শিব কথা
সদগুরু শ্রীরামচন্দ্র, করিয়া শরণ
জপ-ধ্যান নিত্য করে, শিব মহেশ্বর।
কত কাল যায় বয়ে, এই ধ্যানাসনে
কার সাধ্য যায় কাছে, যবে তিনি ধ্যানে।
রামচন্দ্রের যত গুণ, ধরে চরিত্রে
সার্থক তাহার ধ্যান, মানব জীবনে।
কৈলাস নিবাসী তিনি, গুহাতে আবাস
ঋত্বধীশ* নির্বিকার, সহ্যে বৃক্ষরাজ।
সর্বগুণের আকর, তিনি যোগীরাজ
মনোবাঞ্ছা কল্পতরু, তিনি যে মহান।
এমনজনে নারীমাত্র, পূজে যতনে
পুত্র কিংবা স্বামী রূপে, পেতে জীবনে।
****
(*ঋত্বধীশ =ঋতু +অধীশ, সকল ঋতুর ওপর যাঁর আধিপত্য- এই অর্থে)
পার্বতী কথা
শৌর্যে হিমবান রাজা, যেন হিমালয়
স্বর্গ-সুন্দরী মেনকা, যার ভার্যা হয়।
তাহাদের প্রিয় কন্যা, পার্বতী সুন্দরী
গুণে অতীব নিপুণা, রূপে রূপবতী।
সখী সনে কানে আসে, শিব-গুণ কথা
যত শোনে তত আঁকে, তাঁর চিত্র-কথা।
উপায় খোঁজে, কেমনে, হয় সন্নিকট
মনের কথা কহিবে, কাহার মাধ্যম।
অনেক চিন্তি, এক উপায় করে স্থির
কামদেবের কাছে, হইবেন হাজির।
কামদেবে বিস্তারিয়া, কন মন কথা
প্রমাদ গুনে ভীষণ, শুনে সেই কথা।
অনুনয় বিনয়ে, নাছোড়বান্দা অতি
পুনঃপুনঃ অনুরোধে, অবশেষে রাজি।
রতি সহ কামদেব, আর রাজকন্যা
কৈলাসে হাজির হন, নিয়ে মনে শঙ্কা।
গভীর ধ্যানে মগ্ন, পার্বতীর ঈপ্সিত
কামদেবের আশ্বাসে, কিছু হন শান্ত।
কাম-রতি করে নৃত্য, অপূর্ব কলায়
নূপুরের ছন্দে আর ঠমকে শৃঙ্গার।
নৃত্যগীতে চারিদিক, হয় আলোড়িত
ধ্যান ভঙ্গ হয় তাঁর, চক্ষু উন্মীলিত।
নৃত্যকলার আঙ্গিক, করে তাঁরে ক্ষুব্ধ
ক্রোধানলে কামদেব, হয়ে যান ভস্ম।
ঘটনা দেখে পার্বতী, অতি বিচলিত
কাম-রতির অবস্থা, করে অনুতপ্ত।
আকস্মিক ঘটনায়, ত্রিলোক চিন্তিত
সমাধানে হাজির হন, নারদ শ্রেষ্ঠ।
বীণায় ঝঙ্কারি তান, স্মরে নারায়ণ
তার উপস্থিতি আনে, অন্তরেতে জল।
পার্বতী সবিস্তারে, কহেন মুনিবরে
‘প্রেম-কথা’ বুঝি, যান, যোগীরাজ সনে।
ঝঙ্কারি বীণার তারে, প্রেমের সু-তান
পরিবেশে নিয়ে আসে, সহজ বাতাস।
হৃষ্ট-চিত্ত শিব কহে, কিবা সমাচার
আগমন হেতু এবে, কহেন আমায়।
নারদ কহে এবার, ঝঙ্কারিয়া তার
নারায়ণ, নারায়ণ, মহিমা অপার।
বামা আসে আপনারে, করিতে আপন
যোগীরাজ হেলা করে, প্রেমের কদর।
পার্বতীকে কহে এবে, দেবর্ষি নারদ
যোগীরাজে পেতে চাই, সাধনার বল।
বাড়ী চল দেবী, দেবো সাধনার শিক্ষা
সাধনায় সিদ্ধ হোলে, তিনি দেবে দেখা।
অনুরোধ করে গৌরী, কামরাজ তরে
প্রাণ দিতে পুনরায়, সাধ্বী রতি তরে।
নিষ্কাম ভিক্ষায়, যোগীরাজ প্রফুল্লিত
কামদেব প্রাণ পেয়ে, জেগে উঠে পুনঃ।
ধন্য ধন্য বলে সবে, নারদের নীতি
হেন কূটনীতি হলে, সমাজের স্থিতি।
***
পার্বতীর সাধনা
নারদ শিখিয়ে দেন, সাধনার পথ
ভক্তিভরে পার্বতী, তা করেন গ্রহণ।
কিছু সখী সাথে নিয়ে, যায় এক শৃঙ্গে
সাধন বেদী হয়, এক প্রস্তর খণ্ডে।
অপূর্ব সুন্দর স্থান, আছে এক কুণ্ড
অবগাহনে নিত্য সেথা, হন পবিত্র।
রকমারি বৃক্ষ সেথা, আরও লাগান
নিত্য দিনের নৈবদ্য, হয় আহরণ।
সুন্দর শৃঙ্গ ধীরে, আরো সুন্দর হয়
গৌরীশৃঙ্গ নাম লয়ে, করে আকর্ষণ।
মুনি-ঋষি যবে আসে, আশ্রম দর্শনে
ফল-মূলে দেন সেবা, নিজ হাতে সবে।
সজ্জনের সাধু সঙ্গে, জ্ঞান বাড়ে ক্রমে
আশীর্বাদে মন ভরে, ভাব বাড়ে প্রাণে।
একান্তে পার্বতী এবে, ধ্যানে মগ্ন হন
গভীরতম ধ্যানে, নিবেশ করে মন।
খান দান স্নান পাণ, করে পরিত্যাগ
সাধনায় নিমজ্জ মন, বহুকাল যায়।
ধ্যানী ধ্যায় নিত্য যবে, হয় একাকার
ধ্যায়ের সকল গুণ, ধ্যানীতে মিলায়।
দেখিয়া নারদ মুনি, এমন অবস্থা
শিবেতে প্রকাশ করে, সব বিস্তারিয়া।
নারদ-মুনির কথা, শুনিয়া বিস্তার
মুনিকে নিশ্চিত ক’রে, দিলেন বিদায়।
একদিন যোগীবর, বৃদ্ধ বিপ্র বেশে
উপস্থিত হইলেন পার্বতীর কাছে।
ব্রাহ্মণ দেখি পার্বতী, করে সমাদর
পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে তাঁরে, করেন যতন।
সমাচার নিয়ে শিব, জিজ্ঞাসেন তারে
কেন এত কৃচ্ছ সাধন, কোন প্রাপ্তিতে।
বিশ্বাস করি ব্রাহ্মণে, কন মনকথা
শিবকেই স্বামী-রূপে, করেন আকাঙ্ক্ষা।
ব্রাহ্মণ বুঝিয়ে বলেন, কি আছে শিবে
কোথায় ঘর দোর, প্রকাশ্যে বাস করে।
ভুত-প্রেত সব নিয়ে, দিন যায় তার
সংসারে নাই ধ্যান, বিহঙ্গম সার।
এমন লোকের সাথে, হয় সংসার
ঢের ভালো চক্রধারী, শত শত বার।
দেবরাজ ইন্দ্রের, বিশাল সমাদর
তার নিকট শিবের, আছে কিবা দর।
এতসব কথা শুনি, দেবী হন ক্ষুব্ধ
হাতজোড় করি কহে, এবে দিন খান্ত।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এবার, রাগান্বিত মনে
প্রস্থানে উদ্যত হন, পার্বতীর থেকে।
প্রস্থানকালে শিব-শম্ভু, ফিরিয়া পুনঃ
নিজ রূপে দর্শন দেন, পার্বতী ধন্য।
উমা নামে সম্বোধিয়া, আশীর্বাদ করে
রূপবতী গুণবতী, সাধ্বী সতী তুমি।
ধন্য তোমার মনসাধ, ধন্য সাধনা
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওক, করি প্রার্থনা।
এত বলি বিদায় লন, শিব স্বয়ম্ভু
করজোড়ে গৌরী কহে ধন্য মোর প্রভূ।
***
শিব-পার্বতীর বিবাহ
মহাকাশী আসে শিব, দিতে শুভ বার্তা
সপ্তঋষি ডেকে কন, বিবাহের কথা।
মহা খুশি সপ্ত ঋষি, যান হিমালয়ে
বিবাহের সংবাদ, দিতে হিমবানে।
নারদে ডাকেন শিব, আমন্ত্রণ তরে
করজোড়ে নিমন্ত্রণ, যেন সবে করে।
পাত্রীপক্ষ আয়োজনে, নাহি রাখে ত্রুটি
খান, দান আপ্যায়নে, সবে খুব খুশি।
শুভক্ষণে বিবাহের, শঙ্খ উঠে বেজে
ব্রহ্মার পৌরহিত্যে, সমাপন সুন্দরে।
হর-গৌরীর জীবন, অতীব সুন্দর
সুসন্তান গ’ড়ে তাঁরা, চির পূজ্য হন।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে রইলে সাম্যভাব
জীবন সুবহ হয়, সুন্দর সমাজ।
‘শিবলিঙ্গ’ প্রতীক রূপে করে ঘোষণা
সৃষ্টির রহস্যের মূলে এই ঘটনা।
***