শনিবার রাত এগারোটা গ্রামের নাম জেমারি। গ্রামের রাস্তার মোড় ধরে নিবারণ হাঁটছে রাস্তা পুরো জনশূন্য। বেশ শীত পড়েছে, নিবারণ জ্যাকেট টা ভালো করে জড়িয়ে হাতদুটো পকেটে ঢুকিয়ে মন্থর গতিতে রাস্তায় হাঁটছে। অজানা নয়, নির্দিষ্ট একটা জায়গায় সে যাবে মন বলছে আমার। সেই জায়গার যেন তীব্র আকর্ষণ বাধ্য করছে তাকে সেখানে যাওয়ার জন্য। বেশি দূর নয় আধঘন্টার পথ হবে হয়তো। আমার কেনো মনে হচ্ছে এই শীতের রাতের রাস্তা যেনো বহুদূর দূর অন্তহীন জার কোনো শেষ নেই। তবে এটা অবশ্য আমার মনে হচ্ছে অর্থাৎ আমি যে আপনাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করছি। নিবারণের হয়তো এই রাস্তাটা কিছুই মনে হচ্ছে না সে হাঁটছে আপন মনে সে হাঁটছে, সে হাঁটছে। মাঝের মধ্যে রাত্রের ঠাণ্ডা বাতাস এক ঝটকায় দুলিয়ে দিচ্ছে রাস্তার ধারে নির্জন গাছের পাতা। নিজের টুপিটা ঠিক করে হাত দুটো দিয়ে জ্যাকেটটা জড়িয়ে ধরে আবার মন্থর গতিতে হাটতে থাকলো নিবারণ।
নিস্তব্ধ নিশ্চুপ পরিবেশ।
আমি হয়তো জানিনা নিবারণে এর গন্তব্য কোথায়?
হয়তো নিবারণ ও জানে না অথবা হয়তো জানে। আমি শুধু নিবারণ কে পর্যবেক্ষণ করছি আর যা দেখছি তাই আপনাদের সরাসরি বলছি।
রাস্তাটা এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, নিবারণ সেই দুই ভাগে বিভক্ত জায়গাটার মাঝে দাঁড়িয়ে পরল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ডানদিকে রাস্তাটা ধরে আবার চলতে শুরু করল নিবারণ। কিছুটা যাওয়ার পর একটা ছোট্ট ব্রিজ চোখে পড়ল তার। সে তার মন্থর গতিতেই ব্রিজটার উপর এসে পৌঁছালো। এইবার সে থমকে দাঁড়ালো। ব্রিজের নিচে রেল লাইনের সোজা রাস্তা। যেনো কোনো অন্তহীন, নিস্তব্ধ প্রাণহীন মাঠের মধ্য দিয়ে রেলগাড়ির দীর্ঘ লোহার লাইন পৃথিবীর কোনো এক অন্তিম কোনায় সম্পর্ক স্থাপন করেছে। নিবারণ এইবার ব্রিজ এর একদম ধারে এসে দাঁড়ালো। সে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন রেললাইনে সুদীর্ঘ অনন্তহীন রাস্তার দিকে। তার দৃষ্টি কি যেনো খুঁজছে?
তার দৃষ্টি যেন বিরহের দৃষ্টি। কালো মেঘে ঢাকা পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকে কাকে যেন নিরন্তর খুঁজে চলেছে। একবারও তার চোখের পলক পরছে না।
সে হয়তো
ভাবছে তার একবার চোখের পলকের আড়ালে হয়তো সে চিরদিনের মত হারিয়ে যাবে তার জীবনের প্রাপ্তির অমূল্য মুহূর্তকে। তাই তাকিয়ে আছে সে সেই প্রাপ্তির খোঁজে।
সেকি অপলক দৃষ্টি,
যেন প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি সময় কে খন্ড করে সে দেখতে চাই তাকে তার আকর্ষণের গতিতে সে যেনো ভাসতে চাই..
বুকের ভেতর শতশত মেঘের গর্জনে
দুলছে আমার হৃদয় পিণ্ড।
বারছে আত্মার টান।
চোখের অপলক দৃষ্টি আর নিশ্চুপ তার কান।
আসক্তির সময় খন্ড করে
তার জোয়ার-ভাঁটায় ভাসতে চাইছি কেনো আমি?
আজ আমার গলনের পথে
তাঁর আত্মার স্পর্শে ঠাকুরের নিবারণ আমি।
ওহে আমার নিশ্চুপ মন
তুই কি চাইছিস তা বলে দে এখন।
একই যে তাহার প্রাণ
বন্ধুর সৃষ্টির প্রকৃতিতে দাঁড়িয়ে
একজন হয়েছে মহান।
আমি সেখানে হয়তো
আগুনের সেই ফুলকি
"যা প্রিয়তমার বিচ্ছেদের কষ্টে
অন্তিম শ্বাসের ফুকে নিভে যায়।"
কে তুমি?
তোমার রূপের দর্শনে
আমি কেন মরিয়া আজ।
এই চাঁদের আড়ালে তুমি
কোথায় করেছ তোমারি সাজ।
ওকি প্রেমের চাদর উড়িয়া
কেন টানছো আমায়?
নির্জন মাঠে জ্যোৎস্না ভরা এই সভায়।
হে বন্ধু তোমারি অসুখের টানে আমি যে আজ বন্দি।
পিরিতের মত তোমারি টানে
করেছি জীবনের সাথে করেছি আমি সন্ধি...
হঠাৎই একটা দুরন্ত ট্রেন আওয়াজ করে ব্রীজের নিচে দিয়ে চলে গেল। ঝড়ো হাওয়া যেন নিবারণের গলায় ঝোলানো মাফলার টা একবার দুলিয়ে দিল। একটু বেশিই হয়তো ঠান্ডা লাগছে এইবার,কারণ নিবারণ দুই হাতে জ্যাকেটটা আরো জোরে চেপে ধরল। আর মাঝে মাঝে হাত দুটো ঘসতে লাগলো।
এভাবেই হয়তো প্রায় 15 মিনিট কেটে গেল। নিবারনের চোখে জলের বিন্দু বিন্দু উষ্ণ ফোটা। সেই নোনতা জলের ফোঁটা যেন শীতল পরিবেশের এই আবহাওয়া কে তুচ্ছ করে তার চোখের গোড়ায় গরমের অনুভূতি জাগাতে লাগল।
নিবারণ কি কাঁদছে? কিন্তু কেন?
দীর্ঘস্থায়ী এই রাত্রে এতদূর এসে নিবারণ কাঁদছে কেন?
এখন হয়তো এবার সে ফিরবে। আর দাঁড়ানো ঠিক নয় তার পক্ষে, রাত বাড়ছে যত যেন শীতের শীতলতা শীর্ষে উঠছে। তাছাড়া বেশি রাত করলে আবার সেথা..
সেটা হয়তো আপনাদের অবিশ্বাস হতেই পারে।
তবে এই নিস্তব্ধ শীতল রাত্রে যদি কখনো একলা এই পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে কোন জায়গায় একলা দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে হয়তো অনুভূতিটা আরো জোরালো হবে আপনাদের। তাই আর নাই বা বললাম।
হ্যাঁ এইতো নিবারণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে হয়তো, সে মাথায় টুপি টা ভালো করে জড়িয়ে গলায় মাফলার টা আরেকবার জড়িয়ে নিল। ফিরবে এবার তার চোখে জল যেন বৃষ্টির ধারার মতো ঝরে পড়ছে। এইবার যেনো এই শীতল বাতাস তার চোখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নোনা জল বিন্দু গুলোর তুচ্ছ উষ্ণতা কে উপেক্ষা করে সেই জলবিন্দু গুলোকে যেন আরও শীতল করে তুলছে। আজ পূর্ণিমা তাই না কালো মেঘের আড়ালে থাকা ঐ চাঁদ কে যেন আমি অর্থাৎ আমি নিজেই লক্ষ্যই করিনি। এখন যেন এক দমকা বাতাসের ঝাপটায় উজ্জ্বল স্বর্গীয় পিণ্ড বেরিয়ে এসে প্রাকৃতিক জ্যোৎস্না জোয়ার-ভাটায় যেন পৃথিবীর কোনায় কোনায় ভরিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই যেনো এই জায়গাটা আরও উজ্জ্বল আরও, আরও প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠলো। কিন্তু নিবারনের সে চাঁদটাকে ফিরে দেখার মতো আর ইচ্ছা নেই। সে ফিরছে। কিন্তু একি, কোনো একটা মেয়ের গলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে মনে হচ্ছে! আমি কি ঠিক শুনছি?
না এই নির্জন পূর্ণিমার রাত্তিরে আমিও কিছু কল্পনা করছি! না এইতো ঠিক শুনছি আমি যেন বহুদূর যুগান্তরের সৃষ্টির কাছ থেকে ক্ষীণ অথচ পরিষ্কার একটা মেঁয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এই আওয়াজের মাধুর্যতা যেন প্রকৃতিকে আপন করে নেওয়া মত এক স্বপ্নের প্রিয়তমার কণ্ঠস্বর।
কিন্তু নিবারণ কি শুনতে পাচ্ছে না? শুনতে পাচ্ছে না কিছু ?
আমি তো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি তার কণ্ঠস্বর। নিবারণ কি করছে? হ্যাঁ এই তো শুনতে পেয়েছে ,ঘুরে দাঁড়াল নিবারণ। তার চোখ দুটো বিস্ফারিত। দৃষ্টি জ্যোৎস্নায় ঝলসানো সেই চাঁদের দিকে। সে তাকিয়ে আছে, সে তাকিয়ে আছে, সে তাকিয়ে আছে। সব চুপ নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝিঁঝির ডাক আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? ঠান্ডা বাতাস যেন এক ঝটকায় আরও তীব্র হয়ে গেল কি? পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল নাকি নিমেষের মধ্যে? নাকি পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ করলো কেও? চাঁদের আলো যেন পাথরের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে আরও উজ্জ্বল আর স্থির দেখাচ্ছ ? পুরো পৃথিবীটা মরে গেল নাকি? নাকি সময় স্তব্ধ হয়ে গেল চিরদিনের মত? একি এই সুরের মাধুর্য ধীরে ধীরে আমাকে মোহিত করছে কেনো? কি ভিশন তার মাধুর্যতা যেন স্বয়ং স্বর্গের পরীর গলার কণ্ঠস্বর। আমি মোহিত হচ্ছি। নিবারণ চোখের দৃষ্টি আরো বিস্ফারিত হয়েছে যেন তার দূরদৃষ্টি একই দিকে নির্দিষ্ট।
আমি দু হাত ধরে আমার কান চেপে ধরলাম।
এই কণ্ঠস্বরে যেনো কিছু উল্লাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে
মায়াবী শক্তি। আমি আর স্থির থাকতে পারছি না...
"আমি ঈশ্বর আমি দেবী!
আমিতো নই কোনো নিবারণের সেবিকার গৃহ বেদী।
আমি সবার স্বপ্ন,
আমি জন্মের আমি মৃত্যুর আদি লগ্ন।
আমি সত্য আমি মিথ্যা ,আমি ভ্রমরী ,আমি প্রচেষ্টা।
আমি সুখ আমি লালসা, সর্ব কীটের চিন্তার আমি সৃষ্টিকর্তা।
আমি সৃষ্টি আমি ধ্বংস, আমি মহাদেবের অন্তিম অংশ।
আমি দেবী আমি নারী, আমি প্রেমের পূজারী,
আমি ভালোবাসা আমি কামের চিত্তাকর্ষক নেশা।
আমি তুচ্ছ নই ,আমি রত্ন নই, আবার সর্বজনের গৃহীত এঠো পাত্র নয়।
আমি দিগম্বর আমি চমক, মানব জাতির ইতিহাসের আমি শ্রেষ্ঠ নারীর ধমক।
পথ সোজা নয় প্রাপ্তি আমার! অতি কঠিনের ওথবা অতি সরলের আঁচলে বন্ধন আমি নাই।
তোমার চোখে প্রেম আছে অনুভব করছি আমি
কিন্তু এখনো তুমি আমার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করো নাই।
"হে নিবারণ" আমার প্রাপ্তির আশায় তুমি ভুলেছো কি?
নিজের অস্তিত্বের দরজায় দাঁড়িয়ে তুমি শুনেছ কি?
আমি যে দেহ নয় কিন্তু আমি নারী
তোমার মনের আঁচলে অস্তিত্বের জটার বন্ধন বানাতে আমি পারি
কিন্তু পাবেনা তুমি আমায় এক জন্মে।
জন্মাতে হবে তোমায় বারংবার এই কীটের অঙ্গে।
অসহ্য বেদনায় তুমি ভুগবে সারা জীবন
বাহ্যিক কষ্ট নয়,শরীরের বিকলাঙ্গ নয়
তোমার জ্বলবে শুধু মন। আমার প্রাপ্তির আশায় আমার প্রাপ্তির নেশায় ধরতে হবে তোমায় সাত জন্ম
ভবিষ্যতের কোনো দিগন্ত মাঠে উজ্জল জ্যোৎস্না ভরা রাতে আমি থাকবো তোমারি মগ্ন।
জড়িয়ে ধরব সেদিন তোমায়! তৃপ্তির পরম সুখ ছড়াবো সদায়।
নিজের করে তুলবো তোমায়
আমি হব তোমার অঙ্গ তুমি থাকবে না আর কীটের সঙ্গ।
শীতের এই রাতেই তোমায় আমি করে নেব আমারই।
পথিক কেদোনা তুমি আজ
মুছে চোখের জল করে নাও জীবনের সাজ।
তুমি পথ বেয়ে যাও তোমারি পথে
সেই দিগন্তে মিলনের অপেক্ষায় আমি থাকবো তোমারি বানানো রথে"
মূর্ছিত হয়ে পিচের রাস্তার উপর লুটিয়ে পরল নিবারণ।
এক তীব্র ঘুমের স্রোত আমারও চোখ বন্ধ করলো।
পরদিন সকালে আচমকাই চোখ খুলে দেখি নিবারণ সেই ভাবেই মূর্ছিত অবস্থায় ব্রিজের উপর পড়ে আছে। কিছু লোকের ভিড় জমেছে সেখানে। তার সঙ্গে পাশে একটা অ্যাম্বুলেন্স। ডাক্তার নিবারণের হার্টবিট পরীক্ষা করছেন। দুটো কম্পাউন্ডার নিবারণ কে স্ট্রেচে তুলে অ্যাম্বুলেন্স ভেতর ঢুকালো। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে সব দৃশ্যই দেখছিলাম। আশেপাশের লোকজনের হট্টগোল এবং ডাক্তারের মুখদর্শন দেখে ব্যাপারটা আমি আঁচ করতে পারছিলাম বয়কি।
কালকের রাতের সেই দৃশ্য সেই মধুর কন্ঠে কবিতা মনে করতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার।
ভালবাসা এক শব্দ, যার মিশ্রণ হল কিছু অদ্ভুত অনুভূতি এবং অদ্ভুত কিছু পরিস্থিতি। আমি যা সেই দিন লক্ষ্য করলাম সেই দৃশ্য হয়তো আমার জীবনে ভালোবাসার এক নতুন দিকের অস্তিত্বের পটভূমি তুলে ধরল। যা বলে বোঝাতে না পারলেও কলমের তীক্ষ্ণ ডগাই তার কিছু পটভূমি তুলে ধরতেই পারি....
"অন্ত জাহার নাই
বিবেকের আঙ্গিনায়
শুধু আছে হাজারো অস্তিত্ব।
চোখের নিমেষে অক্লান্ত পরিবেশে গুপ্ত মনের হাজারো সুপ্ত আকাঙ্ক্ষিত।
আছে হাজারো কষ্ট আছে হাজারো বেদনা
কিন্তু ওই আবেগের কাছে আছে দেবতার সব তুচ্ছ রচনা।
"তাই"মনের আঙিনায় ফুটেছে আজও যত রক্ত
অক্লান্ত চাহিদার কাছে মুছে যায় সব, ক্লান্ত পথিকের শক্ত"