কবি ফারহীন ন্যান্সি তাঁর ‘ প্রশ্নের উত্তর চাই – আমাকে উত্তর কে দেবে?' শীর্ষক কবিতায় অনেক প্রশ্ন রেখেছেন যার উত্তর তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। যেমন তিনি প্রশ্ন রেখেছেন যে সত্য- অসত্য, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ভালো-মন্দ, পবিত্র-অপবিত্র, ধর্ম-অধর্ম, প্রিয়-অপ্রিয়, ন্যায়-অন্যায়, আচার-বিচার, বিধান, রীতি, নীতি এগুলো কি?
কবি যে প্রশ্নগুলো আসরের মাধ্যমে রেখেছেন তা অসাধারণ। কবি কিছু কিছু উত্তরও নিজেই দিয়েছেন সে উত্তরগুলোও যথার্থ। সমস্ত প্রশ্নের অভিধানিক অর্থ নিশ্চয়ই কবি জানতে চান নি।। জানতে চেয়েছেন সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা এবং তা কতদূর অর্থবহ করে। সেই সব শব্দের যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কবির অধিকাংশই প্রশ্নই সমাজ, দেশ, কাল ও জীবনধারার সাথে যুক্ত। সমাজ ও দেশ আজকের সৃষ্টি হলেও জীবকূলের সৃষ্টি বহুকাল আগেই যা আমরা সকলেই জানি। বিভিন্ন শব্দের সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে। প্রয়োজনের তাগিদে পরিস্থিতি ও অবস্থান বোঝানোর জন্যই শব্দের উৎপত্তি ও ব্যবহার। কালে কালে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে শব্দের ব্যবহারেও পরিবর্তন ঘটেছে।
তবে এটাও ঠিক তথাকথিত সেই সব শব্দরাই আমাদের মাঝে যাকে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য থাকি একই ধারায় থাকার জন্য। আমি আমার মতো করে ভাবতেই পারি, সেখানে আমার ভাবনা অন্যের নিকট অর্থবহ নাও হতে পারে। তার জন্য দায়ী আমরাই। সর্বপ্রথম নিজের পরিবার যেখানে নিজস্ব ভাবনা চিন্তার মৃত্যু ঘটে। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষাই আমাদের সঠিক জীবনধারণের অন্তরায় হয়ে ওঠে। এভাবেই ত্রুটিপূর্ণ মানুষ, পরিবার ও সমাজ গড়ে ওঠে যার আমিও একজন সদস্য। তা নাহলে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, কোনটা ধর্ম কোনটা অধর্ম আমাকে যেভাবে শিখিয়েছে আমি সেভাবেই জানি। সমস্যা হল তাঁর যার আসল সত্যটা জানা হয়ে গেছে।
একটা শিশু যখন জন্মায় সে শুধু চিৎকার করে কষ্ট প্রকাশ করার জন্য। সে কোনো নাম, ভাষা, ধর্ম সাথে নিয়ে আসে না। জন্মে সবাই এক, কর্মেও আমরা অনেকেই এক। যেমন আমি হাত দিয়ে মুখে খাবার তুলি, পা দিয়ে হাঁটি, জল দিয়েই স্নান করি, মুখ ও নাক দিয়েই প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নেই এবং অপ্রজনীয় বিষাক্ত বায়ু বর্জন করি। আবার গতর ভেঙেই উপার্জন করি ও বেঁচে থাকার খাদ্য পাকাই। বয়স বাড়লে ক্ষমতা কমে যায় অক্ষম হয়ে পরি। এগুলো তো চরম সত্য। এখানে তো নিশ্চয়ই কোনো বিভেদ নেই? তবুও আমরা চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করে অনেক দূরে সরে যাই। যেখানে মানবধর্ম থেকে জন্ম লগ্ন থেকেই শিশুকে সরিয়ে দেওয়া হয় অন্য আরেক আমাদেরই সৃষ্ট ধর্মের মধ্যে। আমরা আমাদেরকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার প্রয়াসে লেগে পরি। এই বিভেদের গুরু দায়িত্ব যে বা যারা নিয়েছিল তাঁদেরকেই আমরা গুণীজন এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে কিংবা ধর্মীয় গুরু তদুপরি ভগবান, আল্লাহ বা গড হিসেবে উল্লেখ করি এবং তাদের পথ অনুসরণ করি। আর এইভাবেই নিজেদের মধ্যে নিজেরা বিভেদের বেড়াজাল তৈরি করে রাখি। আমরা অতি সহজ সত্যটা যা সকলের মধ্যে সমানভাবে বিস্তারিত যা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি এবং যা প্রাকৃতিক ভাবে এই প্রকৃতি থেকে লাভ করেছি তাকে উপেক্ষা করে মর্যাদা না দিয়ে অন্যকে শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে বসিয়েছি এবং মহৎ হিসেবে গ্রহণ করেছি। সেখানেই আমাদের পরাজয়। আজ আমরা যাকে ধর্ম বলে আখ্যা দিয়েছি তা প্রকৃতপক্ষে অধর্মেরই পথ কিন্তু আমরা তবুও বলপূর্বক ভাবে সমাজকে এবং সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছি। আমরা কি তাহলে সঠিক পথে উত্তরন করছি? কেই-বা ভাবে এই সমস্ত কথা। সকলেই একই রকম ভাবে গতানুগতিক রাস্তায় গড্ডালিকা প্রবাহে অবতরণ করছে। আমাদের উচিত যারা আমরা প্রত্যেকে চরম সত্যটা অনুধাবন করতে পেরেছি সেই পথ থেকে বিমুখ হওয়া এবং অপরকেও সঠিক পথে পরিচালনা করা। ধর্ম আমাদের একটাই সেখানে ছোট বড় জাতের ভেদাভেদ থাকবে না। এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয় যে অধর্ম ধর্মের নামে সমগ্র পৃথিবীতে রাজ করছে। আর আমরাও যারা নিজেদেরকে মহান জ্ঞানী বলে জানি তারাও সেই অধর্মের পথে অবতরণ করছে এবং সমগ্র মানবজাতিকেও সেই দিকে পদার্পণ করাচ্ছে। আজ সেই অধর্মের জয়। আমরা সেখান থেকে নিজেদেরকে সঠিক পথে চালনা করতে অথবা সঠিক পথ গ্রহন করতে অক্ষম। তারপরে আসে অন্যান্য ন্যায় অন্যায় ভালো মন্দ ধনী-দরিদ্র্যের কথা। সমস্ত বিভেদের সৃষ্টির মূল উৎসই সেখান থেকে। তাঁর নির্মূলীকরণ না করে ছোট ছোট পথগুলো ধংস করে অপরাধ দমন সম্ভব নয় কারণ গুন্ডাবাজকে বাঁচিয়ে রেখে কয়েকজন গুন্ডার নিধন করে কখনোই গুন্ডাবাজ নির্মূল করার প্রচেষ্টা অনর্থক হয়ে যায়। পৃথিবীতে যত অন্যায় ঘটনা ঘটেছে তা এই ধর্মের প্রচারের ফলেই ঘটেছে এবং লক্ষ লক্ষ মানবের নিধন ঘটেছে। আমরা সে কথা অস্বীকার করতে পারি না। শুধুমাত্র কিছু সাধারণ কথা যেমন অধর্মের পথ অবলম্বন করেছে, তার কর্মের ফল এসব চিরাচরিত প্রথার মতো মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে মূলতঃ নিজেদেরকে অথবা নিজেদের ভুল পথকে অস্বীকার করি যা অনুচিত।
কবি যে সব শব্দের উত্তর খুঁজে চলেছেন এক কথায় সব কিছুই আপেক্ষিক। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোন কিছুই স্থির নয়, সবকিছুই চলমান এবং সবকিছুই আপেক্ষিক। এখানে শুদ্ধতা বিশুদ্ধতা বলে কিছুই নেই। আছে শুধু আকর্ষণ বিকর্ষণ যেটা আমরা ভালো মন্দ সাদা কালো ছোট বড় কমবেশি এই সমস্ত যুগল শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমি যা দেখছি তা কোনো কিছুই সত্য নয়। এই সমস্ত কিছু আপাতদৃষ্টিতে আছে। এগুলো শুধু কতগুলো আত্মার অথবা অস্তিত্বের বিভিন্ন রূপভেদ। আমি যা দেখছি তা কি সত্যিই দেখছি? কিছুদিন পরে সে আমার দৃষ্টি থেকে হোক বা আমার আগামী দৃষ্টি থেকেই হোক একদিন ঝরে পড়বে। আমাদের শুধুমাত্র রূপভেদের পরিবর্তন ঘটে। কোন কিছুরই সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না প্রকৃতপক্ষে। যা আছে তা থাকবে। আমি দেখছি তা হয়তো নাও দেখতে পারি কারণ পরিবর্তনটা বাহ্যিক রূপের আভ্যন্তরীণ নয়।
কবি কোন এক কবিতায় বলেছেন প্রাণীদের মধ্যে মানুষই হলো শ্রেষ্ঠ জীব এবং অন্যান্য জন্তুদের থেকে আমরা অনেক ঊর্ধ্বে প্রতিস্ঠিত। কবি ঠিকই প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের যারা এই ধারণার বিশ্বাস রাখে। আমরা হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে কোন কোন পশু থেকে অনেকটা এগিয়ে এবং তাই এই সভ্যতা মানব সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, প্রাণী সভ্যতা হিসেবে নয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে বহু প্রাণী আছে যাদের অন্যান্য সমস্ত গুনাগুনের থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। সেখানে আমরা তাদের কাছে পরাজিত। সাইবেরিয়া থেকে বহু পাখি অন্যান্য দেশে পাড়ি দেয়। কত পাখি তারা কত সুন্দর ভাবে তাদের বাসা বানায় অথচ আমরা যারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে দাবী করি তার সিকি ভাগের এক ভাগও করে উঠতে পারিনি। ডলফিন কত দূর থেকে পথ অতিক্রম করে আবার যথাস্থানে ফিরে যায়। আমরা মানুষ কি তা পেরেছি। আর পারবও না কারণ আমরা অধর্মের পথে বিচরণ করছি। অনেক পশু হয়তো আমাদেরকেই অশিক্ষিত বা বোকা ভেবে সম্বোধন করে। আমরা তা অনুভব করতে পারি না। তা কে জানে। আমরাতো ক্ষুদ্রতম ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কাছেও পরাজিত। তাহলে নিজের সম্পর্কে নিজে ঢাক পেটানো ছাড়া আর কিছুই কি?
আমি জানি আমার এই মতামত সর্বজনে সমাদৃত হবে না । শুধুমাত্র এক দুজনই গ্রহন করবে সেকথা ভেবেই প্রকাশ করলাম। হাজার হাজার বছরের অহংকার কি একদিনে হারানো যায়? কুৎসা বদনাম ছাড়া অন্য কিছুই আশা করি না । তবে প্রিয় কবির থেকে অনেক আশা রাখছি। কবিকে জানাই অনেক ধন্যবাদ। অন্য কোনো প্রতিশব্দ পেলাম না বলেই আপেক্ষিক শব্দের ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম।