এ কোন স্বাধীনতা!
নীলাঞ্জনা।
বয়স পঁচিশ ।
মা- বাবা আদর করে বলত নীল।
কনভেন্ট শিক্ষিতা, পেশায় আইনজীবী।
শিক্ষায় চেতনায়- এক পূর্ণ স্বাধীনতা ।
ঠিকানা-
১৫০১ নং অ্যাপার্টমেন্ট,
বিলাসবহুল এভারেস্ট হাউস।
তিলোত্তমা কলকাতা।
বাবা মা প্রবাসী।
কর্মসূত্রে কখনও বা আসে -
অবসর পেলে।
রোজ সকাল ন'টায়-
একটা সাদা রংয়ের গাড়ি এসে থামে,
এভারেস্টের দরজায়।
গট্ গট্ শব্দ-
তারপর, কালো কাঁচ তোলা গাড়িটা মিলিয়ে যায়-
যেন দূরে- ভেসে যায় পাল তোলা নৌকো।
আমজাদ ওদের প্রহরী।
পাঁকানো গোঁফ, পেটাই চেহারা,
চোখ দু'টো যেন রক্ত বর্ণ আগুনের গোলা।
পিছু নেয়-
কিন্তু, মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলে তার গন্তব্য।
এমনি করেই-
দিন কাটে।
ওর প্রথম ভালোবাসা সবুজ।
আগামী কাল ওদের বিয়ে।
নীল আজ বেরিয়েছিল সবুজের সাথে।
বিয়ের সব কেনাকাটা সেরে ফেলতে।
লাল বেনারসি, লাল চেলি, আরও - অনেক কিছু।
নীল বলেছিল ,
কাল সে এমন করে সাজবে-
সারা জীবনে সবুজ কোনোদিন ভাবেনি সেভাবে।
এরপর গেল রেস্তরাঁয়,
দু'জনে বসল পাশাপাশি,
যেন ঝিনুকের দু'টি খোলা-
আলো আঁধারির নিস্তব্ধতা।
আজ যেন নীলের দু'চোখের পাতা-
একটু বেশি রকম কাঁপছে !
খাবার, টেবিলে সার্ভ করতেই-
গরম চিলি চিকেনের প্লেটটা উল্টে পড়ল নীচে-
একটুর জন্য রক্ষা পেল নীল !
রাত দশ'টায় -
সবুজ'কে বিদায় জানিয়ে,
একরাশ বাজার নিয়ে ঘরে ফেরে নীল।
কিন্তু কি আশ্চর্য !
আলো ঝলমলে এভারেস্টের -
১৫০১ নং যেন ডুবে আছে সূচী-ভেদ্য অন্ধকারে।
নীল কন্ট্রোল রুমে ফোন করল।
ইলেকট্রিশিয়ান এল, সাথে আমজাদ।
তারপর খুট্ খাট্ ,
একটু পরেই আবার আলো ঝলমলে হয়ে উঠল-
১৫০১ নং।
এরপর,
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে-
বিছানায় গা'টা এলিয়ে দিতেই-
দু'চোখের পাতা এল ভারী হয়ে।
হারিয়ে গেল স্বপ্নের সবুজের দেশে।
খুট্ করে একটা শব্দ ,
নিশ্চয়ই সবুজ-
ঘনঘন নিঃশ্বাস বইছে-
এই বুঝি রাজপুত্রের সোনার কাঠির ছোঁয়া-
এসে লাগল ওর গায়ে !
হঠাৎ একটা জোর ঝাঁকুনি !
মিলিয়ে গেল স্বপ্নের সবুজের দেশ,
চমকে উঠল !
ওর সামনে তখন উন্মত্ত, রক্তচক্ষু, অর্ধনগ্ন,
হাতে লম্বা ছুরি বীভৎস চেহারার সেই পৈশাচিক মূর্তি।
যাকে আজ রাতেও দেখেছে-
ইলেকট্রিশিয়ানের সংগে !
এক ঝটকায় খুলে নিল-
নীলের রাতের পোশাক।
নীল প্রাণপণে ঘরের বাইরে আসার চেষ্টা করল-
চিৎকার করতে লাগল-
বাঁচাও ---বাঁচাও---বাঁচাও----
গভীর রাতের সেই গগন ভেদী আর্তনাদ -
এভারেস্টের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেদ করে-
পৌঁছালোনা কারোর কাছে।
পরদিন সকাল,
সবুজের ফোন,
না, ফোনটা বার বার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
নীল তো কোনোদিন এমন করে না !
বেরিয়ে পড়ল,
লিফট্ বন্ধ,
দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল,
হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির ধাপে।
এক অজানা আশঙ্কাতে ওর বুকটা কেঁপে উঠল !
ঘরের দরজায় যখন পৌঁছালো-
দরজাটা একটু ফাঁকা,
নীচ দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্তের দাগ !
উদ্ভ্রান্তের মতো দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢুকলো,
মেঝেতে নীলের ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা।
সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে-
একটি কামোন্মত্ত, রক্ত লোলুপ,
নেকড়ের থাবা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য -
একটি অসহায় মেয়ের শেষ আর্তি।
সবুজ এসে পাশে বসল।
পরিয়ে দিল লাল বেনারসি।
সাজালো মালা-চন্দনে-লাল চেলিতে।
ঠিক যেমন বলেছিল নীল -
এমন- সাজ- সে- সাজবে ,
সবুজ জীবনে কখনও ভাবেনি।
এরপর-
এল পুলিশ,
কেউ বলল-
হবে না ? এমন উদ্ধত ! এমন উচ্ছৃঙ্খল !
কেউ বা বলল -
এটাকে বলে-
মেয়েদের স্বাধীনতা !
নারী স্বাধীনতা !
পুলিশের গাড়ি'টা -
এগিয়ে চলল -
নীল হারিয়ে গেল-
সবুজের দেশ থেকে -
মিলিয়ে গেল দিগন্তে -
অসীম - নীলিমায় -
সবুজ একাকী -
বসে, কেবলই ভাবছে -
এটাই কি আমাদের -
সেই স্বাধীন দেশ !
যার স্বপ্ন দেখেছিলেন-
শহীদ বিনয়- বাদল- দীনেশ !