হে স্বাধীনতা! কতকাল তোমার অপেক্ষায় থেকেছি,
মুখিয়ে থেকেছি সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার সভ্যতা থেকে,
আমি হেঁটে এসেছি কয়েকশো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল,
হাঁটতে হাঁটতে আমার পায়ে কড়া পড়ে গেছে
স্বাধীনতা তুমি কোথায়?
হে স্বাধীনতা! তোমার জন্যে কত লক্ষ লক্ষ বীর সন্তান শহীদ হয়েছে,
গর্বে ভরে উঠেছে সন্তানসম্ভবা কত মায়ের বুক।
হে স্বাধীনতা! তোমার অপেক্ষায় দিন গুনেছে কত সন্তানহারা মায়েরা,
বারবার তারা গর্ভধারণ করেছে তোমাকে পাবার আশায়,
কতবার তারা প্রসব যন্ত্রণাকে মাতৃমুক্তির বন্দনারূপে প্রাণে আগলে রেখে স্বীকৃতি দিয়েছে,
তোমার দিকে তাকিয়ে কত মায়েরা তাঁদের সন্তানকে নিক্ষেপ করেছে স্বাধীনতার বিপ্লবী সগ্রামের আগুনে,
কত কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে গেছে দিনের পর দিন,
তবুও তার মুখে উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকাশ নেমে এসেছে তোমাকে পাবার নেশায়,
কত কৃষক তাঁর হৃদয়ের থেকেও প্রিয় ভিটেমাটি ছেড়ে নেমে এসেছে রাস্তায়,
কত মুটে কুলি-মজুর কত বিদ্ধার্থীরা কত প্রেমিক- প্রমিকা তাঁদের বর্তমান বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র স্বাধীনতা শব্দটিকে আগলে ধরে।
হে স্বাধীনতা তোমাকে পাবার নেশায় শত শত মাইল হেঁটে পাড়ি দিয়েছে নিরুদ্দেশে কতবৃদ্ধ কত মা-বোনেরা - সেই আঁধারঘুজি পথে আলোকবর্তিকা ধরবে বলে,
কোনো উত্তাল সমুদ্রের মাঝে দিশেহারা নাবিকের মতো আজও তারা ফিরে আসেনি, সুদূর নীলিমায় নক্ষত্র খসে গেলে যেমন আর ফিরে আসে না,
ঠিক সেরকমই তারাও হারিয়ে গেছে কোথায় তাদের জীবনকে বাজি রেখে
- শুধুমাত্র তোমার জন্য
- শুধুমাত্র তোমার জন্য।
হে স্বাধীনতা! যারা তোমায় আলিঙ্গন করেছে হৃদয় দিয়ে,
সমস্ত সম্পত্তি বেচে হয়েছে নিঃস্ব,
যারা তাঁদের সন্তানকে আহুতি দিয়েছে তোমাকে ভালোবেসে,
সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের সৈনিকের মতোই নির্বাসনে থেকেছে,
তোমার আহবানকে স্বাগত জানিয়েছে অশ্রু-হারা হৃদয়ের সাথে,
তুমি এসেছ তাদের জন্য - শুধুমাত্র তাদের জন্যই -
তাঁদের আত্মবলিদানের কথা মাথায় রেখে।
আজ চেয়ে দেখো- হে স্বাধীনতা! তুমি এসেছো তোমার স্বাধীকারের রূপ নিয়ে, সকলের সাম্য-অধিকার সাথে,
অথচ দেখো যারা সেইদিন তোমাকে পিছনে রেখে তোমার বিপথগামী মৃত্যুর কথা ভেবেছিল,
তোমাকে চিরনিদ্রায় রাখাই ছিল যাদের নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকার একমাত্র বাসনা,
বছরের পর বছর তোমার পথের কাঁটা হয়ে থেকেছে যারা,
আজও এক শান্তির নিদ্রায় নিশ্চিন্তে আছে।
অথচ যারা নিদ্রাহীন ভাবে মুক্ত আকাশকে আলিঙ্গন করে,
দিনের পর দিন ক্ষুধার্থ থেকে থেকে শরীরের মেদ ঝরিয়েছে বিদেশী পরিযায়ী পাখিদের রূপের মতো,
স্বাধীনতার রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে যাদের শরীর,
হায়! সেই প্রথম সারির মানুষ আজো পেছনে পড়ে আছে মহাকালের জাগতিক পথে হারানো নক্ষত্রের ধূসর জীবনের মতো,
দূরবীন দিয়েও খোঁজা বড় দুষ্কর মনে হয়।
হে স্বাধীনতা! কেউ খোঁজ রাখেনি এই আত্মত্যাগী হৃদয়দের,
যে-অন্ন যে-কর্ম যে-অর্থ যে-শক্তি যে-সততা তোমার জন্য আহূতি দিয়েছিল তার থেকেও কঠিন জীবনধারণ তাঁদের।
হে স্বাধীনতা! তোমাকে পাবার নেশায় তাঁরা সর্বোচ্চ হারিয়েও মহিমান্বিত করেছে তোমায়,
সেই আত্মগরিমায় ভেসে গেছে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাঁদের হৃদয়,
আজ নেই কোন আত্মগরিমা, নেই-কোনো প্রতিবাদের ভাষা তাদের মুখে,
দুবেলা দুমুঠো খাবার না-পেয়ে আত্মবিনাশের ও আত্মহননের পথকে নিয়েছে বেছে,
হৃদয়ের কথা ভুলে গিয়ে হৃদয়কে দিয়েছে ছেড়ে,
আজ স্বাধীনতার মুক্তিমালাকে কৃষক গলায় পড়িয়েছে ফাঁসের দড়ি,
কৃষক মাছোয়ারা মুঠে মজুর কুলি মুচি এইসব দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারী মানুষের নেই কোনো নিশ্চিন্তের একবেলা খাবার,
নেই সম্মান না-আছে শিক্ষা, না- আছে স্বাস্থ্য, না-আছে আত্মমর্যাদা,
তাদের প্রত্যেকের রক্তে ছিল একদিন দুরন্ত সংগ্রামী ভাষা, সংগ্রামের আগুন,
তাই তাদের রক্ত ছিল মধ্যাহ্ন সূর্যের রঙে রাঙা,
সেই সংগ্রামী শরীর জীবন-যুদ্ধের সাথে লড়াই করতে করতে শ্মশানের কাঠ হয়ে গেছে,
হাঁড় হয়েছে শুষ্ক হিম,
শরীরের চামড়ায় ফাটল ধরেছে অসময়ে জীর্ণ বট গাছের মত,
রক্তের রক্তিমতা হারিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে এক অবসাদ বিষন্নতা অনিশ্চয়তা আত্মহননের এক সমীচীন ধূসর পথ।
হে স্বাধীনতা! তোমার আগমনের সংবাদে একদিন ভীত হয়ে রাজত্ব আর ক্ষমতা হারাবার ভয়ে বারবার নিদ্রা ভেঙেছে যাদের,
সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো ছুটে বেড়িয়েছে জঙ্গলে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে,
মত্ত হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে আরেকটা সুস্থির জীবন,
একটা নিশ্চিন্ত হৃদয়ের সাথে ঘুপটি মেরে বসেছিল শান্তির নিঃশ্বাস পাবার আশায় - একটি নির্জন দ্বীপের গহীন শান্তিকে ভালোবেসে।
হে স্বাধীনতা! চেয়ে দেখো আজ তোমায় আবদ্ধ রেখেছে -
সুউচ্চ দীর্ঘ প্রাসাদের মধ্যে,
দেশের বৃহৎ সংবিধানের গণ্ডিতে,
বড় বড় মনুমেন্টের মাথায়,
দানবীয় স্থাপত্য ভাস্কর্ষের হৃদয়ে,
ধর্ম, রাজনীতি আর কুসংস্কারের গহীন অন্ধকারের বেড়াজালে,
আর সমস্ত ক্ষমতাবান মানুষের হাতে।
ঐ দ্যাখো বাজারের সব থেকে হতদরিদ্র যে মুচিভাই তার প্রপিতামহ তোমাকে পাবার নেশায় তাঁর দোকাটি খুইয়েছে ভালোবেসে, মালিক হতে পারেনি তাই সে।
ভিটে হারিয়ে কতমানুষ আজ রাস্তায়,
উলঙ্গ শিশু ফুটপাত রেলিঙে ভর করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নির্ভর তাঁর মা'র পাশে দাঁড়িয়ে বিদায়ী অভ্যর্থনা জানায় পথযাত্রীদের,
দালানের স্বপ্ন গেছে চিরকালের জন্য মৃত্যুর পথে মুছে এইসব কঙ্কালসম প্রাণের।
হে স্বাধীনতা! তোমাকে খোঁজে আজো কত মানুষ প্রাণের বিনিময়ে।