আজকে যে কবির কবিতা নিয়ে এই পাঠকনামা তিনি কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী।  কবির জন্ম সেপ্টেম্বর ১৯৫৬, কোলকাতাতে। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা শেষ করে ইংল্যান্ড যান অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করতে। পরে দেশে ফিরে ১৯৮০ সালে আই এ এস পাস করে ভারত সরকারে উচ্চ পদে যোগদান। তিনি ভারতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য সচিবের পদে কাজ করেছেন।

কবির সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ ছোটগল্প দিয়ে। কবির অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে বিভিন্ন লেখা আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ তেমনই সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কবির অবাধ বিচরণ। আর আছে কবিতার সাথে পথ চলা, কবিতার সাধনা। কবির কবিতায় যেমন আছে বর্তমান সময় ও তার চিত্রায়ন তেমনি প্রান্তিক মানুষ ও তার জীবন যাত্রা। অত্যন্ত মানুষের কাছাকাছি কবিতাগুলো, মানুষের কথা বলে, মানুষের কথা শোনে। আজকের সমস্যা যেমন উঠে আসে কবিতায় তেমনই ভাষা, ভাবনা ও উচ্চারণ বলে দেয় কবিতা কি ভাবে পার করে যায় সময় ও সমাজের ব্যবধান। আজকের নারীর কথা, তাদের ভাবনা হিসাবে আলাদা নয় তা যেন মানুষের কথা হয়ে ওঠে কবিতায়।  কবির কবিতা গুলো পাঠককে বেঁধে রাখে, বিমোহিত করে, ভাবতে বলে বার বার।

কাব্যগ্রন্থ: চন্দনরেখা, বৃষ্টি আসবে, সাঁজোয়া বাহিনী যায়, যারা ভালবেসেছিল, আলীক জীবন, অতলস্পর্শ, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, অকাল বোধন, এবু গোগো, জয়রামের সিন্দুক, আয়নায় মানুষ নাই, অনিতা বিচিত্রিতা, ব্রেল, তরুশী, মহুলডিহার দিন, আকিম নিরুদ্দেশ, তরণী , দশটি গল্প / ১৩ , আরো অনেক।


সূর্য-ডোবা দেখতে গিয়ে -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

সেই মেয়েটি গেছে সিঁথির মোড়ে
সূর্য-ডোবা দেখতে গিয়ে। সেই মেয়েটি
ক্রন্দসী-তীর ছাড়িয়ে গেছে মেঘান্তরে।
ঘাসের ঘুঙ্গুর লোটায় পায়ের। রুপোর কাঠি
শিয়র বাগে। কে আর তাকে মধ্যরাতে
জাগায়, সে তো ছাপিয়ে গেছে এই সময়ের
দ্বন্দ্ব-দোলন। বনের দু'হাত জ্যোৎস্না-পাতে
পিছল, তাকে ডাকতে পিছু শঙ্কা পথের।

মা সেধেছে। পা ধুবি আয়, বাবা সাঁকোর
কাছেই ছিলো, হাত ধরবে। ভাই জানলায়
দাঁড়িয়ে ভাবে, গল্প বাকি। বোনটি তো ওর
এলই না আর; শিহর ওঠে রাত-ইঁদারায়।

নৈঋতে চুল শুকাচ্ছিল লাল-রঙ্গা রোদ,
ঝাপটে ছিল পাখা কিছু উদ্বাহু গাছ;
দিক হারানোর ঝঞ্ঝাবায়ে ও কোন অবোধ
ছাড়িয়ে গেল আকাশ রোদের আনাচ-কানাচ,

সূর্য-ডোবা দেখতে গিয়ে রাতের তোড়ে
সেই মেয়েটি তলিয়ে গেছে সিঁথির মোড়ে।।

নক্ষত্র -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

অনেক অনেক দিন ধরে একটি নক্ষত্র আলো পাঠাচ্ছে
খেয়া পেরোবার সময় আমি মুখ তুলে তাকে দেখলাম
নদী-জলে আঁশ গন্ধ, বাতাসে আশি ভাগ আর্দ্রতা,
হরিরামের সাইকেলের পাশে মুরারীর ছাগল
আনমনা দাঁড়িয়ে। জবার মা মেয়ের শ্বশুরবাড়ি
যাচ্ছে, সঙ্গে পণের বাকি টাকা।
হেমন্ত ছেলে পড়িয়ে আসছে, এপারের কোচিং
ক্লাস থেকে। নদীটি কোল পেতে আছে
নিঃশব্দে, জ্যৈষ্ঠে তার জল বড় কৃশ।
বালি পেরিয়ে, জল মেখে খেয়া চড়তে হয়
বলে সকলেই নদীটির নিন্দেমন্দ করে। নক্ষত্রটি
সুদূর; করুণ অথচ গম্ভীর তার আলো, বহুদিন
ধরে সে কিছু বলতে, ছুঁতে চাইছে, স্বপ্ন পাঠাচ্ছে
সৌরজগৎ এর দূরবর্তী প্রান্ত থেকে। হায় তার
ছায়াও পৌঁছয় না নদীজলে। আজ হঠাৎ
মুখ তুলে তাকে দেখলাম, আমি, আমার
পাশে চোখের জলের দাগ শুকানো তুমি,
আমাদের সদ্য নিষ্কাশিত শিশু যেন অন্ধকারে
ডেকে উঠল 'মা'।

পট -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

জলের অনেক নিচে পড়ে আছে
                                               নিশ্বাসের শব্দ
জলজ দামের মত ভ্রাম্যমাণ, অথচ কী বায়বীয় অছিলায়
                                        সমুদ্র খাতে তার মূল
ছুটন্ত নৌকোর আলো                               ডাকে
জল যেই ন’ড়ে ওঠে ঃ নিশ্বাসের ধবনি নিভে যায়
কাছাকাছি অন্ধকারে, ঢেউ ও বাতাসে লগ্ন
                                          তুমি কি কোথাও
রয়ে গেছ? মারভের তল খোঁজা গানে
তোমার গোটানো পট খুলে যায় জলের ভিতর
বিচিত্র দ্বিধায় লেখা, ছবি ও অক্ষরে তোমার কাহিনি
যৌনিহীন মৎস্যকন্যা, অবাঞ্ছিতা, সে জানে সে  সমস্ত
                                                        পড়েছে৷

স্বগতোক্তি -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

আদরি নারকেল গাছ               আর দেখবো না
তোমার কেশরে
কেমন চিকন রোদ ঠোঁট ঘসে
দেখব না উজ্জ্বল ফুলেরা কেমন
আলো দিয়ে
ক্রমাগত অন্ধকারে হেঁটে চলে যায়...
ছ'টার ঘন্টার শব্দ আকাশে টাঙ্গিয়ে দেবে
বিষন্ন ঘড়িটি...
অনেক আগেই তার বন্ধ করে দিয়ে যাব
দৃষ্টির জানালা
শাশ্বতী পাখিটি এসে নিয়ে যাবে কাঠ, কুঠো, কাঠি
রোজকার;
শ্মশানবন্ধুর মতো কাতর গাছেরা,
লাল সুর্যে হাত রেখে আগুন পোহাবে,
ঝিরিঝিরি হাওয়া শেষে বৃষ্টি দিয়ে চলে যাবে
সন্ধের বাগানে;
তাদের কী এসে যায়। আঁধার বাড়িটি,
বন্ধ করে বসে আছে দৃষ্টির জানালা!

আগুন লাগা শরীর নিয়ে যদি -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

আগুন-লাগা শরীর নিয়ে যদি
জ্বলতে জ্বলতে তোমার বাড়ি আসি
ভেজা বাতাস জড়িয়ে দিও গায়ে
ভয় পাবে না, ঘরপোড়া সন্ন্যাসী

সরিয় নিও পুড়তে পারে যা যা
আসবার আর জীবন-জোড়া ফাঁকা
তুষের কাথা খড়ের কঙ্কালে,
ঝাঁপির বেত, ঘাসের আংরাখা।

জ্বলছে জ্বলছে সলতে-পোড়া প্রাণ
পুড়ছে হার পুড়ছে শিরদাঁড়া
চোখের কোটর আলজিভ আর নাভি
হতবম্ব দাঁড়িয়ে আছে পাড়া।

এক ফোঁটা জল, এক ছিটে জল কেউ
দেয় না, কত তেষ্টা জীবন জুড়ে
একটু নরম ছায়া অন্য পাখি
উড়ছে ধু-ধু আগুন-পাচিল ঘুরে।

তোমার কাছে নয়নভরা জল
তোমার কাছে পদ্যজাগা বিলও
ভেজা-বাতাস, বৃষ্টি-নেভা রাত,
তোমার কোলেই মরণ লেখা ছিল।

আগুন-লাগা শরীর নিয়ে যদি
জ্বলতে জ্বলতে তোমার কাছে যাই,
পাগল নদী জড়িয়ে দেবে গায়ে?
তারায় তারায় ছড়িয়ে দেবে ছাই?

মুখ --  অনিতা অগ্নিহোত্রী

শালবনে বৃষ্টির শব্দে
যে মুখখানি ধুয়ে যায়
                   যার ছবি
                   প্রতিমার মতো স্পষ্ট পড়ে আছে
                   সময়ের জলতলে

যে কালও রেখেছে পা
স্বপ্নের গলুইয়ে
আলতার রাঙা জলে
গলে গেছে ঘুম
                  যার জন্য
                  এক আকাশ অভিমান নিয়ে
                  দিগন্তে চলে গেছিলাম

                  সে-
                  আজ
                  চলে যাচ্ছে
                  কখনো ভাবিনি

এমন নৈকট্যয়ে গাঢ হয়ে
নিঃশর্ত আগুনে সে আমার মুখচুমন করবে।


তুমি কেমন আছ --  অনিতা অগ্নিহোত্রী

তুমি আমাকে যেমন রেখেছ আমি তেমন আছি
শিকড়ে কল ঘেঁষে রাঙা বটফলের মতন।
রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দে, কান্নায় ঘামে
গোরুর গাড়ির চাকায় পিষ্ট মাটিতে মুখ ঘ'সে
আবার একদিন ধুলোর সঙ্গে উড়ে যাই চৈত্রর বিকেলে
তুমি আমাকে এমনই রেখেছ।
শিরায় শিরায়                           একদিন জ্বর আসে,
আবার একদিন                         ধমনী বেয়ে ফিরে যায় হাহাকার।


এসেছি তোমার বাড়ি -- অনিতা অগ্নিহোত্রী

এসেছি তোমার বাড়ি। কী দিবা, চিন্তামণি, খেতে
পেরিয়ে ধূসর পথ, উইঢিপি, ফণীমনসার
তর্কাতীত, গাঢ সম্বন্ধ্যতার সূচিমুখ, খুব খিদে
তোমার পুকুরে চাঁদ মরে ভেসে আছে দুঃখী
আতারা ঝুঁকে পড়ে দেখে আর মৃত্যুভয় পায়
ধানখেতে খুঁড়ে কারা রেখে গেছে শিশুর
কঙ্কালঃ কপালে এখনো তার ধ্যাবড়ানো
কাজলের দাগ, মার অক্ষমতা ভালোবাসা হয়ে
ফুটে ওঠে মোরগের হাতায়ঃ এসেছি তোমার
বাড়িঃ কী দেবে, চিন্তামণি, পেতে
কাঁথা পাতো, পাহাড়, নদীর বুক, শালবন ঢাকা
একখানি, ছেঁড়া কাঁথা, যাতে কলকা পাকা আম
সফেদার কচি মুখ দিও, যাতে ওই দিনমজুরের
হার জাগায় বুক আর বেঁধে না মাজায়
রমণীর ছেঁড়া চটি সেফটিপিন অসাড় কনুই
ঘুমের নিচের স্তরে সেই সব ভালো নয় থাকা

এসেছি তোমার বাড়িঃ বহু সন্ধ্যা সকালের গন্ধ মাখা
অঙ্কে ধুলির চেয়ে ধুলিসরঃ কী দিবে চিন্তামণি
কী আছে তোমারঃ ভাক নেই, কাঁথা নেই, একাকীর
বিফল সংসার। এসেছি তমার কাছে। স্বর্গের পথে
ভাঙা ঘর। কপালে তিলক দাও, ম্রিত্রিকাধূসর
অন্নের চিন্তাকে দিও অঙ্কুরের সদ্যজাত পাখা।


কাগজকুড়ানিরদের জন্য গাথা -- অনিতা অগ্নিহোত্রী (কিছু লাইন)

আমার মতো তুমিও যদি চুমুক দিতে
আয়না-ভাঙ্গা পারার মতো বিষের কাপে
তুমিও দেখতে কুচকে জাছে রোদের কাঁথা
ছিটকে উঠছে রক্তমাখা ছিন্ন হাওয়াই
তুমিও দেখতে জীবন ঠোঁটে রুচছে না আর
হাড়ে মধ্যে শীতের ছুরি, পায়ের নীচে
কনকনে রাত, দিনের বেলা জুড়িয়ে বরফ
রোদ ও আকাশ সঙ্গে তাদের অট্টহাসি
.
.
.


প্রত্নবিষাদ -- অনিতা অগ্নিহোত্রী (কিছু লাইন)

এবারের গ্রীষ্ম এসে মুছে দিয়ে গেল গত জ্যৈষ্ঠের
অবরননিয়তা অপমান, ক্ষভ, গাত্রদাহ, সারাদেহে
রাঙা গোল দাগ, অনিদ্রা, তপ্ত তুলা, খর
রৌদ্রে মরে পড়া পাহি, পিচ-গলা, ট্রাম থেমে
বিদ্যুৎ বিহীন, বাসে ঝগড়া, অটোর ইতর ধাক্কা
সারা রাত্রি স্পর্শহীন দাম্পাত্যের গাঢ অন্ধকার
.
.
.
এবার, বেসনায় উঠে এল গত গ্রীষ্মের
অকণ, অবিলিপ্ত মুখ ।।

নৌকা -- অনিতা অগ্নিহোত্রী (২০১৫, দেশ শারদীয়া)

জ্যোৎস্না। ভাটার নদী। পাড়ের কাদায়
বৃহৎ চিবুক রেখে শুয়ে আছে প্রাচীন কুমির
জোয়ারের টানে এলে নিঃশব্দে ভেসে যাবে জলে।

এত তারা দেখিনি কখনও। আকাশের গম্বুজ
আহ্নিক গতির টানে ঈষৎ বিহ্বল। নৌকায়
বসে আছি, তুমি এলে একত্রে বেরোব, সমুদ্রামুখী।

কুমির তা জানে। সবুজ মণিতে তার সংগুপ্ত হাসি।
সে জানে না, তুমি আসবে না। দূর ইঞ্জিনের ডাক
শুনেছে, তোমার মন, গতিলুব্ধ। শালের অরন্যে
                                                    ঘন রাত।
তোমাকে আমার নানা রক্তাক্ত হৃদয়, ভাঙা মন
কতভাবে দিয়েছি, সুদূর! দীপ - জ্বালা পাতার ভেলায়
একে একে পৌঁছে গেছে নদী মোহনায়। পদচিহ্নহীন,
                                      শূন্য, আমার নৌকাটি।

তথ্যসূত্রঃ কবির লেখা কবিতার বই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট।
( কবিতা ভালোবাসুন , কবিতা পড়ুন, কবিতার বই সংগ্রহ করুন)