এই শহর পথ হারানো, দুঃখী হতে মানুষ খোঁজে
এই শহর দুঃখভরা, দেয়ালগুলো জড়িয়ে ধরা।
এই শহরের মানুষগুলো পয়সা দিয়ে দুঃখ কেনে;
ভেজাল খাবার, নকল ওষুধ সবসময়ে দুঃখে কাঁদে
দুঃখগুলো বিকাশ করা হাসপাতালের বেডের সাথে।
দুঃখগুলোর দিন ফুরায় না, দিনে দিনে বয়স বাড়ে
দুঃখগুলো হাত পেতে রয় মাস শেষে মাইনে নেবে
বাজার থেকে কেনা দুঃখ থলেয় আসে সুরক্ষিতে।
এই শহরের মানুষগুলো দুঃখ দিয়ে আতর মাখে
মৃত্যু কখন সঙ্গ দেবে না জানিয়ে চলার পথে।
এই শহরের মেঘবৃষ্টি দেয়ালগুলোর দুঃখ মুছে,
বাড়িওয়ালা পেইন্টার ডেকে নতুন রঙে দুঃখ মাখে
এই শহরের রাজমিস্ত্রি আঠালো দুঃখে ইট গেঁথে দেয়;
এই শহরের দুঃখগুলো সুইচ টিপে লিফটে উঠে;
বিত্তশালী, দালানকোঠা; চুক্তিনামায় আকাশ খোঁজে।
এই শহরের দুঃখগুলো লজ্জা ঢেকে ভিক্ষা করে
দুঃখগুলোর নেই সমতা, ভাগাভাগি কমই বোঝে।
এই শহরের দুঃখগুলো একা একা মিছিল করে
মাঝেমাঝে দুঃখগুলো হ্যাং করে দেয় নেটের গতি,
দুঃখের সাথে গুজবগুলো চক্ষু মেলে; সজাগ অতি।
এই শহরের দুঃখগুলো বড়ই রসিক, নাট্যশালায় মঞ্চে হাসে
এই শহরের নাটকগুলো প্যাচাল ভরা, গল্প ছোট দুঃখ ভরা
বিমূর্ত নেই, প্রবাদ ছাড়া, প্রেম-পিরিতের শেকল পরা;
দুঃখগুলো ঘরির এলার্ম ফিক্সড করে রিমোট টিপে নাটক দেখে
সকাল হলে ঘুমো চোখে উপোস মুখে হনহনিয়ে পথ চলে।
এই শহরের দুঃখগুলো ফেসবুক ছাড়া হাপিয়ে ওঠে
দুঃখমাখা মানুষগুলো সঙ সেজে টিকটক বানায়
এই শহরের দুঃখগুলো কর্ম রেখে গেমে মত্ত
দুঃখ গুলো সবই বিজ্ঞ ইউটুবার; যে যা বোঝে তাই বকে
এই শহরের দুঃখগুলোর নৈতিকতা সবটুকুই মুখেমুখে।
রাত-দুপুরে দুঃখ কাঁদে ছোট্ট শিশুর দুধের টিনে,
মায়েরা তাই আঁচল বেঁধে নিত্য দিনই কর্ম খোঁজে।
কিছু দুঃখে নির্ভরতায় বন্ধু এসে অকৃত্রিমে পাশে দাঁড়ায়;
কিছু দুঃখ নিঃস্বকে জড়িয়ে ধরে, আগন্তুকের হাতটা বাড়ায়।
নবীন কবির দুঃখ বুকে, নতুন নতুন শব্দ বানায়
দুঃখগুলো জটলা করে, চা দোকানে গল্প করে —
শহরজুড়ে দুঃখগুলো ত্যাগ মহিমার উৎসব করে ভয় দেখিয়ে
খেলাধুলার দর্শন শিখে, সৌহার্দ শেখায় রক্তমাখা ছুরি হাতে
এই শহরের দুঃখগুলোর নেই প্রতিবাদ; দাঁতকপাটি
শক্তি পেশীর জোর দখলে সুযোগ পেলেই মারে চাটি।
এই শহরের নষ্ট দুঃখ ভিড়ের মধ্যে নারীর বুকে ধাক্কা মারে
বাসের মধ্যে ট্রেনের কামড়ায় দুঃখ শাসায় চোখ তাড়িয়ে
দুঃখ গুলো নখ দাবিয়ে নিপেল মুখে রক্ত চোষে—
এই শহরের কিছু মৃত্যু দুঃখ হয়ে শ্বাসরুদ্ধের চিহ্ন রাখে।
এই শহরের দুঃখগুলো প্রেম বোঝে না, নারী খোঁজে
পৌরুষত্বের জৌলুসতায় পাষান হয়ে ধর্ষন বোঝে
মা-বাবাদের ভয়ের বুকে দুঃখ দিয়ে শীকল পরা—
ভবিতব্যে চেয়ে আছে, কবে শিশু নিরাপদে চলবে পথে?
এই শহরের অনেক দুঃখ চোখের কোনায় জল গড়ানো
বিচারহীনে দীর্ঘশ্বাসে জানলার শিকে হাত জড়ানো।
এই শহরের শিল্পীরা আজ সমাজবোধের নয় হাতিয়ার
নির্বাক ক্ষরণ ক্যানভাস রেখে ভার্চুয়ালে ছবি আঁকে—
এই শহরের দুঃখগুলো মাঝে মাঝে সাহস হারায়
রঙ তুলিতে মর্চে-পড়া; চিন্তা মনন ঝিমোয় ঘোরে।
এই শহরের দুঃখগুলো শিশুর পিঠে বইয়ের মতো—
শিক্ষানীতির চপেটাঘাত পারছে না যে ওজন নিতে;
মৌলিক শিক্ষার গলাটিপে ধর্ম সেথায় আঁধার ছুতে
বিজ্ঞান আর ধর্ম জেনে কৈশোরগুলো যাচ্ছে বেঁকে,
শিক্ষাঙ্গনে নেই কোনো পাঠ ক্লাসগুলো ফটোকপি
সুযোগ পেলেই কৃস্টাল র্যাগিং উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি।
এই শহরের দুঃখগুলো নিশীথ রাতে যৌবন বেচে
কিছু দুঃখ মেকআপ নিয়ে মুখোশ পড়ে ডিস্কো নাচে।
কিছু দুঃখ বৃদ্ধ মায়ের হাত ছেড়ে দেয়; নেশার ঘোরে
এই শহরের কিছু দুঃখ চেতন হারায় পানশালাতে—
কে বিরহী, কে মাতাল, ভবের পাগল, বোঝা তা দায়।
এই শহরের কিছু দুঃখ আড়াল করা গাড়ির সিটে
যুক্তি দিয়ে বৈধ ভাবে বিবির সাথে দাসী খোঁজে,
পরকীয়ার দুঃখগুলো রসালভরা, স্বাধীকারের গল্প শেখায়;
শুনতে খারাপ, দায় দিয়ে দেয়, কানাঘুষায় মুচকি হাসে;
এই শহরের কিছু মানুষ চিন্তা মনে রাস্তা হাটে।
এই শহরের পাখিগুলো বন্ধী থাকে দুঃখ খাঁচায়
তীব্র শীতে পথশিশু, কুকুরগুলো জড়িয়ে ঘুমায়
প্রাতঃকালে সেই দুঃখ নিত্য বাঁচে; ধর্মান্ধের চক্ষুশূলায়;
ক্রোধে ভরা দুঃখগুলো গর্জন করে ধর্ম বুঝায়, ধর্ম শেখায়।
এই শহরের হজুরগুলোর বায়নার সাথে চুক্তি থাকে—
গরীব দুঃখীর পয়সা দিয়ে মন-খায়েশে বাতাসে ওড়ে;
এই শহরের মানুষগুলো ধর্ম বেচে স্বর্গ বানায়।
এই শহরের দুঃখগুলো মুক্তমনার ঠিকানা খোঁজে।
এই শহরের স্বাধীনতা টক-শো গুলোর দিবস বোঝে
মানবতা-মানবিকতা চুক্তি করে ব্যানার ধরে।
এই শহরের ছিনতাইগুলো খুব একটা যায় না দেখা;
বড় বড় পুকুর চুরি, কেউ এখন গায় মাখে না।
এই শহরের দুঃখগুলো বুটজুতার সখ্যতা চায়—
কোট-কাছারির বারান্দাটা মিথ্যা বেচে লজ্জা ঢাকে;
এই শহরের বিচার আচার তাই হয় যে যা বোঝে।
এই শহরের দুঃখগুলো ভালোমন্দে বাহুবন্ধন ধরাধরি
সুযোগ পেলেই ঝাপটে ধরে, অচেনার মতো ঝেড়ে কাশে
এই শহরের দুঃখগুলো অবসরের ফন্দি আঁটে।
বুকের ভিতর কষ্ট রেখে নির্মোহ এক সুখকে হারায়;
এই শহরের দুঃখগুলো বিকেল ছাদে ঘুড়ি উড়ায়।
এই শহরে অনেক দুঃখ ধর্মভীরু; ভাবে সত্য; বলতে কাঁপে
মানবতার চেয়ে লোভ বেশী, ভুল তত্ত্বে তর্ক করে—
সত্য মানে মনে মনে, উপর উপর গলাবাজি
অবশেষে বোধবুদ্ধি মাথা খেয়ে করে শুধু অস্ত্রবাজি।
এই শহরের কিছু দুঃখ জরাজীর্ণ রোগাক্লিষ্ট বস্তি বানায়
কিছু হলেই সবাই দোষে, সেই দিকেই দৃষ্টি ঘুরায়—
ভুক্তভোগী হাততুলে আরস কাঁপায়; খোদায় দোষে।
দূর্নিতী সব বৈধকরা, দান খয়রাতে তওবা পড়া;
সিজন বুঝে ধর্মকর্মে মায়াময় এক বিধাতা খোঁজে
দৃশ্যপটের রাঘব বোয়াল ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকে।
শক্ত বাঁধন; সহজ করে গিট খুলে দেয়− দুঃখের যুক্তি
দুই মানুষকে একা একা বাঁচতে শেখায়− দুঃখের চুক্তি
বাহুর সাথে বাহু মেলায় অচেনাকে সঙ্গী করে;
এই শহরের দুঃখগুলো চেনা মানুষ পর করে দেয়।
দুঃখগুলো শহর জুড়ে ফাঁদ পেতে রয় অলিগলি
সচকিত হাত বাড়িয়ে দুঃখেই বাঁচার সাহস দেখায়।
দুঃখগুলো প্রেমের সাথে মিলেমিশে বসত করে—
প্রেমের সন্ধি হতে হতে দুঃখ থাকে সমঝোতায়।
এই শহরের ফুলের দোকান ফুল না বেচে দুঃখ বেচে
একটা দুখের ঠিকানাতে অনেক দুঃখের পার্সেল আসে।
এই শহরের দুঃখগুলো শেষ বিকেলে একা একা অবসরে
সেল ফোনেতে, চায়ের কাপে, হরহামেশাই মত্ত থাকে;
দুঃখগুলো দীর্ঘশ্বাসে বারান্দাতে টবের মধ্যে ঝুলে থাকে,
এই শহরের যুগলবন্দী দুঃখ রাখার জায়গা খোঁজে।
এই শহরের ইচ্ছাগুলো দুঃখ মেখে উৎসব করে
এই শহর মিলন রেখে, প্রেম-বিরহে দুঃখ খোঁজে।
ঘুমের ভীতর স্বপ্নগুলো দুঃখের সাথে সন্ধি করে,
দুঃখ গুলোর ঘুম নেই চোখে, অষ্টপ্রহর আড়ি পাতে;
দুঃখগুলো পথ হারাবে, এমন ভাবনায় বেরিয়ে পড়ি—
দুঃখগুলো পথ চিনে যায়; পায়ে পায়ে ফেরে বাড়ি।
৫ জুলাই ২০২০, শঙ্কর, ঢাকা।