আমি আলোচনাটা পাঠকনামা নাম দিয়ে দেতে পারতাম; কিন্তু, কবি বিনয় মজুমদার এর কবিতা নিয়ে লেখা এক অধ্যায়ের পাঠকনামা দিয়ে সম্পূর্ণ করতে পারবো না তাই, একটু অন্য ভাবে এই লেখা আমার একটু ছন্নছাড়া, একটু বেখেয়ালি কবিতা যাপন, বিনয়যাপন।  

"ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় –
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।"
(ভালোবাসা দিতে পারি)

এতটা আবেগ এতটা হাহাকার কবিতায়; প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন এক মনে উচ্চারিত হয়; এ যেন বসে থাকা নিজেকে উন্মুখ করে বসে থাকা কবিতার জন্য ...

কবি বিনয় মজুমদার মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো নামক শহরের। বাবা বিপিনবিহারী মজুমদার, মায়ের নাম বিনোদিনী; তারা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট।

যিনি বলতে পারেন," আমি যা লিখছি সে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু এখন আমার কোনো পাঠক না থাকলেও চলবে।"  

১৯৪২ সালে তাকে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তাকে বৌলতলী উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় তারা সপরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে আসেন। এখানে, ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে ক্রিক রো-রতে অবস্থিত মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউট (বউবাজার ব্রাঞ্চ)-এ নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবার পরে, ১৯৫১ সালে আইএসসি (গণিত) পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করেন।

"কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।"
(কবিতা বুঝিনি আমি)

জানিনা যারা বলেন তারা কবিতা বোঝে তারা এ কবিতা বুঝতে পারবেন কিনা? আমি অন্তত পারিনি; বলা চলে এক বারে পারিনি। বার বার পরেছি, বার বার অন্য ভাবে উপলব্ধি করেছি ... বলা চলে এখনো করছি। এই অনুভব কোন বাংলার মানে বইতে লেখা কবিতার মর্ম উদ্ধার নয়, শব্দের পর শব্দের মানে বসিয়ে সোজা গদ্যের লেখা নয় এ ... অনুভূতি কবিতার ... সবার থেকে আলাদা

তৎকালীন বাংলার বোদ্ধা, কবি ও প্রতিষ্ঠান তাকে ‘পাগল’ আখ্যা দিলেও, স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তাকে জীবনানন্দ পরবর্তী উজ্জ্বল কবি হিসেবে সাদরে প্রতিষ্ঠা করে গেছে। কবিতায় তুলে ধরেছেন তার যাপনের নানা অভিজ্ঞতা, আশা-ব্যর্থতা, অনুরাগ-আবেগ, প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তির বিভিন্ন রং। অনেকে কবিতাগুলো কে আত্মমুখিনতা বললেও কত বার কবিতা পড়তে পড়তে নিজেকে কবির শব্দের কাছে উন্মুক্ত করেছি তা শুধু আমিই জানি।

"শিমুল গাছের নিচে গম ক্ষেত দেখলাম আজ।
পুরো গম ক্ষেতটিই বাদামি রঙের, তাতে অন্য রঙ নেই
দেখে দেখে মনে হয় ক্ষেতে গম পেকে গেছে প্রায়।"
(শিমুল গাছের নিচে)

কবি তার লেখায় এক জায়গায় বলছেন," কলেজে পড়ার সময় ভাবতাম কিছু বিষয়বস্তু কাব্যকি আর কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক নয়। এখন আমার মনে হয় ব্যাপারটা তেমন নয়। সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক যার দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পরে তিনিই কবি।"

মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে।
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা
কি ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কি অস্ফুট স্বর, শোনো
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিতহও।
সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরাকত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!
(মুকুরে প্রতিফলিত)



দেবভাষার ব্যাকরণ অনুসারে মানুষসৃষ্টি করা হয় । দেবভাষার ব্যাকরণ একখানা ‘সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী’ । পাঠক দেখুন দেবভাষায় একটি শব্দ নেই ‘মনোলীন’ শব্দটি নেই । শব্দরা সব দেবদেবী । দেবভাষায় মনোলীন শব্দদেবতাটি নেই । এইবার আমি মনোলীন শব্দটি লিখছি । তাহলে ভবিষ্যতে মনোলীন শব্দদেবতাটি সৃষ্টি হবে – দেখতেহবে মানুষের মতো । দেবভাষার ব্যাকরণে ‘গদাধর’ শব্দটি আছে । কিন্তু ‘গদাধরা’ শব্দটি নেই । তাহলে ‘গদাধরা’ শব্দদেবীটিকে বানানো সম্ভব । গদাধরা শব্দদেবীটির চেহারা মেয়েমানুষের মতো ।
(মানুষ)

ক্রমশ ...

ঋণ স্বীকার ঃ কবির কবিতার বই, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, আলোচনা, বিভিন্ন ওয়েব সাইট।