আজ পাঠকনামা তে যে কবির কথা বলবো তিনি কবি বিভাস রায়চৌধুরী। কবির লেখা যেন এই সময়ের লেখা , এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই সময়ের মানুষের লেখা। মাটির কাছে ... জীবনের পাশে ... অনুভূতি আর অনুভব বিচরণ করে কবিতায়।

কবি বিভাস রায়চৌধুরী জন্মঃ- ১৯৬৮, বিভূতিপল্লি, বনগাঁ , উত্তর ২৪ পরগনায়। তিনি নব্বই দশকের  এক  স্বতন্ত্র কবি । বাংলা ভাষা মতই তার লেখা ছুঁয়ে থাকে বিস্তার মাটির গন্ধ নিয়ে। মানুষের ভালোবাসা ও জীবনের লড়াই, হাসি কান্না মেশানো তার কবিতা।  পুরস্কার পেয়েছেন অনেক, তবু  আগের মতোই মাটিতে পা রেখে হেঁটে যান নতুন গ্রামের কাঁচামাটিতে , সেখানেই যে পেয়েছেন কবিতার মতো কত কি! তাই কবিই অবলীলাক্রমে বলতে পারেন
"রাষ্ট্র, তোমার অনেক পুলিশ?
   আমার শব্দ। শব্দ আনি!

বাঙালের ছেলে কবিতা লিখছি, এটাই আমার চোখরাঙানি। "

প্রতিবাদ , হ্যাঁ ... অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবির কলম ... কবিতা ওগলায়।

কাব্য গ্রন্থঃ অনন্ত আশ্রম, সমস্ত দুঃখীকে আজ,  শ্রেষ্ঠ কবিতা, শিমূলভাষা, পলাশভাষা, জীবনানন্দের মেয়ে, চণ্ডালিকাগাছ, পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি ও যখন ব্রিজ পেরোচ্ছে বনগাঁ লোকাল, অশ্রুডানা, ভালোবাসার মাটি, প্রিয় ইচ্ছামতী, বাইশে শ্রাবণ ,

পুরস্কারঃ কৃত্তিবাস পুরস্কার ( নবপর্যায়)-১৯৯৭ , বাংলা আকাদেমি পুরস্কার-২০১৪।

https://www.facebook.com/BibhasRoyChowdhury01/info/?tab=page_info ( কবির ফেসবুক পেজ)


বাবার হোটেল -- বিভাস রায়চৌধুরী

কুয়াশার একদিকে দিগন্ত ঘুমোচ্ছে... অন্যদিকে বাবার হোটেল,
মাথা নিচু ক'রে দু'গ্রাস গিলেই আমি ফুটে যাই,
মালিক, তুমি ঋণগ্রস্ত নাবিক,
আমি তোমার ভাঙা পাল...
কুয়াশার একদিকে অন্ধ চাকরি-অলা...অন্যদিকে বাবার হোটেল,
সারারত আমি পাহারা দিই নিজেরই পোড়া ডানা,
বড়বাবু, আমার কড়িকাঠে ঝুলে প'ড়তে ইচ্ছে করে... বড়বাবু...
আমার স্বপ্নে শুধুই ওষুধের গন্ধ...
ভোর-ভোর তোমার চোখ এড়িয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি,
যে কোনো পথই আমার কাছে হাসপাতালের দীর্ঘ করিডোর...
কুয়াশার একদিকে সাতাশ বছর ধরে আমি বড়ো হয়েছি,
অন্যদিকে বুড়ো হয়েছে বাবার হোটেল,
এখন সময়ে-অসময়ে দমকা কাশি ওঠে,
আমি ছিটকে পড়ি এ মেঘে ও মেঘে...
এই কি সূর্যাস্ত, বস্‌? বলো? এই কি সূর্যাস্ত?
বুক খামচে ধ'রে কেঁদে ফেলতে আমার বয়েই গেছে।
কিন্তু ঘটনা হলো, যে জীবনে কুয়াশা রয়েছে, সে জীবনের
ভবিতব্য অন্যরকম-
কুয়াশার একদিকে একদিন আমি কেঁদে ফেললাম,
আর অন্যদিকে মাথায় আগুন জ্বললো আমার,
আমি তোমাকে লাথি মারলাম, বাবার হোটেল...
মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তে ভিজিয়ে দিলাম নোনাধরা দেওয়াল...
আমার পাখিজন্ম ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খেলো একুশটা ঘুমের ট্যাবলেট...
পাখিঅলা, ও পাখিঅলা... দরজা ভেঙে তুমি কী দেখলে?
জান্‌লা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়েছে কালো কালো আকাশ?

রহস্য মিশিয়ে কিছু  -- বিভাস রায়চৌধুরী
.
যেখানে যেখানে আজ ভিজে গেছে মাটি,
রহস্য মিশিয়ে কিছু কথা রেখে আসি...
কথারা ফুরিয়ে যায় পাছে, এই ভয়ে
নিজেকে নিয়োগ করি ইশারা-বিশ্বাসী...
.
গাছের ছায়াও ভেজা ... চুপিচুপি যাই...
যে-কোনও সম্ভব ছিল দু-ঠোঁটে সম্ভব!
তুমি কি এসেছ আজ, শরীর জানে না--
.
যা বলার মায়াই বলে! সব ... সব ... সব...

দায় -- বিভাস রায়চৌধুরী

ওই আলো ওই অন্ধকার আমাকে নিংড়ে নিচ্ছে---
ওই জল ওই হাওয়া আমাকে প্রলয় চেনাচ্ছে---
আমি কি খেলা হয়ে গেলাম?
আমার জ্ঞান ও পাপ,
আমার ধারণের প্রক্রিয়া দিগন্তকে উত্তেজিত করে,
আর দ্যাখো পাতালের আর্তনাদ---
আর দ্যাখো সময়ের বিভ্রান্তি---
অস্তিত্বের মধ্যে আর এক অস্তিত্বের নড়াচড়া মাঝেমাঝে টের পাই
হে ভ্য়, হে ভালবাসা,
নির্জনের এই উঁকি তীব্রতম দায়!
আত্মমোচনের মতো জ্যান্ত ঘূর্ণিঝড় পাক খেতে থাকে---ওঃ!
আমার তারাবমি হবে---
আমার বৃক্ষবমি হবে---

মা, আমি কবিতাসম্ভবা!


মাটি -- বিভাস রায়চৌধুরী

আমি যে হেরেছি, আর সংশয় নেই
ভোরবেলা ফিরে যাই নিজের বাগানে
সমস্ত পুষ্পের ধীর সুস্থতার পাশে
নিজেকে গোপন করি
প্রকাশ্য হব না, এই হারিয়ে যাওয়া
আমাকে দিয়েছে এক বীজের জগৎ...
আলো খেয়ে একা থাকতে হয়...
আগামী জন্মের জন্য উদ্ভিদের মৃত্যু লিখি।
মাটি থাকে সম্ভাবনাময়...


পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল যারা -- বিভাস রায়চৌধুরী

জানলা এক আশ্চার্য রূপকথা, পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল যারা, যারা
প্রবল তুষার লুকিয়ে রেখেছিল ঘিলুতে, যাদের জিভ গোপন করে
রেখেছিল জীবন তছনছ করা কিছু সত্যি, যারা ময়ূর আর সাপ
দু'জনকেই ভালোবেসে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল প্রতিবার, একটু কুঁজো
হয়ে গুলিগোলা এড়াতে চেয়েছিল যারা, যারা বাল্যবন্ধুকে ট্রেনে-বাসে
কোনদিন আর চেনা দেয়নি, যারা এমনকি বদলাতে চেয়েছিল প্রথম
ব্যর্থ চুম্বন, শীত এলেই নির্জন কলতলায় একাকী হস্তমৈথুন সেরে যারা
কাঁদত আর কল চাপত আর চোখেমুখে বারবার জল দিত, তারা সবাই
চলন্ত ট্রেনের জানলায় দেখতে পায় জাদূপৃথিবী, চোখে রক্ত উঠে আসে
তাদের, কেবলই বমির ঝোঁক সামলাতে সামলাতে উঠে দাঁড়ায় তারা
বারাসাতে,অন্যকে বসতে দেয় বাকি পথ, আর তখনই এক অন্ধ ভিখিরি
নিজস্ব মাইকে গান গায় ঘুরে ঘুরে, সবার কাছে হাত পাতে তার মা
'আমার অন্ধ ছেলের জন্য কিছু দিন ', আর আরও পালাতে পালাতে
আমি ভাবি, একদিন আমি শুধুই লিখতাম কিন্তু খেতে পেতেম না, আজ
আমি দুটো খেতে পাই কিন্তু লিখতে পারিনা কিছুই...
এস অন্ধ ভিখিরি, সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন থেমেছে কোথাও, এস,
আমরা টুক করে নেমে পড়ি এইবেলা, গলা নামিয়ে দিই একবার,
একবার... অন্তত একবার সত্যি সত্যি মরি...
( যখন ব্রিজ পেরোচ্ছে বনগাঁ লোকাল )

বেত্রাঘাতের পর -- বিভাস রায়চৌধুরী
শোনো এ বেতের দাগ গাছে-গাছে মুছে ফেলে দেখি
মাটি ও ঘাসের কাছে চিরবর্ষা, চিরনারী থাকে...
ক্ষমার ভঙ্গিতে কত বেদনা জীবনে আসে যায়,
কত কান্না মিলেমিশে জল হয় গরিব বাংলায়।
গরিব বলেছি যাকে নদী তার ভেতরে ভেতরে
সন্তান পাঠায়, আর বৈঠা দেয়, নৌকা দেয় হাতে...
দেয় লুপ্ত শব্দ-রূপ... রুপোলি বনের মামাবাঘ
দেয় স্বপ্ন... দেয় ফণা... কবিরা তুমুল লড়ে যাও!
লড়াইয়ের তীরে তীরে আরও গাছ, আরও গাছ, আরও...
অপমান পিঠে নিয়ে এগিয়ে এসেছি দু-জনেই,
বাকল খুলেছে, গাছ? ও গাছ ... ও, গাছ ... চান করাও,
মন সারাও... আমাদের বিয়ে কিন্তু সামনে, শ্রাবণেই...
মাটি ও ঘাসের কাছে এস, আজ যাচ্ছেতাই চাও...
আমরা শুধু বাচঁতে চাই...
দেখি মাটি কীভাবে ফেরাও?

কাপালিক  -- বিভাস রায়চৌধুরী
.
আগুন , আমি জন্মপিশাচ , তীব্র ক্রোধে ভেসে
নিজের মুণ্ডু চিবিয়ে খাই পুরনো অভ্যেসে
.
জিহ্বা জড়ায় ঘিলুর স্বাদে , রক্ত গড়ায় ঘুমে
রাত্রি-কাপালিকের খাঁড়া নেমেছে নিঝঝুমে
.
আগুন , আমি মন্ত্রপূত দুগ্ধবতী নীল
বুনো গিটার , ক্যাম্প ফায়ার , অসুস্থ এপ্রিল
.
দিগন্তে কে দৌড়ে বেড়ায় ? পায়ের নীচে ঘাস
সামান্য মুগ্ধতাই ছিল আমার সর্বনাশ
.
দুই হাতে দুই চক্ষু ধরে হেঁটেছে উন্মাদ
বিলের উপর উপুড় হয়ে ভাসছে কাদের চাঁদ
.
আজ বাদে কাল বিচার হবে , কে কার মাথা খায় ?
আধ-খাওয়া চাঁদ রাত্রিবেলা দেবির আসন চায়
.
আগু্‌ন ,আমি জন্মপিশাচ, দেবির কিছু জানি ?
.
রহস্যহীন পথের পাশে বিপদ ডেকে আনি....

দুই পৃথিবীর দুই কবি -- বিভাস রায়চৌধুরী

জয়-এর বাড়ি , সুনীল দার বাড়ি
( এ পর্যায়ে সুবোধ ফ্রি) শঙ্খ বাবুর বাড়ি ...
এভাবেই ঘুরেছে ভিখারি !
আমাদের হাতে আছে বিনয়- এর বাড়ি থেকে শেখা
থুথু, কফ, ঘৃণা দরকারি...
তবু যেন দেখা হলে
“মানুষের ভাই” বলে
তাকেও জড়িয়ে ধরতে পারি ...

সত্ত্বা -- বিভাস রায়চৌধুরী

যখন একলা লাগে,
শুঁয়োপোকাটির কাছে যাই
বলি, “উঠে এসো...
আমার পাতাটি খাও...”
কিছুকাল পরে আমি
কাজ-টাজ ছেড়ে দিয়ে
প্রজাপতি দেখলেই
লাফিয়ে উঠব, “চিনি!”
আরও আরও একলা হতে
কেন যে পারিনি !

সেতু -- বিভাস রায়চৌধুরী
.
সব কথা ফুরিয়ে যায় না
আরও একবার দেখা হয়
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সেতু
মুখোমুখি ছায়া- বিনিময়
.
একা একা শুয়ে থাকে তারা
তার পাশে জেগে আছে জল
মায়াদের কত তরু এসে
জুড়ে দেয় মৃদু কোলাহল
.
চারপাশে যত আয়োজন
মনে হয় কিছু কথা বলি
ভালো ছিলে ?
. বলতেই কাঁপে
শরীরের শত অলিগলি
.
প্রকৃত পাওয়া বলে কাকে ?
.
ফিরে আসা বুঝি পরাজয় ?
.
সব কথা ফুরিয়ে যায় না
আরও একবার দেখা হয় !

হরপ্পা -- বিভাস রায়চৌধুরী

চুপচাপ ছিঁড়ে ফেলব একের পর এক সেতু।
গলির মুখ জুড়ে অন্ধকার।
রাক্ষস দাঁত রের করে ডকবে, এসো উপমা...
বৃষ্টিতে মেশাব অ্যাসিড।
উপার্জন করব থুতু, কফ,উপহাস।
বন্ধু-র কাছে দেব সতীত্বের পরীক্ষা।
শহরের কেউটে ধরব টপাটপ টপাটপ...
একদিন একদিন একদিন...
শেষমেশ মৃত কুকুরের পাশে গিয়ে দাঁড়াব।
বলব, খা !
শিরশির করে উঠবে পুরুষের স্তন্যবোধ.

বাতিঘর -- বিভাস রায়চৌধুরী

অন্ধ, তুমি আলোর পাশে কাঁপতে থাকো প্রেমে...
আমার কত দিনের শুরু এই।
হাত ধরিনি, একা একাই মিশেছি নির্জনে।
বিষাদরঙা নদীটি সঙ্গেই।
ঘন সবুজ স্পষ্ট হয়ে পথের পাশে থাকে।
আলোর মতো আমিও শারীরিক।
পিপাসাময় পালিয়ে যাই দূরের থেকে দূরে...
সর্বনাশ ছোট্ট বাঁক নিক।
অন্ধ, তুমি লাজুক মোমবাতি !

কেউ আমাকে পছন্দ করুক, না করুক -- বিভাস রায়চৌধুরী
কেউ আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, ছয়াকে ঘুমোতে
দেওয়া জরুরি আর পেনসিল ঢুকিয়ে রাখা ভালো বাক্সে, কেউ আমাকে
পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব,পেয়ারাফুলের গন্ধে শুয়ে থাকে
এক বালিকা আর প্রতিটি চায়ের দোকানদার আসলে দেবদূত ...কেউ
আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, নিঃশব্দ হও, ব্লেডের
মতো নিঃশব্দ... আর দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দাও শিংঅলা অন্ধকার,
কেউ আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, এমন ভাবে হাত
মেলে দাও শূন্যে, যাতে তাকে সেতুর মতো দেখায়, আর ভরা জ্যোৎস্নায়
সেতু বেয়ে লক্ষ লক্ষ মৌমাছি যেন আমদের পাড়ায় এসে পড়ে... কেউ
আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব সেই লেখাই লেখো, যা
তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না কখন আর তুমি হয়ে ওঠো এমনই
এক ভাষা, যা সর্বনাশের ভেতরই সবচেয়ে ঝকঝকে দেখায়... কেউ
পছন্দ করুক আর না করুক, আমার বয়ে গেছে, আমি জোর দিয়ে বলছি,
দিগন্ত আসলে রাক্ষস, প্রতিটি সূর্যাস্তে সে প্রজাপতি ধরে ধরে খায়...


সন্ধ্যার সন্ন্যাসী -- বিভাস রায়চৌধুরী

এমন বিকেল আছে
কোনো উচ্চারণই আর
মেনে নিতে পারি না কিছুতে...
আমার ভাবনা হয়
শব্দের কষ্ট হবে...
প্রয়োজন নেই কোনো
দিগন্তের গুহা থেকে
টেনে-হিঁচড়ে তাকে বের করা ...
বরং এবার
একাই থাকুক শব্দ ...
বেদনা-নির্জন হোক সব সম্ভাবনা !
আমার জীবনে নামে
সন্ধ্যার সন্ন্যাসী ...
জোনাকির মৃদু লেখাপড়া ...

সময় -- বিভাস রায় চৌধুরী

দাঁড়িয়ে থাকার কথা।
দাঁড়িয়েই আছি।
তোমার সময়'হলে বোলো...
সম্পর্ক ভককককককককককককভককককককককককককভককককককককককককভককককককককককক


দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি --  বিভাস রায় চৌধুরী

যেসব ছন্দকে আমরা আজ আর লিখি না,
তার পুরনো বেদনা।
        ফিরে ফিরে আসছে।
এই ঝড় এই বৃষ্টি
        আমাদের তুচ্ছ ঘর সেসব ঠেকাতে পারে?
কাদাজল, মগ্ন মাছ, দুটো ভেজা শালিখের জুটি-
        একদিন প্রত্যেকেই স্মৃতি হয়ে যাব।
তোমার মুখের পাশে এই ঝড় এই বৃষ্টি নেমে এলে বুঝি
পুরনো ছন্দের মতো
        আমিও এসেছি এক মলিন বেদনা...
এই! কবিতা শোনাবো?

তোমার চোখের কাছে দুটি চোখ নামিয়ে রেখেই
পাগল বাতাস হয়ে ছুটে গেছি কত দূরে দূরে...
এত আনন্দ আমার! শরীর আনন্দে ভরে গেছে।
চোখের প্রকৃত কোনও আলো নেই জেনে গেছি কবে!
অন্ধের মতন অন্ধ ভালবাসা দিয়েছি তোমাকে।
কোথায় তোমার অশ্রু?
        তোমার চোখের কাছে থাকে...
যা কিছু জরুরি, তুমি তারও চেয়ে জরুরি সংবাদ!


পথিক --  বিভাস রায় চৌধুরী

আমার যখন কবিতা খাচ্ছে কাক
মন নিয়ে গেল এই দুনিয়ার চিলে
মনে পড়ে তুমি বড়ো রাস্তায় এসে
হাত ধরে কিছু দুঃখকে চেয়েছিলে

হয়তো ক্ষণিক কৌতুক সব কিছু
শহরের পথে গ্রাম জড়সড় থাকে
মন্থর ট্রাম যাচ্ছিল মনে পড়ে
আমরা হেঁটেছি পরের পরের বাঁকে

আমরা হেঁটেছি... ভেজা ঘাস... ময়দান...
প্রকৃত সারস হয়তো-বা তুমি, তাই
চলে গেলে এক পাতালগামিনী নারী,
বোবা চিৎকার নিয়ে আমি বাড়ি যাই

বহুদিন আর নন্দনে যাচ্ছি না
গ্রামের পথেই শুনতে পাচ্ছিলাম
'দুঃখ পাওনা দুঃখ পাওনা আছে...

বলতে বলতে আসে মন্থর ট্রাম...


ব্যর্থ কবির চিঠি, মা-কে --  বিভাস রায় চৌধুরী

মা, তুমি 'অ' পড়ছো, আর 'আ' পড়ছো... আকাশে
                                   দৈববাণী-
'বিষণ্ন দেবতা পেটে ধরেছিলো, কে সে দুয়োরানি?'

তুমি দুয়োরানি... তুমি রান্নাঘর... তুমি লংকা-নুন...
সারাটা জীবন ধরে মাগো, তুমি নিজেই উনুন!

কিংবা তুমি হয়তো আজ আমার লাগানো গাছে-গাছে
ফুল ফুটতে দেখছো, আর ভাবছো- লেখার জীবনে আছে
এরকম স্পষ্ট চোখ... এরকমই গন্ধবান দেহ...
মা, আমি পারিনি। ব্যর্থ। এ লেখা পড়েই ভুলে যেও।

আমার কুয়াশারোগ। আমি ঠিক স্বাভাবিক নই।
ঘুমিয়ে পড়ার পর দেখতে পাই ভেসে যাচ্ছে লাশ...
রূপগলা মৃতদেহ... কে ও? কে ও, তরুণ পলাশ?
পৃথিবী সেলুন, তার সব ক'টা ুর এসে
                 হাতের শিরার পাশে শোয়...
রোজ ভোরবেলা দেখি
                 পাখিদের মুখ দিয়ে আগুন বেরোয়...

মা আমার! মনে পড়ে তিরিশ বছর আগে সেই
        জন্মভোর? কী ছিলাম? সাদা কাগজের মতো কিনা?
তিরিশ বছর পর সে কাগজ ছিঁড়ে ফেলছি, দ্যাখো...
ছিঁড়ে কুটিকুটি করছি...ব্যর্থতার সাংঘাতিক ঘৃণা!

সীমান্তকে ঘৃণা করি...দাদাগিরি...কবিতা, তাকেও।
জামায় রক্তের দাগ যতদিন না মুছে যাবে,
                             আমি আর একটাও লিখবো না।
তবু... তবু বাংলাভাষা লালশালু...আমি ্যাপা ষাঁড়...
কবিতা নেভার আগে এই শেষবার তেড়ে-যাওয়া...
                             মা, আমাকে শান্ত কোরো না    


পতঙ্গ --  বিভাস রায় চৌধুরী

ভেঙেচুরে গেছি, সে আমার আনন্দ !
একটি ডানা থেঁতলে মিশে আছে পথে…
                               উড়তেই পারছি না…
অর্ধেক বেদনার জন্য কোনও অভিমান নেই,
কেননা অন্য ডানা নিঝুম মৃত্যুর…


মাটি -- বিভাস রায়চৌধুরী

আমি যে হেরেছি, আর সংশয় নেই

ভোরবেলা ফিরে যাই নিজের বাগানে

সমস্ত পুষ্পের ধীর সুস্থতার পাশে
নিজেকে গোপন করি

প্রকাশ্য হব না, এই হারিয়ে যাওয়া
আমাকে দিয়েছে এক বীজের জগৎ...
আলো খেয়ে একা থাকতে হয়...

আগামী জন্মের জন্য উদ্ভিদের মৃত্যু লিখি।

মাটি থাকে সম্ভাবনাময়...

একটি স্বপ্ন -- বিভাস রায়চৌধুরী

লাল ঘোড়া ছুটে যায়
            নীল মানুষের দিকে ...
নিজেকে একলা লাগে!

এবারের কথা বলছি না।
পরের বার ভালবাসবে তো?
যদি অসম্ভব আসে আকাশের জানালায়?

আজ স্বপ্ন উচ্চারণহীন।

লাল ঘোড়া ছুটে যায়
            নীল মানুষের দিকে ...

আমি তো প্রান্তরহীন।
ধুলো-টুলো মেখে দেখলাম,
কবিতার বাইরে এল আশ্চর্য কবিতা ...
কান্নার ওপাশে আজ
                        নির্জন অভূতপূর্ব কান্না ...
ভিজে-যাওয়া বালি আয়নার মতো
                        চকচক করছে!

লাল ঘোড়া আর নীল রঙের মানুষ
            নিজেদের মধ্যে কত বাক্য বানিয়েছে।
শুধু আমি নেই ?
            আয়না ভেঙে ঘুম মৃত?

এবারের কথা বলছি না।
পরের বার ওষুধ খেয়েছ?
            বিষণ্ণ হতে ভোলোনি তো?


যতদিন আসবে না ভোর
(কামদুনি-র মেয়েটির মৃত্যু মনে রেখে)  -- বিভাস রায়চৌধুরী

ছিঁড়ে যেতে যেতে আর
মুছে যেতে যেতে
ওই
    মেয়েটি গোঙায়!

আমাকে নীরব দেখে
সমস্ত কবিতা মরে যায়...

সব শব্দ শেষ হলে
বুক জুড়ে ভেঙে পড়ে
                  ভূমি...

আমার প্রেমিকা, শোনো,
আমি তো পারিনি,
যতদিন আসবে না ভোর
              মৃতদেহ আগ্‌লে রাখো তুমি!


ভাটিয়ালি -- বিভাস রায়চৌধুরী

বুকের ভেতরে গান... আছে আছে পাখিদের বাড়ি
বুকের ভেতরে ডিঙি... আমি কিন্তু মাঝি হতে পারি

বুকের ভেতরে রাগ... তুলে দিই সব কাঁটাতার!
রক্ত দিয়ে মুছে দিই দেশভাগ, এপার-ওপার

বুকের ভেতরে তির... ভাষাব্যাধ হয়ে পাহারায়
রাত্রিদিন জেগে থাকি, চোখ লিখি রোজ কবিতায়

বুকের ভেতরে চোখ... চোখে চোখে বাংলাভাষা বীর
বর্ণমালা জুড়ে আছে কত কত শহিদশিবির

কত কত ভাঙ্গা পাড়... কত বজ্র... কত ঘুর্ণিঝড়...
মাথাভরতি স্বপ্ন আর কুলুকুলু বাঙ্গালীর স্বর

বুকের ভেতরে আমি আগলে আগলে রাখি ভাঙাবুক
ভাঙা বাংলা জোড়া লাগলে সেরে যাবে আমার অসুখ...


কুঞ্জবন -- বিভাস রায়চৌধুরী

এক-আধটা চুমু ওড়ে, বেশি বেশি ঝগড়া-ঝাটি হয়
মনে আছে আমি তোর দুষ্টু দুষ্টু লালন ফকির?
মনে আছে আমাদের বাংলাভাষা ঘুঙুর-পায়ে ‘ঝুম্‌’...
এক-আধটা চাঁদ অড়ে, বেশি বেশি আকাশ কুসুম
সখী, এই কুঞ্জবন দিগন্তের রং মিলেমিশে
যুগে যুগে জাতিস্মর, যুগে যুগে প্রেমের বাগান
সখী, এই কুঞ্জবন পাত্র চাই- পাত্রী চাই মুছে
হয়ে উঠতে পারে আলো, প্রেমানন্দে জাগা বাংলাগান

আলো সূত্রে আমরা পাখি, আলো সূত্রে আমরা রোজ ভোর
দুই পাখি উরে যাচ্ছি শূন্য থেকে পেড়ে আনতে ভাষা
ঝলসে যায় ডানা, তবু মুখ থুবড়ে কখন পড়ব না
গান আনছি ঠোঁটে ঠোঁটে, কুঞ্জবন ফিরছি ভালবাসা

এক-আধটা গান অড়ে, বেশি বেশি গুন-গুন চলে
সখী এই কুঞ্জবন পেয়ে গেছি চাকরির বদলে

কবিতা -- বিভাস রায়চৌধুরী

নিজেকে ভেতর থেকে প্রথমে কিছুটা উপড়ে নেবে,
নিয়ে নিজেকে প্রতিভা ভাববে, তুমি বিরল প্রতিভা।
টাটকা জখমের দাগ মুছে দেবে গাছেদের গায়ে,
ন্যাংটো গাছেদের গায়ে, ঈশ্বর তখন স্নানরত...
অস্ফুট পিপাসা পাবে, কিন্তু এই খেলা বিনয়ের!
এই খেলা সাধকের বুকের ভেতরে ঘুণপোকা!
দিনকাল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে অবিরত...
অতএব, হে শাশ্বত ক্ষত, তুমি একে কবিতাই
ভাববে, না, অন্যকিছু ভাববে, সে তোমার ব্যাপার,
আমি শুধু এই আজ অভিজ্ঞতা থেকে বলে যাই
মাথার ভেতরে গুজবের মতো আসে কবিতারা...

কিছু ঘটে অবশ্যই, বাকিটুকু শুধু রটে যায়!


বাঙালের ছেলে -- বিভাস রায়চৌধুরী

যেখানে জন্ম হয়েছে আমার সেদেশের বুকে বাংলা নেই
মা বাবার দেশে বাংলা আছেন, একুশে আছেন সগর্বেই

তাড়া খেয়ে বাবা এইদেশে এসে কুঁজো হয়ে গেল... হাপের টান...
ফুটো-সংসার মা-র হাড়েহাড়ে গান বেঁধে দেয়, ভাসান গান...

লখাই ভেসেছে, সঙ্গী বেহুলা... পুর্বদেশের জলের সুর...
মাসিপিসিদের গ্রাম ভেসে যায়, সুর নিয়ে যায় অনেকদূর

অনেকদূরের খুলনা শহর, যশোর জেলার চোখের জল
এপারের বুকে মেঘ হয়ে গেছে- গোবি সাহারার যা সম্বল...

লড়ে গেছি, ভালো খেতেও পাইনি, ভালো জামা নেই... শুকনো মুখ...
স্বপ্নে পেলেই বাহান্নকে- ভিজিয়ে দিয়েছি রক্তে বুক।

দেশভাগে থুঃ... কাঁটাতারে ঘৃণা... দিন কেটে গেছে তবু আশায়
এপারে-ওপারে আত্মীয়তায় জিভে আছে এক বাংলাভাষা

সেটুকুও যদি কেড়ে নিতে চাও, দেশহারাদের ছোবল খাও
সীমান্তদাগ পুড়িয়ে দিলাম, পারলে আমাকে গুলি খাওয়াও

রাষ্ট্র, তোমার অনেক পুলিশ?
   আমার শব্দ। শব্দ আনি!

বাঙালের ছেলে কবিতা লিখছি, এটাই আমার চোখরাঙানি।


স্নায়ু -- বিভাস রায়চৌধুরী

জলের ওপাশে তুমি
         জেগে আছো, হল্‌দে স্নায়ুগাছ ...

ফণা তোলো, ফণা তোলো, বিষ

কুয়াশা হিসেবে আমি
                মায়াবিনী জগতের দায় ...

চাঁদ থেকে খসে পড়ি ভোরের পুলিশ !


আমার সামান্য দাউদাউ -- বিভাস রায়চৌধুরী

-- গৃহস্থ

তোমার ভেতরে যাব এই উচ্চাশায়
                নিজেকে নির্জন রাখি...
                       আকাশ প্রচার করি চোখ থেকে চোখে...

ফকিরের ঝুলি থেকে
       বের করি ধুলোর ম্যাজিক...
                    শস্যদানা প্রতিটি বাক্যকে...

ধুয়ে মুছে রাখি সব

আমার সামান্য
                মহাকবিতার দিকে যাবে?
যা-কিছু লিখেছি, সে তো
                      অবসাদ, বমির প্রভাবে!

তোমার ভেতরে যাব, ভালবাসা, এই উচ্চাশায়
নিঃশেষে উপুড় করি ঝুলি...

আমাকে ফুরোতে হবে, ফের
                আমাকে কুড়োতে হবে...
তাই
   গৃহস্থকে পথের করে তুলি...


-- শিকার

আসবে, তা জানি!

শুধু কোন দিক থেকে,
                বুঝতে পারি না...

অপেক্ষা করেছি শুধু-
        এসো... এসো... এসো...
                                একবার দেখা হোক...

আমি যে বিশ্বাস করি, তুমিই ঘাতক!

যত কথা বলে ভালবাসা,
                তার বেশি কথা বলে ঘৃণা...

আসবে, তা জানি!

শুধু কোন দিক থেকে,
                     বুঝতে পারি না...

-- নৈশভোজ

সমস্ত বিশ্বাস করি

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশ্বাস

আধখাওয়া চাঁদে মাখামাখি
দেহের ঘুমন্ত গাছ...

যে-কোনও বিশ্বাস শেষে
তুমি আছো, ওগো অতিক্রম!

আমি বেঁচে থাকি...
প্রতিটি পথের বাঁকে বাঁকে
আমাকে কুড়িয়ে পাওয়া অমোঘ নিয়ম...

সমস্ত বিশ্বাস করি

প্রত্যক্ষ বিশ্বাস এই-
      চুম্বনের বুনো নাম
                                লন্ঠন হতে পারে...

পরোক্ষ বিশ্বাসে দেখি-
দু’ঠোঁটে আলোর পোকা নৈশভোজ সারে!

-- ছায়া

তোমার রাস্তার পাশে
                  আমারও একটি রাস্তা আছে

দেখা হয়ে যায় কতবার

কোনওদিন কথাই বলিনি
বিশ্বাস করেছি ভাষা বলে না কিছুই,
                                  শুধু চুপ করে শোনে...

যে-যার পথের বাঁকে তাই
হারিয়ে গিয়েছি, আর
কল্পনা করেছি একদিন আমরাও পরস্পর
                মিশে যাব কোনও এক
                                গাঢ় সড়কের প্রয়োজনে!

ততদিন ছায়া ফেলে যাই

ভালবেসে মুখ্য হোক ধুলোর নিশ্বাস!

আরও একটু স্তব্ধতার পর
পুকুর সম্পর্কে মনে হয়-
                কেউ নেই... এইমাত্র উড়ে গেল হাঁস...


-- দেবী

জগত্‌ আসলে এক একাকী আনন্দ

সরল নদীর মতো স্পষ্ট মৃদুভাষী

তোমাকে কী দেব আমি?

দৃশ্যের মহিমা থেকে
                      ক্রমে সরে আসি...


-- সময়

দাঁড়িয়ে থাকার কথা।

দাঁড়িয়েই আছি।

তোমার সময় হলে বোলো...

সম্পর্ক অপেক্ষা চায়।
ধানখেত চায় ভেজা চাঁদ।
একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হল...

জীবন কখন যে কী চায়!
দাবি-জানানোর হাওয়া এসে ফের হাওয়া...
তাকে ফিরে-পাওয়া অসম্ভব!

বিভিন্ন ভাষার গাছ
                এলোমেলো প্রকাশিত, তবু
                   চাঁদে-জলে বাঙ্ময় সব।

বলবার কথা- ‘এসো...’

বলবার কথা- ‘যাই...’

পৃথিবীর কাছে শব্দ থুয়ে যেতে হয়।

দাঁড়িয়ে থাকার কথা...
দাঁড়িয়েই আছি...
           ছোঁব বলে তোমার সময়!


তথ্য সুত্রঃ ইন্টারনেট এর বিভিন্ন সাইট, কবির ফেসবুক পেজ, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, কবির লেখা বই।
( কবিতায় থাকুন, কবিতার বই কিনুন)