আজকে যে কবির কবিতা পড়বো তার পরিচয় করে দেওয়ার আলাদা করে দরকার পরে না। শুধু পড়তে হয় আর পড়তে হয়। তাই আমার অনুভূতি থাকুক কবির কবিতাগুলো হোক কথা বলার বিষয়।
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত – জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে। ফরিদপুরের ঈশান স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে কবিকে কলকাতার “টাউন স্কুলে” ভর্তি করে দেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আই.এ. পাশকরেন এবং ১৯৫৪ সালে সিটি কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি, কলকাতায়, ক্রিকেটার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
১৯৫৬ সালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা গ্রহণ করেন এবং কারাবরণ করেন। আজীবন তিনি এই পার্টিরই (C.P.I.) সদস্য থেকে গিয়েছিলেন।
“দেশ” পত্রিকায় তাঁর কবিতা সর্বপ্রথম ছাপা হয়। তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর শেষ উপন্যাস “হলুদ নদী সবুজ বন” লিখতে সাহায্য করেছিলেন।
১৯৫৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেন এবং অনুরাধা দেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। এরপর তিনি জলপাইগুড়িতে গিয়ে আনন্দচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেখানকার চা-শ্রমিকদের বামপন্ঙী আন্দোলনে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৬৮ সালে আবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি কলকাতার সেন্ট পল কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন এবং কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র “কালান্তর” পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীতে যোগ দিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি “পরিচয়” পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “একশো প্রেমের কবিতা”, “মৃত্যুর অধিক খেলা” (১৯৮২), “নীল সরস্বতী”, “জলে লেখা কবিতার নাম”, “সমুদ্র থেকে আকাশ” (১৯৫৭), “ক্ষমা ? কাকে ক্ষমা ?”, “প্রেম পদাবলী”, “মৃত শিশুদের জন্য টফি” (১৯৬৪), “এসো রাত্রি এসো হোম”, “অমিতাভ দাশগুপ্তের নির্বাচিত কবিতা” (১৯৭৪), “আগুনের আলপনা” (১৯৮৫), “সাম্প্রতিক কবিতা”, “মধ্য রাত ছুঁতে আর সাত মাইল” (১৯৬৭), “স্বনির্বাচিত কবিতা”, “কাছে দূরে কলকাতা”, “কলকাতার মুখ”, “অমিতাভ দাশগুপ্তর শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৮৬), “ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাতকাহন”, “এসো স্পর্শ করো”, “ভালো আছো, কলকাতা ?”, “বারুদ বালিকা” (১৯৮৮), “আমাকে সম্পূর্ণ করে নাও”, “কমলালেবুর অশ্রু এসো” (১৯৯০), ছিল উদাসীন পর্যটন (কবিতা), ও উজ্জ্বল ফোয়ারার আনন্দ (কবিতা), একশো প্রেমের কবিতা (কাব্যসংকলন), আমার নীরবতা আমার ভাষা (কাব্যসংকলন), অমিতাভ দাশগুপ্ত শ্রেষ্ঠ কবিতা (কাব্যসংকলন), লোরকার শ্রেষ্ঠ কবিতা (অনুবাদ কবিতা)। এছাড়া বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে “মুখোমুখি দুই কবি”, “ছিন্নপত্র নয় ছেঁড়া পাতা”, “এত যে পাতাল খুঁড়ছি” আরও অনেক।
তাঁর অনুদিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “মাওসেতুং-এর কবিতা”, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের Venus and Adonis পদ্যের রূপান্তর “ভেনাস ও অ্যাডোনিস”। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনুবাদ করেছেন স্পেন এর কবি Federico García Lorca –র কবিতা “লোরকার কবিতা”।
“কবিতাবাসর” ও “শিলীন্ধ্র” পত্রিকা তাঁর উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত করে। কবি নিজে সম্পাদনা করেছেন “পরিচয়”, “কবিতার পুরুষ”, “সরণি” (?) প্রভৃতি পত্রিকা। আজকাল পত্রিকার তিনি একজন নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন।
আকাশবাণীর সুবর্ণ জয়ন্তীর জাতীয় কবি সম্মেলনে, তিনি নির্বাচিত কবি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে।
কবিতার উত্কর্ষের জন্য ভূষিত হয়েছিলেন নক্ষত্র পুরস্কার এবং প্রসাদ পুরস্কারে।
১৯৮৯ সালে ইন্দো-সোভিয়েত কবি সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৯২ সালে যোগ দেন সার্ক (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন) কবি সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে।
১৫ই অগাস্ট ১৯৯৪ তে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে অযোদ্ধায় গিয়ে কবি তাঁর কবিতা পাঠ করে এসেছিলেন। “আমার নীরবতা আমার ভাষা” কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার।
আবৃতি লিঙ্কঃ
https://www.youtube.com/watch?v=h_MXwyg5hnQ
https://www.youtube.com/watch?v=aJIVDEHdw1E
শেষ ঘোড়া – অমিতাভ দাশগুপ্ত
তুই সেই শেষ ঘোড়া
যার ওপর আমার সর্বস্ব বাজি ধরেছি।
একত্রিশ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
এ আমার স্পেকুলেশন।
তোমার ডাইনে সুইট ফায়ার,
বাঁয়ে ব্লিডিং হার্ট,
এক কদম পিছনে প্রিন্স কাজু,
নেক-টু-নেক ফুলমালা—
আমার একত্রিশ বছরের সুখদুঃখ
একত্রিশ বছরের চাপা ব্যর্থতাকে অধীর ক’রে তুমি ছুটছো।
হোয়াইট স্ট্যাণ্ডে বায়নাকুলার ভেঙে লাফিয়ে উঠি।
কনুয়ের ধাক্কায় উল্টে যায় জগত্সংসার।
তোমার পাঁজরের পিসটনে আমার হাঁফ্ সে ওঠা বুক
তোমার ছুটন্ত ধমনীতে আমার টালমাটাল রক্ত,
তোমার প্রতিটি গ্যালপে আমার বাদামি উরুর জলোচ্ছাস—
তোমার অসহ তারুণ্য খানিকটা খিমচে নিয়েছে আমার বয়স।
ভরাডুবির সময় তুমি লাল বয়া,
থৈ থৈ জলের ওপর পেট্রলের আগুন-জ্বালা হারেম-সুন্দরী,
মরিয়াপানার ল্যাসো দিয়ে
. চম্বলের জঙ্গল থেকে বেঁধে আনা বেওকুফ, বাত্তামিজ ঘোড়া,
কদমের চকমকিতে ফুটেছে লাল নীল ফুল,
ডাইনে হেলো না বাঁয়ে ঝুঁকো না—
ট্রাক সামাল রাখ।
পথ ভুল হলেই,
ফেন্সের ওপর রাফেল উঁচিয়ে আছে তোমার মরণ,
পথ ভুল হলেই
আস্তিনে লুকানো বক্র ছুরিতে ওঁৎ পেতে আছে তোমার মরণ,
কাঙাল হয়ে দাবি জানাই,
সম্রাট হয়ে পদাঘাত করি—
উইন চাই, উইন।
তোমার ডাইনে সুইট ফায়ার বাঁয়ে ব্লিডিং হার্ট,
এক কদম পিছনে প্রিন্স কাজু নেক-টু-নেক ফুলমালা,
মনে রেখো,
তুমি সেই শেষ ঘোড়া
যার ওপর আমার সর্বস্ব বাজি ধরেছি।
আমার নাম ভারতবর্ষ – কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত
স্টেন গানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে
চা-বাগিচায় কফি খেতে,
কয়লা-খাদানে, পাহাড়ে-অরণ্যে
লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ
খুনীর চেয়েও রুক্ষ কঠোর মাটিতে
বোনা হয়েছে যে-অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার ঠাণ্ডা মুখের ওপর
এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে
ভাক্ রা নাঙ্গালের পাথুরে বাঁধের গমেভীর ছায়া।
ডিগবয়ের বুক থেকে
মায়ের দুধের মত উঠে আসা তোলো ভেসে যাচ্ছে
আমার সারা শরীর।
কপাল থেকে দাঙ্গার রক্ত মুছে ফেলে
আমাকে বুকে ক’রে তুলে নিতে এসেছে
আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর।
আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ
প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম।
প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর
শোক নয় ক্রোধের আগুনে
দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।
ভরাট গর্ভের মত
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
বৃষ্টি আসবে।
ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝবরাবর
ঝরে যাবে বরফ-গলা গঙ্গোত্রী।
আর একটু পরেই প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর
কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত।
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুদ চুম্বনে।
ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়
সাঁওতালী মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে
জেগে উঠবে তুমুল উত্সবের রাত।
সেই রাতে
সেই তারায় ফেটে পরা মেহফিলের রাতে
তোমরা ভুলে যেও না আমাকে
যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্ জে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম
মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
. স্বদেশ
. স্বাধীনতা
. ভারতবর্ষ॥
আমার নীরবতা আমার ভাষা – অমিতাভ দাশগুপ্ত
আমার হাতে কোনও শাবল ছিল না,
বাটালিও নয়,
তবু, এতদিন তিলে তিলে গড়ে তোলা দুর্গ
এক দুপুরের বৃষ্টিতে কীভাবে ধুয়ে গেল!
আর
ওই বিশাল পাথুরে অবরোধ-ই যে আড়াল করে রেখেছিল
হার্মাদের মত এক খ্যাপা নদী,
এতকাল
. তা আমি জানতেও পারিনি।
সেই অর্গলহীন সজল
সারাদিন, সারারাত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
ওই ভেসে যাচ্ছে আমার অঙ্গদ, শিরস্ত্রাণ,
আবরণহীন ভাসতে ভাসতে
আমি চড়তে পারছি
গাঢ় দীঘিকার চেয়ে সজল তোমার দু চোখের ভাষা,
আমি শুনতে পাচ্ছি
সমুদ্রের নাভি থেকে উঠে আসা
. মারমেইডস-এর গলায় তোমার গান,
দিশেহারা, ওলোট-পালোট ঢেউয়ে
ধুয়ে যাচ্ছে আমার গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস,
জোয়ারে জোয়ারে
. এ তোমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে,
. আমার নীরবতা আমার ভাষা।
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি – অমিতাভ দাশগুপ্ত
বুকের রক্ত মুখে তুলে যারা মরে
ওপারে ঢাকায় এপারের শিলচরে
তারা ভালোবাসা-বাংলাভাষার জুড়ি—
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
সিঁদুর কুড়িয়ে নেওয়া যায় এক আলো
প্রাণের পুণ্যে হয়ে ওঠে জমকালো
সে-আলোয় দেয় মারের সাগর পাড়ি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
সে-আলো টলে না মৃত্যুর কালো ঝড়ে
তর্জনি তুলে জেগে থাকে ঘরে ঘরে,
দুলিয়ে গলায় তাজা বুলেটের মালা
পার হয়ে শত শ্মশান ও কারবালা
হাজার মুখের মিছুলে দিয়েছে পাড়ি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।
শুনুন কমরেডস – অমিতাভ দাশগুপ্ত
সব সময় বিপ্লবের কথা না ব’লে
যদি মাঝে মাঝে প্রেমের কথা বলি—
. আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস।
সব সময় ইস্তেহার না লিখে
যদি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চাই—
. আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস।
সব সময় দলের কথা না ভেবে
যদি মাঝে মাঝে দেশের কথা ভেবে ফেলি—
. আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস।
পাঁচ আর সাত নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের ভোট কম ব’লে
সেখানকার মানুষ রাস্তা পাবে কি পাবে না— জানতে চেয়েছিলাম।
আমার জিভ কেটে নেবেন না।
পার্টির ছেলে নয় ব’লে
ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস চন্দন
কাজটা পাবে কি পাবে না— বলতে চেয়েছিলাম।
আমার নাক ঘষে দেবেন না।
দাগি বদমায়েশ
আমাদের হয়ে উর্দি বদল করলেই
রেহাই পাবে কি পাবে না— বলতে চেয়েছিলাম।
আমায় জুতোয় মাড়িয়ে যাবেন না।
বিশ্বাস করুন কমরেডস
আমি দলছুট নই বিক্ষুব্ধও নই ;
বিশ তিরিশ চল্লিশের গনগনে দিনগুলিতে
কমরেড লেনিন থেকে প্রিয় হো চি মিন
আমাদের যেসব কথা বলেছিলেন,
এই শতকের অন্তিম দশকে দাঁড়িয়ে
আমি স্রেফ সেই কথাগুলো
সেই সব আহত, রক্তিম অথচ একান্ত জরুরি কথাগুলো
আপনাদের সামনে
সরাসরি তুলে ধরতে চাই।
জানতে চাই
অবিশ্বাস আর ঘৃণার
ছোট ছোট জরজা জানালা ভেঙে
আমরা কি একবারের জন্যেও
সেই বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর গিয়ে দাঁড়াতে পারি না
যেখানে
সূর্যের আলো
সব জায়গায় সমানভাবে এসে পড়ে ?
কাল সারারাত – অমিতাভ দাশগুপ্ত
কাল সারারাত
একটা ছেলেকে ফলো করতে করতে
আমার স্বপ্ন ক্লান্ত হয়ে গেছে।
গোড়ালি-ছেঁড়া পাজাম
আর মভ্ রঙের পাঞ্জাবি পরা
সেই ছেলেটির মুখ কখনো দেখা যায় নি।
স্রেফ ঐটুকু জায়গা
সে ছায়া দিয়ে সব সময় চেপে রেখেছিল।
আর, আমরা তো সকলেই জানি,
কারো মুখ না দেখতে পেলে
তাকে নিয়ে কবিতা লেখা কতখানি মুশকিল
তবে
. ঐ ছেলেটির ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।
তার ঠোঁটে গুনগুন করছিল
আমার একটির পর একটি
. প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত।
আবার
. তারই গলার লী লী আগুন ঝলসে উঠছিল—
‘অব মছল উঠা হ্যায় দরিয়া হা’,
‘ভাই সাবধান বড়ি আ তুফান’,
‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না
নিগ্রো ভাই আমার, পল রোবসন।’
ওর শরীরের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল
মেঘ, পাখি আর লোহার গরাদের ছায়া।
একটির পর একটি ফ্রেম ভাঙতে ভাঙতে
শিকারী কুকুরের কালো দিগন্তরেখা পেরিয়ে
কি অবলীলায় চলে যাচ্ছিল ছেলেটি।
গাঢ় জঙ্গলের বুকচেরা পথে
গোয়েন্দার টর্চের মত তার পিছনে ছুটতে ছুটতে
একসময় চিত্কার করে উঠলাম
—হল্ট!
সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ব্লাস্টিং-এর শব্দ,
বারুদের ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারপাশ,
পাহাড়ের কলজে-ফাটানো গলায় সে গর্জে উঠলো—
আমি আসছি।
অথচ কাল সারা স্বপ্ন চেষ্টা করেও
তার মুখ দেখতে পাইনি আমি।
আর আপনারা তো সকলেই জানেন
কারো মুখ দেখতে না পেলে
তাকে নিয়ে কবিতা লেখা কতখানি মুশকিল।
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল – কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
দুই ঠোঁট ছিঁড়ে নাও,
চোখের কোটর থেকে নীলপদ্ম তুলে নাও,
নিষিদ্ধ দেরাজ থেকে তুলে নাও বক্র ছুরি-ছররা-কার্তুজ।
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
পিকাপে চকিত দেখা রূপস চিতার আলোড়ণে
তোমার শাড়ির ডোরা, হেডলাইট ছুটেছে অস্থির,
ভুটানি মদের গন্ধ খোলা চিলে,
তোমাকে চুম্বন করলে সমুদ্রের নীল জল ভয়ঙ্কর ফুঁসে ওঠে,
খাঁড়ির গর্জনে গ্রীবার সটান ভঙ্গি—
নাভির পাতালে তুমি প্রতি রাত্রে গুম করো একটি যুবক।
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
চোখ দুটো দৃষ্টি রাখছে চোখের ওপর
হাত দুটো দৃষ্টি রাখছে হাতের ওপর
গোপন গহ্বর খুলে উবু হয়ে বের করো রেশমের ফাঁস
তুমি বিশালাক্ষী, তুমি মৃত্যু, নীলতারা,
হঠাৎ সশব্দে ফেটে বুক মুখ জ্বেলে দাও ঈর্ষার অ্যাসিডে!
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
এত সরলতা
স্টোভের বুকের পরে নীল ফুল হয়ে বসে থাকা
লাল রিবনের ঘূর্ণি মহল্লায় মহল্লায় ছোরা-চালাচালি
করুণ শাখার মতো কৃশ হাত কতকাল ছুঁইনি তোমাকে
ঘুমের ভিতরে নির্বাসন-দণ্ড দিইনি তোমাকে
শুয়োরের গন্ধে ম ম শালবন—
খয়েরি ফিতার টানে ছুটে যায় লাটাগুড়ি, চালসা ফরেস্ট।
কিছুটা সময় আরো
রুদ্র সাগরের তেল হু হু করে জ্বলে যাচ্ছে
ত্যাপিটালে শব্দ তুলে কেটে যায় হাজার মাইল
স্টিয়ারিং জেদি ঘোড়া অবাধ্য গিয়ার-বাক্সো ব্রেক ধরছে না . . .
এই বেলা
টান টান উঠে এসো,
ঘন ঘন দন্তের পীড়নে
ওষ্ঠপুটে ফোটাও প্রবাল,
এই বেলা
ছোখ মুখ খুবলে নাও
. ট্রিগারে তর্জনি রাখো জ্বালাও মাইন
কিছুটা সময় আরো
মধ্যরাত ছুঁতে আর সাত মাইল . . .
. পাঁচ . . .
. চার . . .
. তিন . . .
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ – কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত
ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!
চরায়-বড়ায় খই ফুটেছে তপ্ত খোলা
পাথর মাটি পাথর,
গোয়ালে গাই বিইয়েছে
তার দুধ বাঁটে নেই এক পো,
পুকুর-নদীর জল শুকিয়ে বাষ্প,
কোলে কলসি, কাঁখে কলসি কাতার কাতার
ছা বৌ জোয়ান মদ্দ ভাতার
চলছে চলছে—
এক মূকাভিনয়
তার খেজুরের মাথার ওপর খাঁড়ার মতো দাঁড়িয়ে দ্যাখে
অলপ্পেয়ে সময়।
ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!
লে লে ছে আনা লে যা লিবি ছে আনা
আমি রাজার ভাতিজা—এসেছি সদর থেকে
গাঁও বুড়ো থেকে ঘরের ঝিয়ারি,
বাল-বাচ্চাও শুধোয়—
তুমি কোঁচড়ো এনেছো কি ?
এনেছি—এনেছি প্রতিশ্রুতি।
আমি এনেছি টি আর, জি আর
সেচ প্রকল্প, সার, গোরু,
আমি ছ’হাজার নলকূপে
জলে নদী করে দেব মরু।
এই আমিন, এদিকে এসো,
ওরা যা বলে, সবটা টোকো
খুব ভালো করে মাপো-জোকো
যত দাবি আছে মোটা সরু—
আমি ছ’হাজার নলকূপে
জলে নদী করে দেব মরু।
হাড়ের ওপর মাই কামড়ে
টিংটিঙে প্যাকাটি—
ফটো খিঁচুন প্রেস,
মজা পুকুরে পেট ফুলো ঢোল
শ্যামলী ধবলী—
ফটো খিঁচুন প্রেস.
এমন মাটি মায়ের আঁচল
এখন গর্ত-খোদল-ফাটল,
ছাতিফাটার মাঠ
হা হা খিদে দিচ্ছে ঝাঁট,
মুখে মুখোশ এঁটে নিস,
হিস্ হিস্ হিস্ হিস্
জমি-জিরেত জ্বালিয়ে
ধা ধা কালকেউটের বিষ।
হট্ যা হট্ টিয়ে টা
এই সিরিঙ্গী মেয়েটা
ওর মা মরেছে আটষট্টির বন্যায়
বাপ এ সনের খরায়,
ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছিঃ
ও যে যমের অরুচি!
খো খো – অমিতাভ দাশগুপ্ত
মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়.,
বিকেলে খেলে খো খো,
বনগাঁ থেকে বার্লিনে যায়,
সাধ্যি থাকে রোখো।
মেয়ের বাবা সকাল-সন্ধে
চৌমাথাতে হকার,
ছোট বোনটি ফাইভে পড়ে,
এখনও দাদা বেকার।
তবুও খো খো খেলুড়ে মেয়ে
লড়ছে এমন লড়াই
তাকে নিয়েই দেশসুদ্ধ
আমজনতার বড়াই।
হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম
সিয়ারামের খেলা
খেলতে খেলতে সাঁঝের কোলে
গড়িয়ে আসে বেলা,
ভাতের গন্ধে লাফিয়ে ওঠে
খিদের নাড়িভুঁড়ি
বালিকা তবু উজানভরা
স্বপ্ন করে চুরি,
মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়,
বিকেলে খেলে খো-খো
খেলার পাতায় সেই মেয়েটির
স্বপ্ন ছেপে রেখো।
এসো স্পর্শ করো -- কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত
. এসো।
. ছোঁও।
সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গেছি কিনা, দ্যাখো।
পাথরের বুক থেকে মাংস নাও,
পাঁজরের রিডে রিডে চাপ দাও দশটি আঙুলে,
. আমাকে বাজাও তুমি
. বিঠোফেন-বালিকার হাত,
. বলো—
. আমি প্রত্ন নই,
. নই অন্ধ, জমাট খনিজ,
. বলো—সব শেষ নয়,
এখনও আমার কিছু সম্ভাবনা আছে।
টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
. মেটেনি কুসুম।
ভুল চাওয়া নিয়ে গেছে ভুল সিন্ধু পারে।
সেখানে মুখোশ, পরচুলো
বালির সাদায় ওড়ে দূরতম হাসির মতন,
গাঢ় শোচনার রঙে সন্ধ্যা নামে,
ডেকে ওঠে হাড়গিলে, অসুখী শকুন—
টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
. মেটেনি কুসুম।
. দ্যাখো,
কতখানি দীন হয়ে গেছি আশায় আশায়
. কত বেশি পেতে চেয়ে
নিজেকে ভেঙেছি অন্ধ, ভ্রুক্ষেপবিহীন,
ছেঁড়া শিমুলের আঁশে উড়িয়েছি সর্বস্ব আমার,
. ‘দাও’ ‘দাও’ হাহাকারে
কখন উঠেছে জেগে বৈজুনাথ—প্রধান চণ্ডাল ;
. সুনীলে পাতালে
. এখন যে দিকে চাও
ব্যথিত প্রশ্নের হাড়, করোটি, কংকাল!
. মকরবাহিনী-জলে
পোশাক ভাসিয়ে আজ এসে দাঁড়িয়েছি—
. স্পর্শ করো,
অগ্নিতে সঁপেছি স্বাহা, অহংকার,
. রাখো, ভাঙো মারো,
তুলনামূলক প্রেমে সারারাত জেগে থাক
. আমাদের কাঠ ও করাত,
. আমাকে বাজাও তুমি
. বিঠোফেন-বালিকার হাত।
একদিন হবে -- অমিতাভ দাশগুপ্ত
আজ নয় ৷ কালও নয়
একদিন হবে ৷
সেদিন তুমি বা আমি কেউ থাকব না ৷
তবু হবে ৷
সব রক্ত আর জল মিলে মিশে প্রণামের মত
রক্তিম ভোরের দিকে যাবে ৷
আজ নয় ৷ কালও নয় ৷
তবু জেনো, একদিন হবে ৷
তখন আমার ছেলে ছুঁড়ে ফেলে হননের ছুরি
নীল অন্ধকারে
তোমার মেয়ের বুকে খুঁজে পাবে সঠিক কস্তুরী
গোপন প্রহরে,
একাকার হয়ে যাবে ধান আর গান,
সাগরে পাহাড়ে বনে
আলো দিয়ে লেখা হবে মানুষের নাম,
অর্থ পাবে সব ভালোবাসা,
এক হাঁটু জলে ডুবে যাবে না তো একবুক আশা,
আমাদের এত মেধা এত শ্রম ঢালার গৌরবে
আজ নয়, কালও নয়,
যা চেয়েছি — একদিন হবে ৷
জীবনবাসনা - অমিতাভ দাশগুপ্ত
ধান কাটা শেষ। রিক্ত মাঠে উড়ছিল খড়কুটো,
বাঁচার জন্য বছর ছিল একটা কিংবা দুটো,
অর্থবিহীন ভালোবাসায় সে সব জড়ো করে
দাঁড়িয়েছিলাম কপালখাকি বিশাল তেপান্তরে।
খরিশ সাপের শিসের শব্দে ঘনিয়ে এল বেলা,
গলায় আমার দুলিয়ে দিয়ে গুন্জা ফলের মালা
কারা বলল; চলো,
যাওয়ার আগে যা বলতে চাও, অল্প কথায় বলো।
কেমন করে? আমার কোনও কথাই হয়নি শুরু!
সময় কোথায়-খেঁকিয়ে ওঠে প্রবীণ মারাংবুরু,
কষ বেয়ে তার রক্ত গড়ায়, কপালে রাজটিকা,
শীর্ণ হাতে বিছিয়ে দিল নিকষ যবনিকা,
ঘন্টা বাজার আগেই শহর এক লহমায় নিলাম-
বাঁচার জন্য একটা-দুটো বছর চেয়েছিলাম।
তথ্যসূত্র ঃ কবির লেখা কবিতার বই ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট প্ত্র পত্রিকা।
( কবিতা পড়ুন, কবির ভালোবাসুন, কবিতার বই কিনুন)