলতে হয়
ছবিওয়ালা ফ্রেমবন্দি মানুষদের
দিয়ে তখন অনেক কিছু করায়…’
তাইতো এই নিষ্ঠুর সময়ের নাগরিক মানুষ নিজের হাতে আর নেই নিজে। সে এখন অন্যের পুতুল মাত্র। সে পুতুলের নিজস্ব চেতনার কোনও স্থান নেই। সর্বগ্রাসী এক জাগতিক অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে ক্রীড়নকে পরিণত করেছে,সেখানে ছবিওয়ালার হাতের পুতুলে পরিণত মানুষ নিজস্বতায় হারায়,হারিয়েছে। এই বেদনা ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে দুপুরের কবিতায়। তাঁর কবিতায় খুব গোপনে ছায়া ফেলে তীব্র এক ইতিহাস চেতনা। সেকারণেই-
‘হাজার বছরের পুরনো জিনিসের সাথে
হাজার বছরের মানুষের আত্মারা লুকিয়ে থাকে।‘
হাজার বছর ধরে পথ হাঁটে মানুষ,কে তাকে শান্তি দেবে? জীবনানন্দের ব্যক্তি অভিজ্ঞতার যে সমাজ, ইতিমধ্যেই সেই সমাজ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে, জীবনানন্দ একথা বললেও যেমন শেষ অবধি বেদনার গান গেয়ে গেছেন আমৃত্যু, তেমনই এই কবি এক অস্থিরতার সময়ে দাঁড়িয়ে প্রাচীন আত্মাকে খুঁজে গেছেন। দুপুরের কবিতা আজকের সময়ের এক অসাধারণ শিল্প-দলিল হয়ে উঠেছে। সে কারণেই কি তাঁর কাব্য হয়ে উঠেছে ‘ভৌতিক’? মানুষের আত্মানুসন্ধানে এক মানসযাত্রায় প্ররোচিত করে পাঠককেও।
বছর চারেক আগে চিনেছিলাম এ্ই কবিকে। তাঁর অজস্র কবিতা পড়েছি এই দীর্ঘ সময়জুড়ে। আর প্রতিবারই আবিষ্কার করেছি এক মায়াবী কাব্যপ্রতিভাকে। বিরল তাঁর প্রকাশভঙ্গি, কারও সঙ্গেই মেলে না। কিছু কিছু শব্দকে তিনি ব্রহ্মাস্ত্রের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছেন। বাংলা কাব্যভাষায় বহুদূর তাঁর গন্তব্য, সেটা পরিষ্কার দুপুরের ‘ভৌতিক কবিতা’ গুচ্ছেই।
মেসবা আলম অর্ঘ্য
‘ভৌতিক কবিতা’ বেশ ভৌতিক। ভূতের গল্প, সিনেমার নানাবিধ লক্ষণ, ছবি, অনুসঙ্গ কবিতাগুলির ভিতর ছড়ানো। ফোন থেকে রক্ত নামছে; দুইটা চোখ উদয় হচ্ছে এখানে ওখানে; পুতুল কথা বলছে; কাকতাড়ুয়ার ভিতর কৃষকের আত্মা; কুয়াশা হয়ে ঝরছে লাল রক্ত; অমাবস্যা; রাতের বেলা একটা পোড়ো বাড়ি আলোকিত হয়, উৎসব শুরু হয়, দূর থেকে মনে হয় কারা যেন গান গাচ্ছে বাড়ির ভিতরে, দিনের আলো ফুটলে সব স্বাভাবিক; ডাইনি ঘরে ঢুকে রক্ত খেয়ে যায় নকল প্রেমিকার মতো– এ জাতীয় গা শিরশির করানো উপাদান সাধারণত ভূতের গল্পে পাওয়া যায়, বা ইদানিং সিনেমায় (বিশেষ করে জাপানি হরর থ্রিলার), বাংলা কবিতায় খুব একটা দেখা যায় না।
যাদের ঘরে পুতুল আছে
সেসব ঘরেই প্রতিদিন কেউ না কেউ
মারা যান
যাদের ঘরে পুতুল নেই
কিভাবে যেন একটা দুটা করে পুতুল
তাদের ঘরেও ঢুকে যায়
তারপর সেখানেও মরতে শুরু করে মানুষ
এভাবে সারা শহর পুতুলে ভরে যায়
সারা শহরে মরতে থাকে মানুষ
সারা শহরে জীবন্ত হয়ে ওঠে সমস্ত পুতুল
(ভৌতিক কবিতা -১৪)
কারিগরি ভাষায় বললে, দুপুর মিত্র প্রচলিত ভৌতিক রসকে ওনার সিরিজে একটা সূতা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তবে মনে হয় না ওনার মূল উদ্দেশ্য পাঠকের দাঁত কপাটি লাগিয়ে দেয়া। “পুকুরের মাছ মানুষ খেয়ে ফেলছে”, “সমুদ্র মানুষ খেয়ে ফেলছে”, “একটা কাটা হাত” “স্মৃতির ভেতর টেনে নিচ্ছে”– এমন বহু অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে বরং একটা কাব্যভাষাকে দানা বাঁধতে দেখা যায়।
ধীরেধীরে ছায়াটা মানুষটির
চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে
বড় হতে থাকে
সারাক্ষণ ছায়াটা মানুষটির পেছন
পেছন ঘুরে
তারপর একদিন ছায়াটা মানুষটির
ঘার মটকিয়ে দেয়
মরা মানুষকে রেখে ছায়াটা
মিলিয়ে যায় ধীরেধীরে
(ভৌতিক কবিতা ২৯)
নিতান্ত আনকোরা কবিতা। কাব্যের মূর্ছনা নাই। জটিল উপমা নাই। প্রচলিত ছন্দ, অন্তমিলের অবকাশই নাই। এসবের জায়গা নিয়েছে ভূত, বা মনোবাস্তববাদ (psychological realism)। প্রতীকগুলিকে গল্পের মতো ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে কবিতার কন্টেক্সটের ভিতর।
আধুনিক সমাজের নানা বিষয় চলে আসছে কবিতায়। ‘ফ্রেমবন্দী’ মানুষের কথা, ‘পুতুল’ হয়ে যাওয়া মানুষের কথা, মুখোশধারী মানুষের কথা, লোভের কথা, ঘুমন্ত, নিয়ন্ত্রিত অসহায় মানুষ। আধুনিক সমাজ তো এক অর্থে ‘ভৌতিক’ সমাজই। বিশ্ববাজারের অদৃশ্য রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের মূল্যমান। তাই শ্যাওড়াগাছ আর বাঁশঝাড় থাকলেও এই কবিতার ভূতগুলিকে মামদো শাকচুন্নি বলে মনে হয় না। কখনো মনে হয় ‘ভৌতিক কবিতার’ ভূত হলো সভ্যতা, বিপ্লব, রাজনীতি, রাষ্ট্র, মার্ক্স, বিশ্বায়ন ইত্যাদি। কখনো মনে হয় আরো গভীর কোনো দেখা। অর্থাৎ ভূতের ছদ্মবেশে চলছে কবিতা নির্মাণ এবং লেখকের দার্শনিক অবলোকনের বয়ান।
এই পুরনো প্রাচীন পুকুরে যারাই ডুব দেন
তারাই কোন না কোন শব্দ শুনতে পান
(ভৌতিক কবিতা- ১১)
আশা কি ছেড়ে দিয়েছেন দুপুর? গভীর অন্ধকারে ঢুকে পড়েছেন! যেই অন্ধকারের উৎস হতে আলো উৎসারিত হচ্ছে না আর। উৎসারিত হচ্ছে আলোর রোমান্টিক প্রেতাত্মারা। এবং সব ছেড়ে লেখক,অবধারিত ভাবেই যেন,ঢুকে পড়ছেন নিজের ভিতর।
রাতে কেমন পাল্টে যাই আমি
চোখ লাল হয়ে যায়
গলার স্বর হয় শিশুদের মত
আর প্রচণ্ড জেদি হয়ে উঠি
বুঝতে পারি প্রতিদিন রাতে
আমার ওপর ভর করে কোন শিশুর আত্মা
শিশুটি আমার শরীর খামচাতে
খামচাতে
মেরে ফেলতে চায় আমার বড়ত্বকে
(ভৌতিক কবিতা ৪১)
এক অর্থে,কবিতা লেখকের জন্য একটা জরুরি কাজ তো এটাই- নিজের ভিতরের ‘বড়ত্বকে’ মেরে ফেলা। যুগপৎ বৃদ্ধ এবং শিশু হতে পারা। প্রচলিতকে পাশ কাটিয়ে দুপুর মিত্রর এই কবিতাচর্চাকে সাধুবাদ।
ভৌতিক কবিতা -১
দরোজা খুলতেই সামনে এসে দাঁড়ায়
একটা মেঘ।
হাসতে থাকে। দাঁত থেকে বেরুতে
থাকে লাল রঙের রক্ত।
আবছা মুখ।
একবার মনে হয় চিনি তাকে।
চিনে ফেলার আগেই স্মৃতি হারিয়ে
যায়।
একবার আবিষ্ট হয়ে পড়ি।
মোহময় করে তুলে আমায়।
মুগ্ধের মত আমি কত কিছু ভুলে যাই।
পরক্ষণেই দেখি সে নাই।
কোথাও নাই।
কেবল কানে বাজতে থাকে তার
হাসির শব্দ
আর চোখে ভাসতে থাকে লাল
রক্তের হাসি।
ভৌতিক কবিতা -২
সুনসান নিরব রাত।
চারপাশে বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের উপর টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।
কালো ঘুটঘুটে বৃষ্টি।
বুঝতে পারি না বৃষ্টি আর গরম
কিভাবে এমন রাতে এক হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে।
বিশ্বায়ন গভীর রহস্যময়ী জেনেও
ভয় নিয়ে অলিগলি চেষ্টা করি
বোঝার।
বারবার শুধু মাংসের দোকানে
ঝুলানো গরুর কাটা মাথার কথা মনে
পড়ে।
মনে হয় কাটা মাথাটা আমার দিকেই
তাকিয়েছিল
আর হাসছিল।
কেন আমার দিকে তাকিয়েছিল গরুর
চোখ
আর বৃষ্টির মত ফোটা ফোটা করে ঝড়ে
পড়ছিল রক্ত।
ঘুম নেই আমার।
এত রাতে কার এমন বিড়বিড় কথা
কানে বাজে বারবার।
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকে কিছু একটা বেরুতে
দেখলাম ঘর থেকে।
দেখলাম আমার ঘরের সমস্ত পুতুল
আমার দিকে তাকাতে তাকাতে
নেচে নেচে
এমন গভীর সুনসান রাতে
চলে যাচ্ছে কোথাও।
ভৌতিক কবিতা -৩
শ্মশান ঘাটে নাকি কত জন হারিয়ে
গেছে
কোনওভাবেই কারও খোঁজ মেলে নাই
আর
শ্মশানঘাটে আরো অনেক কিছু ঘটে
কতজন জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে থাকে
কত নারী উলঙ্গ হয়ে নাচে
কত যুবকের লাশ ভরদুপুরে ভেসে ওঠে
শ্মশান ঘটে
আমি তবু সভ্যতার শ্মশানঘাটে এসে
দাঁড়াই সন্ধ্যাবেলায়
গা কেমন শিউরে ওঠে
মনে হয় কে যেন পেছন থেকে ইশারা
দিয়ে চলে যায়
তাকিয়ে দেখি সে নাই
সভ্যতার শ্মশানঘাটে তাহলে সত্যি
কেউ ঘুরে বেড়ায়
কারা এমন ঘুরে বেড়ায়
ইশারায় ডাকে
ডেকে ডেকে কি চায়
আমি সাহস করে তবু দাঁড়াই
চারপাশে থাকে আমার সতর্ক
নজরদারি
একদিন সত্যি এক নারী আমাকে
ডেকেছে
শ্মশানঘাটে যাওয়ার রাস্তায়
দাঁড়িয়ে ছিল সে
সেখানে যেতেই তাকে দেখা গেল
একেবারে ঘাটের কিনারে
তারপর কিছুই আর আমার জানা নাই
আমি নাকি ভেসে ছিলাম শ্মশান
ঘাটের জলে
আমি কি ডুবেছিলাম আরও কোনো
অতল তলে
কে তবে ডুবাল আমায়
সভ্যতার শ্মশান ঘাটে কে এই মোহময়ী
নারী
কারা ছলে করে যুবকদের ডুবিয়ে দেয়
ঘাটের জলে
জানা নেই
শুধু প্রতিরাতে এখন কোথাও
তাকালেই দেখি
সেই নারী আমাকে দেখে হাসছে
ভৌতিক কবিতা -৪
শেষ রাতের ট্রেনেই আমাকে
ফিরতে হবে বাসায়
গ্রামের বাড়ি
যেখানে আমার শেকড়
সেই শেকড় থেকে ডালপালা গজাতে
গজাতে কয়েকজন শহরে এসে ঠেকেছি
শেষ রাতের ট্রেন গভীর রাতের মতই
থমথমে
স্টেশন দোকান সবকিছু অজানা
অচেনা হয়ে যায়
ওদের হাসিও কেমন পাল্টাতে থাকে
একজন আমাকে দেখে কাছে এসে
বেঞ্চে বসলেন
স্টেশনে কাউকে কাউকে দেখা
যাচ্ছে
চা বিক্রেতা, দোকানদার
আমার পরিচিত কাউকেও বোধহয়
দেখেছি মনে হল
ট্রেন যাওয়া আসার শব্দের ভেতর
আমরা বেশ কজন বিপ্লব, রাজনীতির ভূত,
রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূত নিয়ে আলাপ
করেছিলাম
আলাপ করতে করতে ব্যাগ থেকে
মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল বই খুলে
চোখ বুলাতে শুরু করেছিলাম
হঠাৎ খেয়াল করলাম
আমি যে স্টেশনে বসে আছি
সেখানে একটিই বেঞ্চ
না কোন স্টেশন ঘর আছে
না কোনও দোকান আছে
না আসে এখানে ট্রেন
তাহলে এ স্টেশন ঘর নয়
দীর্ঘদিন আগের ছাই হয়ে যাওয়া ঘর
এখানে কোনও লোকই আসে না
যাদের সাথে আমি সারারাত বিপ্লব
নিয়ে কথা বললাম
তারা তবে কে ছিল?
তারা কি আদৌ কেউ ছিল
ডাস ক্যাপিটাল পড়ার সময়
কেন তারা লুকিয়ে গেল?
দেখলাম একটু দূরে
কয়লার ইঞ্জিনে চলা একটি ট্রেনে
হাসতে হাসতে উঠলেন মার্কস।
ভৌতিক কবিতা -৫
আমি জানি অশরীরি কিছু একটা আছে
ঘুমের ভেতর ডেকে নিয়ে যায়
নদীর পাড়, শ্মশান ঘাট, প্রাচীন পুরনো
বাড়ি, মন্দির
ঘুরে ঘুরে দেখায়
অশরীরি আমাকে নিয়ে সারারাত
কত কি যে করে
গল্প তার আর শেষ হয় না
আমার গলা শুকিয়ে যায়
আমি অশরীরের সাথে দৌঁড়াতে
দৌঁড়াতে ক্লান্ত হয়ে যাই
ভয় লাগে
তবু মোহ কাটে না
ঘুমের ভেতর আর ঘরে থাকি না
প্রতিদিন অশরীরি একটি ক্রোধ এসে
নিয়ে যায় আমায়
ঘরে পড়ে থাকে নিথর দেহ
ভৌতিক কবিতা -৬
যে কোনো বনেরই আছে এক জীবন্ত
আত্মা
এই বন একবার যাকে দেখে
তাকে আর কোথাও যেতে দেয় না
দিন রাত গোঙায়
মাঝে মাঝে মনে হবে একটা লাল
চোখ
ঘুরে ঘুরে দেখছে তোমায়
নিঁখুত প্রকৃতি
পাখি, ঝর্ণা আর পাতার শব্দ এখানে
একাকার
এক হয়ে থাকে
বনের তীব্র জংলি গন্ধ আর নৈঃশব্দ
সীমাহীন শূন্যতার
কেউ যায় না ফিরে
অথবা সবাই হারিয়ে যায়
অন্য কোনও গন্ধ টের পেলেই জেগে
ওঠে বন
উৎসবে নাচতে থাকে বুনো ফুল, গাছ-
পালা, ঝর্ণার জল
অথবা রহস্যময় জংলি গন্ধে
প্রানহীন ঢলে পড়ে সবাই
তারপর কেউ আর যায় না ফিরে
পড়ে থাকে মরে থাকে
প্রকৃতির কুলে
ভৌতিক কবিতা -৭
রাস্তায় যে দর্শনের রাজকুমারী মরে
পড়েছিল
আমি তার আঙ্গুল কেটে হীরের
আংটি এনেছিলাম ঘরে
এমন দর্শন আগে আর দেখি নাই আমি
যে দর্শনের রাজকুমারী সন্ধ্যায় মরে
পড়ে থাকে রাস্তার ধারে
ঝড় জলের সন্ধ্যায় রাস্তায় মরে
পড়েছিল সেই কুমারী
সন্ধ্যার অন্ধকারে এখানেই আমি
দেখেছিলাম আলো
এক অদ্ভুত মায়াবী আলো ঘিরে
রেখেছিল কুমারীকে
হীরের আংটি কোনোভাবেই
যাচ্ছিল না খোলা
তাই আংটিসহ আঙ্গুল কেটে
পকেটে পুড়ে
কোনোদিকে না তাকিয়ে
ঘরের ভেতর চলে এসেছিলাম এক
দৌঁড়ে
তারপর কেটে গেছে অনেকদিন
এমনই এক ঝড় জলের সন্ধ্যায়
এমনই এক দর্শনের রাজকুমারী হাজির
হয়েছিল বাসায়
সারা শরীর ভেজা ছিল বৃষ্টিতে
সেদিনের সন্ধ্যার মত
শরীর থেকে বের হচ্ছিল মায়াবী
আলোর আভা
আর তার কণ্ঠ ছিল কোমল পেলব
কেমন একটা মাদকতা ছিল
দর্শনের রাজকুমারীকে আমি
পিড়িতে বসতে দিলাম
বৃষ্টির জল মোছার তোয়ালে দিলাম
হঠাৎ দেখলাম
হীরের আংটিসহ কাটা আঙ্গুলটি যে
সিন্ধুকে রাখা ছিল
সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত
ভৌতিক কবিতা -৮
ভাঙা ভাঙা ঘুম হলেই সে জেগে
ওঠে
গোঙায়
দূর থেকে এক চিকন সুরের কান্না
ভেসে আসে
দূরে একটা সাদা রঙের স্মৃতি
দাঁড়িয়ে থাকে
হাসে
কেমন একটা বাতাস বয়ে যায়
আর ডাকতে থাকে
ভাঙা ভাঙা ঘুম হলে
সারা শহর স্মৃতিতে ভরে যায়
হাসতে থাকে
খেলতে থাকে
লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে থাকে
এ ভবন থেকে আরেক ভবন
তারপর শহরে কোন মানুষ থাকে না
ভাঙা ভাঙা ঘুম হলে
এ শহর স্মৃতিতে ভরে যায়
ভৌতিক কবিতা -৯
গভীর রাতে নদীর ধারে কেউ যায় না
কেননা গভীর রাতে নদীর ধারে
কাউকে পেলেই
জেগে ওঠে এ নদী
পেছন থেকে ডাকতে থাকে
তারপর লাল হয়ে যায় নদীর জল
গভীর রাতে নদীর ধারে কিছুই থাকে
না
গরু ছাগলের রক্ত আর হাড়গোড় ছাড়া
কিছুই থাকে না সেখানে
অনেক রাতে
ঘুমের ভেতর নদীর দিকে হাঁটতে
থাকে
এ গায়ের মানুষ
তারপর আর পাওয়া যায় না তাকে
ভৌতিক কবিতা – ১০
ছোটবেলায় বড়শিতে পুঁটি মাছ গেথে
আমি একটি বড় মাছ ধরেছিলাম
মাছটি ডাঙায় তোলার পর
দেখেছিলাম
মাছটির চোখ মানুষের চোখের মত
মাছটি তাড়াতাড়ি ছেড়ে
দিয়েছিলাম পুকৃুরে
এরপর থেকে আমি ঘুমুতে পারতাম না
চোখ বুজলেই ভেসে ওঠত
মানুষের চোখওয়ালা সেই মাছ
মাছ খাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় আমার
আমি কোনো মাছের বাজারে যাই
না
এমনকি কোনো মাছের দিকেও
তাকাতে পারি না আমি
কেবল চোখে ভেসে ওঠে
ছোটবেলায় দেখা মানুষের
চোখওয়ালা সেই বড় মাছ
ভৌতিক কবিতা- ১১
এই পুরনো প্রাচীন পুকুরে যারাই ডুব দেন
তারাই কোন না কোন শব্দ শুনতে পান
গান অথবা নারী কণ্ঠ
হাসি অথবা গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ
ডুব দেওয়া মাত্রই
কানে বাজে
হয় কোনো নূপুর
অথবা কোনো বাচ্চা মেয়ের হাসি
এই পুকুরে
দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে ডুব দেন সবাই
যেন কোন শব্দ আর না আসে কানে
যেন কোন কান্না-হাহাকার আর না
ছোঁয় শরীর
অমাবস্যার দিন
কিছুক্ষণ পরপর পুকুরে ভেসে ওঠে
ডুব দেওয়া মানুষের মুখ
অমাবস্যার দিন সারা পুকুরে জেগে
ওঠে
লাল নীল জ্যোনাকীর দুখ
ভৌতিক কবিতা -১২
লোকটা প্রতিরাতে ঘুমের ভেতরে
দরজা খুলে বাইরে বেরুত
তারপর হাঁটতে হাঁটতে ব্যাংকের
কাছে যেত
কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করত ব্যাংকের
সামনে
তার ঘেউ ঘেউ শব্দে আশেপাশের
কুকুরের জমা হত ব্যাংকের সামনে
তারপর আবারও ঘুমের ভেতর হাঁটতে
হাঁটতে ঘরে ফিরত লোকটা
দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ত
সকালে ঘুম থেকে উঠলে
এসবের কিছুই তার মনে থাকত না
কেবল সারা শরীরে কোন এক প্রানীর
আঁচড় দেখতে পেত
ভৌতিক কবিতা -১৩
অনেক রাতে
বাঁশঝাড়ের বন থেকে কান্নার সুর
ভেসে আসে
কান্নারা একা একা বড় হতে থাকে
সেখানে
সুর আরও গভীর হয়
মানুষ কান্নার সুরের মোহেও পড়ে
গভীর মনোযোগ দিয়ে
কোনও কোনও কান্না শুনে মানুষ
যে বাঁশঝাড়ের বন থেকে কান্নার সুর
ভেসে আসে
আমাকে না কি মা সেখানেই
কুঁড়িয়ে পেয়েছিলেন
ভৌতিক কবিতা ১৪
যাদের ঘরে পুতুল আছে
সেসব ঘরেই প্রতিদিন কেউ না কেউ
মারা যান
যাদের ঘরে পুতুল নেই
কিভাবে যেন একটা দুটা করে পুতুল
তাদের ঘরেও ঢুকে যায়
তারপর সেখানেও মরতে শুরু করে মানুষ
এভাবে সারা শহর পুতুলে ভরে যায়
সারা শহরে মরতে থাকে মানুষ
সারা শহরে জীবন্ত হয়ে ওঠে সমস্ত পুতুল
ভৌতিক কবিতা ১৫
এরকম নির্জন বৃষ্টির সন্ধ্যা বেলায়
একবার এক সুন্দর মেয়ে এসে
ঢুকে পড়েছিল আমার বাসায়
তার তাকানো এমন ছিল
মনে হত অনেকদিন ধরে তাকে চিনি
এমন করে কথা বলত
মনে হত
সারা জীবন ও আমার সাথেই থাকুক
এভাবে কথা বলুক
ও এমন ভাবে হাসত
মনে হত তার মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকতে থাকতে
যেন আমার মৃত্যু হয়
সে ছিল গ্রামসীর মেয়ে
আমি তাকে থাকতে দিয়েছিলাম
বলেছিলাম একান্তই প্রয়োজন না হলে
থেকে যেতে পার এখানে
অনেক রাতে আমার ঘরের দরজায় শব্দ
করে উঠল কেউ
দেখলাম মেয়েটির হাত পা শুকনো
কাঠির মত লম্বা
হাত আর পা আমাকে দেখা মাত্র বড়
হচ্ছিল
মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে
আসছিল
মেয়েটি আমাকে খেয়ে ফেলতে
চায়
আদ্যোপান্ত খেয়ে ফেলতে চায়
মেয়েটি
আমি জানি না
মেয়েটি আমাকে খেতে পেরেছিল
কিনা
শুনেছি টানা দুই তিন দিন বেহুশ
পরেছিলাম সেই বাড়িতে
ভৌতিক কবিতা ১৬
কেউ জানে না
কেন আয়নার সামনে দাড়ালেই মরে
যায় মানুষ
একজন দুজন নয়
আয়নার সামনে যারাই দাড়ান
মরে যান সবাই
তাহলে কি আয়নায় এমন কিছু আছে
যা মানুষকে মেরে ফেলে
হয়ত এমন কিছুই নয়
প্রতিদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে
যে খারাপ মানুষকে আড়াল করে
সেজেগুজে বের হয় মানুষ
সেই আড়াল করা খারাপ মানুষগুলোই
হয়ত
হত্যা করে মানুষকে
এর কোন সত্যতা নেই
প্রমান নেই এর কোনো
শুধু এইই ঠিক যে
আয়নার সামনে দাড়ালেই
মরে যায় এখন মানুষ
ভৌতিক কবিতা ১৭
যে ফুল অন্ধকারে ফোটে
তার পরনে থাকে সাদা রঙের শাড়ি
সারারাত সে তীব্র গন্ধ ছড়ায়
সেই গন্ধের নিচে শুয়ে থাকে সাপ
এমন ভাবে শুয়ে থাকে
যেন সাদা শাড়ি পড়া ফুলকে
সারারাত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে সে
কেউ তীব্র গন্ধের মোহে
সাদা শাড়ি পড়া ফুলের কাছে
গেলেই
ছোবল দিয়ে ওঠে সাপ
মরে পড়ে থাকে সে
ভৌতিক কবিতা ১৮
রাত গভীর হলেই
যখন চারদিকে নিরব নেমে আসে
তখন পুরনো বাড়িটি আলোকিত হয়ে
ওঠে
পুরনো বাড়িটি
আগের মতো সুন্দর রঙচঙা হয়ে ওঠে
দূর থেকে মনে হয়
কারা যেন ভেতরে গান গায়
ডাইনিং এ বসে কারা যেন খাওয়া
দাওয়া
আর গল্পগুজব করে
সারা বাড়ি কেমন উৎসবে মেতে
ওঠে
সূর্যের আলো আসার একটু আগে
বাড়িটি আবারও শ্যাওলা জমা
রঙহীন পোড়া বাড়ি হয়ে যায় ।
কোনো কোনো বাড়ি এখনো তাহলে
অন্ধকার আর নিরবতার মানে বোঝে
ভৌতিক কবিতা ১৯
হারুনের স্ত্রী কম কথা বলেন
হারুন সারাদিন খেটেখুটে ঘরে আসে
তার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখেন
স্ত্রী
শুধু হারুনের মুখে হাসি ফোটে না
কারও তেমন কোনো কথা হয় না
হারুনের স্ত্রী কখনো বাইরে বের হন
না
পাড়া প্রতিবেশির সাথেও কথা হয়
না তার
কেউ কখনো তাকে কথা বলতেও
দেখেনি
শুধু কেউ কেউ কিছু অদ্ভুত ঘটনা
দেখেছে তার
একদিন তার পায়ের ছাপ উল্টো
দেখেছিল একজন
একদিন তার হাত অস্বাভাবিক লম্বা
দেখেছিল
একদিন এক শিশু তার চোখ অসম্ভব লাল
দেখে
ঘরে পড়েছিল জ্বরে
গুঞ্জন ছিল
কেউ সাহস করেনি বলতে
অথচ জানত সবাই
এমন কি হারুনও
যে তার স্ত্রী বেঁচে নাই আর
ভৌতিক কবিতা ২০
খুব ভোরে মাংসের দোকানে গিয়ে
দেখি
মাংস বিক্রি করছেন নিটশে
ফ্রেডরিখ নিটশে আমাকে দেখে
হাসছেন
পানের পিক রক্তের মত লেগে আছে
দাঁতে তার
কেমন ভয়ঙ্কর আর উদ্ভট হাসি
সে আমার কাছে গরুর মাথা বিক্রি
করতে চেয়েছিল
আমি তা না কিনেই দ্রুত চলে আসি
এরপর ফ্রিজ খুললেই দেখি গরুর কাটা
মাথা
তাকিয়ে আছে আমার দিকে
রাস্তায় হাঁটতেই দেখি গরুর কাটা
মাথা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে
ঘুমুতে গেলেই দেখি আমার বিছানায়
গরুর কাটা মাথা
আর রক্তে ভেজা চাদর
নিটশের রক্তিম হাসি আর গরুর কাটা
মাথার মাঝে
প্রতিদিন খুব ভোরে ফুটছে
একটি করে রক্তজবা
ভৌতিক কবিতা ২১
লোকটা বিছানায় ঘুমুতে যান না
বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লে
চাদর একা একা জড়িয়ে যায়
ঘুমের ভেতর কোনো রকম সে ফাস
থেকে
বেরিয়ে আসে
লোকটা মেঝেতে শুয়ে থাকেন
যাতে কোনো চাদর তাকে না মেরে
ফেলতে পারে
লোকটা একা একা মেঝেতে ঘুমিয়ে
থাকেন
একদিন ঘুমের ভেতর নিজেই নিজের
হাত দিয়ে
গলা টিপে মেরে ফেলেন নিজেকে
মুখে থাকে তার অদ্ভুত রহস্যের হাসি
ভৌতিক কবিতা ২২
আমি জানতাম
গভীর রাতে এলোচুলে কোনো নারী
এলে ঘরে ঢুকতে দেওয়া বারণ
আমি জানতাম সে আমার প্রেমিকা
নয়
কিন্তু এমনই সম্মোহন আর এতটা
চেহারার মিল
আমার যেন কিছুই ছিল না করার
এত রাতে আমার ঘরে আমার
প্রেমিকা
এলোচুলে এভাবে আসবে
বিশ্বাসযোগ্য ছিল না কখনোই
তবু আমি বসতে দিয়েছি তাকে ঘরে
এতটা অদ্ভুত মিল চেহারার
মনে হয় আমার প্রেমিকাই তো
সে কামুক কণ্ঠে আমাকে ফ্র্রয়েডের
কথা বলছিল
আর আমার নিঃশ্বাস বড় হচ্ছিল
সে বলেছিল আমার বুক সমুদ্রের মতো
এখানে সে ডুবে গিয়েছিল
সে বলেছিল আমার ঠোঁট কচি পাতার
মত
একটানে মুখের পুরো মাংস টেনে
খেয়ে ফেলেছিল
বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার
হাত
একটানে বের করে ফেলেছিল হৃদপিণ্ড
আমার
ফ্র্রয়েড ফ্র্রয়েড বলে চিৎকার করতে
করতে
আমার হৃদপিণ্ড হাতে নিয়ে মিলিয়ে
গিয়েছিল সে অন্ধকারে
ভৌতিক কবিতা ২৩
যে সমস্ত বিপ্লবের অপমৃত্যু হয়
তারা আবার ফিরে আসে
যারা তাকে মেরেছিল
তাদের একে একে সে মেরে ফেলে
পৃথিবীতে এসে
বিপ্লবের আত্মা রাত বিরাতে ঘুরে
বেড়ায়
সকালে বড় রাস্তায় দেখা যায়
মানুষের ভিড়
মরে পড়ে থাকা কোনও লাশকে
ঘিরে
কেউ জানে না
এভাবে কে প্রতিদিন মানুষ মেরে
ফেলে রেখে যায় রাস্তায়
কে এমন বিকৃত করে মারে
সমস্ত শরীরটাই থ্যাতলে দিয়ে যায়
মনে হয় সমস্ত শরীরের মাংস
কে যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে
সারারাত
ভৌতিক কবিতা ২৪
স্মৃতিরা সাদা কালো হয়
আবছা আলো আর আবছা অন্ধকারের
যে এসব স্মৃতির কাছে যায়
অন্ধকারের একটি কাটা হাত পা ধরে
হেচকা টান দেয় তার
পা ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে
যায়
অন্ধকার স্মৃতির ভিতর
তারপর পৃথিবীতে আর পাওয়া যায় না
তাকে
বাস্তব হয়ে ফিরে আসে না সে আর
আসতে সে পারে না
কখনো কখনো অন্ধকার হয়ে শুধু
তাকিয়ে থাকে
স্ত্রী আর সন্তানদের মুখের দিকে
কিছু একটা বলতে তো চায়ই সে
স্ত্রী আর সন্তানেরা কখনোই জানে
না যে
হারিয়ে যাওয়া মানুষটা
অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
তাদেরই পাশে
মাঝেমাঝে শুধু তার স্ত্রীর মনে হয়
অন্ধকারের ভেতর থেকে
কেউ তাকে হাত নেড়ে ডাকে
ভৌতিক কবিতা ২৫
এ শহরের মানুষেরা গভীর অমাবস্যা
রাতে ঘর থেকে বের হয়
কোনো বাড়িতে সেদিন বিদ্যুৎ
জ্বলে না
অনেক অন্ধকারের ভেতর শহরের সব
মানুষ
ঘর থেকে বের হয়
তারপর তারা একমনে হাঁটতে থাকে
কেউ কথা বলে না কারও সাথে
কেউ হাসে না
কেবল হাঁটতেই থাকে
তারপর তারা হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের
কাছে যায়
সমুদ্র পছন্দমত কিছৃ মানুষ খেয়ে নেয়
মানুষ খেয়ে সমুদ্রের পেট ভরলে
বাকিরা হাঁটতে হাঁটতে আবার ঘরে
ফিরে আসে
তারপর তারা
অপেক্ষা করে আরেক অমাবস্যার জন্য
ভৌতিক কবিতা ২৬
আমরা জানতাম কোম্পানির একটা আলাদা ভাষা আছে
ওর একটা অদ্ভুত সম্মোহন শক্তি আছে
ও প্রথমে ঘরের মেয়েদের আকৃষ্ট করে
মেয়েদের ঘর থেকে বের করে রাক্ষসী বানায়
ওরা মানুষের রক্ত চুষে
যেসব মেয়েরা রাক্ষসী হয়ে যায়
তারা আর ঘরে ফেরে না
কোম্পানির সাথে রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ায়
ঘরের মানুষকেও রাক্ষস বানিয়ে ফেলে সে
ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম কোম্পানি নিয়ে নেয়
ধীরেধীরে পুরো গ্রাম হয়ে ওঠে
রাক্ষস খোক্কশের গ্রাম
ভৌতিক কবিতা ২৭
আমি শুনেছি
ইতিহাসের প্রেতাত্মারা আমাদের
ঘরে
বিড়াল হয়ে ঢোকে
আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে
সময় সুযোগ মত আমাদের নরম বিছানায়
শুয়ে থাকে
মাছ মাংসের ঘ্রাণে
ইতিহাসের প্রেতাত্মারা আমাদের
ঘরে ঢোকে
তারপর চোরের মত পালিয়ে যায়
সেসব খেয়ে
একবার মনে হয় আমি তো চিনি এই
বিড়াল
কার মত যেন মুখ
মনে হয় না আর
ইতিহাসের প্রেতাত্মারা আজো
মাংসের লোভে ঘুরে বেড়ায়
আমাদের আশেপাশে
ভৌতিক কবিতা ২৮
ভরদুপুরে এই নদীর দিকে তাকান না
কেউ
ভরদুপুরে এই শান্ত স্থির নদী জেগে
ওঠে
যেই তাকায়
মোহাবিষ্ট করে ফেলে সে
তারপর নদীর দিকে এগুতে থাকে
যারা একা একা থাকে
তাদের শক্তি হয়ে ওঠে রহস্যময়
নদীটিও তাই
কাউকে পছন্দ হলেই তাকে নিয়ে
খেলতে শুরু করে দেয় সে
অদ্ভুত ভয়ঙ্কর খেলা
ভরদুপুরে নদীর নজরে পড়ে যে
নদী ছেড়ে কখনো ঘরে ফেরে না সে
হয় না সংসার
উদভ্রান্ত পাগলের মতো নদীতেই
জীবন কাটায় তার
ভৌতিক কবিতা ২৯
ধীরেধীরে ছায়াটা মানুষটির
চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে
বড় হতে থাকে
সারাক্ষণ ছায়াটা মানুষটির পেছন
পেছন ঘুরে
তারপর একদিন ছায়াটা মানুষটির
ঘার মটকিয়ে দেয়
মরা মানুষকে রেখে ছায়াটা
মিলিয়ে যায় ধীরেধীরে
ভৌতিক কবিতা ৩০
পুকুরটা অনেক প্রাচীন
অনেক গভীর
কেউ মাছও মারেন না
এত মাছ যে
মাছের গানও এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়
এই পুকুরের আশেপাশে কোন মানুষ
থাকে না
গ্রামের মানুষের বিশ্বাস
এই পুকুরের মাছ অনেক রাতে হাঁটতে
পারে
পুকুরের আশেপাশে যে মানুষকে পায়
তাকে নিয়ে ডুব দেয় পুকুরের গভীরে
যে মানুষ একবার জলের রাজ্যে যায়
ডাঙার রাজ্যে আসে না ফিরে আর
ভৌতিক কবিতা ৩১
গভীর রাতে জিজ্যাকের বই খুললেই
কে যেন ডেকে ওঠত
গম্ভীর গলায় কে যেন ডেকে ডেকে
বলত
আয় আয়
আমি ঘরের চারপাশ দেখতাম
খুঁজে পেতাম না কাউকে
আবার বই খুললে আবারও শব্দ শুনতে
পেতাম
আয় আয়
আমি ঘরের বাইরে ভাল করে দেখতাম
খুঁজে পেতাম না কাউকে
এরপর আবারও বই খুললে শব্দ পেতাম
তেমন
এজন্য এখন আর জিজ্যাকের বইই পড়ি না
সাজানো থাকে তাকে
বেশ ভালই দেখায় এখন
ভৌতিক কবিতা ৩২
যে গাছ মানুষের মত দেখতে
বা যে গাছের ডাল পালা লতা
মিলে এমন দেখায়
যেন মানুষ
সে গাছের পাশে
জঙ্গলের ভেতর থাকে অন্য একটি জগৎ
সেই জগতে থাকে গাছের মত দেখতে
অন্য রকমের মানুষ
যারা গাছকে সম্মান করে না
তাদের নিয়ে যায় গহীন জঙ্গলের
ভেতর
তারপর ধীরেধীরে রক্ত শুষে নিয়ে
বড় হতে থাকে তারা
ভৌতিক কবিতা ৩৩
চারপাশে কারা যেন লাল চোখে
তাকিয়ে থাকে
তীব্র চোখে অনুসরণ করে আমায়
গাছের পাতার ভেতরে দেখি একবার
লাল চোখ
তারপর মিলিয়ে যায় আবার
একবার দেয়ালের ভেতর থেকে
ভেসে ওঠতে দেখেছি
একজোড়া লাল চোখ
তারপর মিলিয়ে গেছে তারা
আমি খুব সন্তর্পণে লাল চোখ এড়িয়ে
ঢুকে পড়ি ঘরে
ঘরের আলনায় এসে দেখি কাপড়ের
বদলে
ঝুলছে একটি করে কাটা হাত
সমস্ত দেয়াল জুড়ে দেয়া লাল রক্তের
হাতের ছাপ
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়
বিছানা ফুলে ওঠল লাল রক্তে
হাসতে হাসতে কারা যেন
তুলে নিল আমাকে বিছানা থেকে
বিছানায় পড়ে রইল আরেক আমি
ভৌতিক কবিতা ৩৪
সারারাত টুপটাপ কুয়াশা পড়ে
সারারাত লাল রক্তের কুয়াশা পড়ে
সমস্ত পৃথিবী জেগে ওঠে আবার
প্রান ফিরে পায়
মনে হয় লাল রক্তের অপেক্ষাতেই ছিল
পুরোটা পৃথিবী
ধীরেধীরে গভীর নির্জন কুয়াশা
রাতে
সবুজ শ্যামল চেনা পৃথিবীই
হয়ে উঠে অচেনা রক্ত পিপাসু পৃথিবী
ভৌতিক কবিতা ৩৫
হাজার বছরের পুরুনো এই পুকুরে
যাদের চেহারা যেদিন ভেসে ওঠে
তারাই অনেক রাতে সেদিন হারিয়ে
যায়
কোনোভাবেই ঠেকানো যায় না এই
হারানো
মানুষের ধারনা তারা হাঁটতে
হাঁটতে পুকুরের নিচে চলে যায়
ফিরে আসে না কখনো
কেবল কেউ কেউ অনেক রাতে
হারিয়ে যাওয়া মানুষদের দেখেছেন
শুকনো ক্ষেতে অনবরত সেচ দিতে
ভৌতিক কবিতা ৩৬
একটা অদ্ভুত নম্বর থেকে কল আসে
একটা অদ্ভুত শব্দ হয় মোবাইলে
তারপর মোবাইল থেকে ফিনকি দিয়ে
পড়ে রক্ত
গভীর রাতে কেউ কল করে
সারারাত কথা বলে মেয়েটি
তারপর মেয়েটিকে গিলে খায়
মোবাইল
গভীর রাতে কেউ কল করে
সারারাত মোবাইলে হাসে
ছেলেটি
তারপর মোবাইলটি গিলে খায়
ছেলেটিকে
একদিন ধীরেধীরে পুরো পরিবারকে
খায়
তারপর সেই ঘর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে
থাকে
শুধু অনেক রাতে বেজে ওঠে মোবাইল
সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে রক্ত
ভৌতিক কবিতা ৩৭
ছোটবেলায় যে পুতুলবউকে নিয়ে
খেলতাম
সে হারিয়ে গেছে
সেই পুতুলবউ আমার সাথে কথা বলত
রান্নাবাড়া খেলত
এখন বড় বেলায় সেই পুতুলবউয়ের কথা
মনে পড়লে
বিস্মিত হই
পুতুলবউ সত্যিকার অর্থেই কিভাবে
কথা বলত আমার সাথে
কেউই বিশ্বাস করবে না
কিন্তু সত্যি এইই
পুতুলবউ সত্যি সত্যি কথা বলত আমার
সাথে
ভৌতিক কবিতা ৩৮
প্রেম আর ছলা কলার মধ্যে পার্থক্য
আছে
যে এই পার্থক্য ধরতে পারে না
তার ঘরে এসে ঢুকে পড়ে ডাইনি
মনে হয় প্রেমিকা
আদর করতে করতে তোমার ঠোঁটে ঠোঁট
মেশাবে
আসলে ডাইনি
ধীরেধীরে তোমার ঘাড়ের কাছে
মুখ এনে
কামড় বসাবে
তারপর সারারাত রক্ত চুষে চলে যাবে
অন্য কারও ঘরে
ভৌতিক কবিতা ৩৯
যে কৃষক আত্মহত্যা করে
সেই কৃষকের আত্মা ভর করে
কাকতাড়ুয়ায়
দিনের বেলা সে ক্ষেত পাহাড়া
দেয়
রাতের বেলা সে জীবন্ত হয়ে উঠে
একে একে প্রতিশোধ নেয়
একে একে হত্যা করে তাদের
যারা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী
এইসব মৃত্যুর রহস্য জানে না কেউ
কেবল কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকালে
ভয় লাগে
মনে হয় আমিও তার শত্রু
কেবল খেয়ে গেছি ফসল তার
কাকতাড়ুয়ার চোখের দিকে
তাকালেই মনে হয়
সে জীবন্ত
লাল চোখে খুঁজছে প্রতিশোধ
ভৌতিক কবিতা ৪০
অনেক রাতে এই পুকুরে বেশ বড় বড় শব্দ
শোনা যায়
কেউ বলেন এটা মানুষের ঝাপটানোর
শব্দ
কিন্তু এত রাতে পুকুরে কোনো
মানুষের
ঝাপটানোর কথা না
কেউ বলেন এটা বড় শোল মাছ হবে
কিন্তু শোল মাছ ঝাপটালে এত শব্দ হয়
না
কেউ বলেন এটা কোনো অমঙ্গলের শব্দ
কিন্তু কিসের জন্য কার অমঙ্গল কেউ
ধরতে পারেন না
একদিন সারারাত আলোকিত করে
রাখা হল পুকৃুর
কিন্তু কাকে দেখা যাবে সেই রাতে
শব্দই হল না কোনো
পরদিন গ্রামের সব মানুষ স্বপ্ন দেখল
বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়ে আসা
মেয়েটিকে
যে আত্মহত্যা করেছিল পুকুরে ডুবে
ভৌতিক কবিতা ৪১
রাতে কেমন পাল্টে যাই আমি
চোখ লাল হয়ে যায়
গলার স্বর হয় শিশুদের মত
আর প্রচণ্ড জেদি হয়ে উঠি
বুঝতে পারি প্রতিদিন রাতে
আমার ওপর ভর করে কোন শিশুর আত্মা
শিশুটি আমার শরীর খামচাতে
খামচাতে
মেরে ফেলতে চায় আমার বড়ত্বকে
ভৌতিক কবিতা ৪২
কালো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
শ্যাঁওড়া গাছ
সবুজ পাতারা প্রাণপনে চেষ্টা করে
যায়
তবু কালো শরীর তার ঢাকা পড়ে না
শ্যাঁওড়া গাছ থেকে ভূতটিকে আর
সরানো যায় না
শুধু সবুজ ভেদ করে ভূতের মত এসে
দাঁড়িয়ে থাকে তার কালো শরীর
ভৌতিক কবিতা ৪৩
সারারাত গাড়িরা কোঁকায়
ছাদে গোঙানোর শব্দ
আর ধপাধপ টিনের চালে আওয়াজ
সবাই দরোজা জানালা বন্ধ করে দেয়
বন্ধ করে দেয় ঘরের আলো
সারারাত সরকারি লোকেদের
আত্মারা ঘুরে
সারারাত খোঁজে রক্ত
কোথাও মানুষের গন্ধ পেলেই হামলা
করে তারা
রক্ত চুষে চুষে বড় হয় সরকারি
কোষাগার
ভৌতিক কবিতা ৪৪
এ শহরে কোনো মানুষ নেই
এ শহরে মানুষ থাকে না কখনো
এ শহরে কোনো মানুষ এলেই
রক্তের গন্ধে নেচে ওঠে সবাই
সবাই মিলে কামড়াতে থাকে
মানুষকে
দাঁত থেকে বিষ মানুষের রক্তে
গেলেই
ওই মানুষটাও আর মানুষ থাকে না
হয়ে উঠে মানুষ খেকো মানুষ
ভৌতিক কবিতা ৪৫
লোকটা প্রতিদিন পুতুল কেনে
নানান রকম বাহারি পুতুল
লোকটার ঘর ভর্তি পুতুল
আর কেউ নেই
লোকটা একা একা
পুতুুলদের সাথে থাকে
পুতুৃলদের ভাত খাওয়ায়
গান শোনায়
পুতুলদের সাথে কথা বলে
লোকটা টের পায় না যে
সে নিজেও পুতুল হয়ে গেছে
ভৌতিক কবিতা ৪৬
প্রতিরাতে ঘুমের ঘোরে কারওনাম
ধরে
নাকি চিৎকার করে উঠি
সারাঘর পায়চারি করি
ঘর্মাক্ত শরীরে ক্লান্ত হয়ে
আবার নাকি ঘুমিয়ে পড়ি বিছানায়
প্রতিরাতে কার ভালবাসা ভর করে
আমায়
কে আমাকে ঘুমের ভেতর থেকে
টেনে এনে
তার কথা ভাবায়
কিছুই টের পাই না আমি
কিছুই মনে থাকে না আমার
ভৌতিক কবিতা ৪৭
হাজার বছরের পুরুনো জিনিসের
সাথে
হাজার বছরের মানুষের আত্মাও
লুকিয়ে থাকে
তাই পুরুনো কোনোকিছু আমি সযত্নে
রাখি
পুরুনো বিষয় আমি বোঝার চেষ্টা করি
পুরুনো ইতিহাস আমি শ্রদ্ধার সাথে
স্মরণ করি
পুরুনো কোনো কিছুর অসম্মান হলে
আত্মারা টের পায়
ধীরেধীরে সেই ব্যক্তির শরীরে ঢুকে
পড়ে
ধীরেধীরে সেই ব্যক্তিকে আত্মহত্যা
করতে উদ্বুদ্ধ করে
তারপর ব্যক্তিটি নিজেই গলায় ফাঁস
দিয়ে মরে পড়ে থাকে
আত্মারা ওই ব্যক্তির আত্মা তাদের
রাজ্যে নিয়ে চলে যায়
ভৌতিক কবিতা ৪৮
এই স্টুডিওতে যার ছবিতোলা হয়
সেই ফ্রেমবন্দী হয়ে যায়
যে মানুষ একবার ফ্রেমবন্দী হয়
তাকে আর ফ্রেম থেকে সরানো যায়
না
মুক্তি পায় না সে আর কখনো
একবার ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলে
ফ্রেমবন্দী মানুষটিকে ছবিওয়ালার
কথামত চলতে হয়
ছবিওয়ালা ফ্রেমবন্দী মানুষদের
দিয়ে তখন অনেক কিছু করায
ভৌতিক কবিতা ৪৯
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকো
পলক না ফেলে
দীর্ঘক্ষণ
দেখবে যে কোনো পুতুলই
জীবন্ত হয়ে ওঠে
ভৌতিক কবিতা ৫০
সব ফুল ঘরে তুল না
সব ফুলের হাসি এক নয়
কোনো কোনো ফুলের হাসির
আড়ালে বেদনা
লুকিয়ে থাকে
আর সেই বেদনায় মিশে থাকে নীল
বিষ
নীল এই বিষ থেকে লাল রক্তাশ্রু ঝড়ে
যে মানুষ ফুলের রক্তাশ্রু দেখে
সে মানুষ পাগল হয়ে যায়