জীবন করেছে ঊনষাটটা বছর পার।
কখন যে সময় এসে জীবনের গায়ে লাগিয়েছে
এতগুলো বয়সের প্রলেপ, - তা বুঝতেই পারিনি আমি।
আজ আমি প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের পিতা!
একদিন পর্দার আড়াল থেকে
অনিচ্ছাকৃত ভাবেই শুনতে পেলাম ফোনে সন্তানের কথপোকথন।
- তুমি পারবে কি, আমার হাত ধরে পালাতে? …
আমি তো শুধু তোমারই অপেক্ষায় ...
কি বলছে আমার খোকা !!
তবে কি খোকা বড় হয়ে গেলো !!!
এরপর থেকে প্রায়শই শুনতে পেতাম নিশুতি রাতের গল্প।
                                প্রেম-প্রেম খেলা, - ফোনে।
একদিন সময় বুঝে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম।
মনেতে আমার ইতস্তত ভাব, তবুও
- আমি জেনেছি …
ভালোবাসা যদি ...
বেদম তাড়া দেখিয়ে ও বললো – ওটা টাইম পাশ।
বেরিয়ে গেলো ও ...
মনকে প্রশ্ন করলাম – মানুষ কি পাল্টে যাচ্ছে?
                         বিপনি থেকে কিনে আনা পোশাকের মতো
                         অবিরত পাল্টাচ্ছে নিজের গায়ের চামড়াটাকে!?
হঠাৎ একদিন চুপিসাড়ে, রাত্রে, আমার অনুপস্থিতিতে
বাড়ীতে ডেকে নিয়ে এসেছিলো মেয়েটাকে!
খোকার হয়তো স্বাধ হয়েছিলো রজনীর পিপাসা-খিদে মেটানোর।
বড়ো হচ্ছে তো!!
অনাকাঙ্খিতভাবে আমি ফিরে আসায়
বাধা পড়েছিলো ওদের আধেক স্বপ্ন, আধেক ভুলের মাঝে।
না হয় নাই বুঝুক ওরা ওদের ভুল,
সমাধান তো করতেই হবে ওদের ভুলের।
অবিভাবক হিসাবে ওটা করতে গিয়েই শুনতে হলো –
          যথেষ্ঠ হয়েছে … , আমার একটাই কথা … ,
আমার অযাচিত হয়ে প্রতিকার করতে যাওয়ার প্রতিফল -
অহেতুক বাদানুবাদ, যা সত্যিই করতে চাইনি আমি।
বাদানুবাদের সর্বশেষ উক্তি ওর কাছ থেকে –
          তুমি আমার সে নও, যাকে আমি বাবা বলে জানতাম।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম!
উপলব্ধি করলাম সন্ত্রাসের এক নতুন রূপ!!
অপসংস্কৃতির সন্ত্রাস!!! সে সন্ত্রাসের চক্রব্যূহ!!!!
জল-নদী-তল-মেঘ-বৃষ্টি-রোদ, … সবকিছু,
সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিলো আমার।
মন যেন ধূসর প্রজাপতি।
মনকে আবারও প্রশ্ন করলাম – কেন এই বিকৃতি?
বিস্মৃতির অতলে গিয়েও ভুলতে পারিনি ঘটনাটাকে।
কয়েক বছর এভাবেই কাটলো ।
এর কিছুদিন পর –
একদিনযে পাখিটা ধরা দিয়েছিলো আমার আঙিনায় এসে ,
একঘেঁয়ে জীবন ছেড়ে সে উড়ে গেলো নতুন বাসায়, সুখের সন্ধানে !
সেদিন ছিলো খোকার শুভ জন্মদিন ।
জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করতে পারিনি খোকাকে – কেন বন্ধু হলি না ?
আমার সাধের বাড়ীতে আজ আমি একা, কিছুই নেই, শুধুই শূণ্যতা ।
কখনো কখনো এখন মনে হয় –
          নিজের জগতে আমি নিজেই রাজ্যহীন রাণী অথবা রাজা।
শূণ্য, তবু এ আশ্রয়, নন্দিনীর সাধের সংসার, আমার স্বপ্নপুরী ।
এখন সবসময় মনে পড়ে নন্দিনীর কথা ।
নন্দিনী, - খোকার মা ।
মনে মনে বলি – নন্দিনী আজও যে মনে পড়ে তোকে ।
বিয়ের পর ও আমাকে ডাকতো কাতুকুতু বুড়ো বলে ।
কেন? – সে কথা আজ বলতে লজ্জা করে ।
বয়স হচ্ছে তো !
কবিতা লিখতে ভালোবাসতো ও ।
গোটা দুই কবিতাও ছাপা হয়েছিলো ওর
তখনকার একটা ছোটোখাটো ম্যাগাজিনে ।
তার মধ্যে একটা কবিতার নাম ছিলো “অণু কাব্য”,
আর যেন কি? মনে করতে পারছি না ।
তখন না ছিল ফেসবুক, না কোনো কবিতার আসর ।
চর্চা করলে ভালো কবি হতে পারতো ও ।
সংসারের চাপে কবিতা না লেখাটাই চর্চা হয়ে গেছিলো ওর ।
ওর একটা কবিতার কটা লাইন এখনো মনে আছে আমার ।
কি আছে ওই আকাশের নীচে – এই ভাবনা নিয়ে লিখেছিলো –
     “ তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,
          বলেছিলে, - আমার গ্রামে এসো ।
     সবুজ-শ্যামল-সজল ভরা বুকে,
          দুচোখ মেলে একটুখানি বোসো ...”
ঠিক যেন ঢাকাই বর্ষার ছড়া ।
আর আজ মাঠ পেরোলেই সবুজ নাই ।
মাঠ কোথায়! ওতো একচিলতে উঠোন ।
একজনও ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারে না ।
ওটাকেই এখন ব্যঙ্গ করে মাঠ বলে ডাকি ।
চারিদিকে অবিভক্ত কংক্রিটের সারি ।
মেঘ-বৃষ্টি-রোদ-আমার দুষ্টু তারা ,
কিচ্ছু দেখবার উপায় নেই ।
তার উপর চারিদিকে হাজারো তার আর কেবেল্-এর ছড়াছড়ি ।
মনে হয় যেন দগ্ধ মালা ।
আর স্কাই-স্ক্রাপার বাড়ীগুলো মৃতদের প্রতিচ্ছবি ।
দম বন্ধ হয়ে ওঠে ।
ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিই ।
ভয়কে ভুলতে চোখ রাখি খবরের কাগজের পাতায় ।
- সার্ক সন্মেলনে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে বসে
     এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দুবাই থেকে খোলা বার্তা –
     দেশের উন্নয়নের স্বার্থে, দারিদ্র দূরীকরনের জন্য বাজে খরচ কমাতে হবে ।
     তাই মন্ত্রীদের বিদেশ যাত্রার খরচে কাট-ছাঁট ।
- পাবলিকের হাতে তথ্যমন্ত্রী লাঞ্চিত ।
- ধর্ষন
- খুন
- যুদ্ধ
আরো কত-শত কেলেঙ্কারিয়াস ঘটনাবলী !
মনের ইচ্ছে হয় সবুজ-শ্যামল-সজল ভরা গাঁয়ে ফিরতে ।
তখনকার সময়ে এমনটি ছিলো না ।
শৈশব মানে একগুচ্ছ তাজা ফুল, যে ফুলের দাম অমূল্য ।
কৈশোরেও ছিলো সমান উচ্ছলতা ।
যৌবনের উঠোনে পা দেওয়া ছেলেরা প্রেমিকার জন্য নয় ,
প্রাণ উৎসর্গ করতে চাইতো দেশের তরে ।
সমাজের বুকে ওড়াতে চাইতো সার্বভৌমত্বের লাল নিশান ।
হার-জিৎ উপেক্ষা করে এগিয়ে চলতো নব জীবনের পথে ।
ঠিক যেন একাত্তরের যুদ্ধে যৌথ ভারত-বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ।

কখন যে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছি! খেয়ালই ছিলো না ।
কি যেন বলছিলাম তখন –
হ্যাঁ, - নন্দিনীর কথা ।
ও তখন চল্লিশে ।
একদিন হঠাৎ আমাকে ছেড়ে চলে গেলো ,
চিরদিনের মতো, চিকিৎসার অভাবে ।
সামান্য মশা কামড়ে তা থেকে ম্যালেরিয়া হয়েছিলো ।
খোকার খাবার আর পড়াশোনার খরচ জোগাতে গিয়ে
সংসারে একটাও অতিরিক্ত পয়সা ছিলো না ।
বিয়ের আগে কতো স্বপ্ন ছিলো ওর চোখে ।
আর সংসার করে যে কটা দিন বেঁচেছিলো ,
বেঁচেছিলো ফেলানী হয়ে ।
সংসারে ওর দূঃখ দিয়েই জীবন শুরু হয়েছিলো ।
আশাহত জীবন !
জানি তা হবার নয় ।
তবুও আমি আজও দাঁড়িয়ে ওরই প্রতিক্ষায় ।
অবিন্যস্ত চাওয়া সময়ের কাছে ।
যদি অস্ফুট আদরে একবার সে আমাকে ডাকে –
এই মিনসে ফিরে আয় !!!
পরক্ষনেই মনকে বলি –
সু্প্ত বাসনা ফিরিয়ে দিও না মোরে ।
ভালোবাসা তুমি থাকো দূরে ।
দূর থেকেই তোমাকে ভালোবাসবো আমি ।
তুমি সহ্য করতে আমাদের খোকার বর্তমান রূপ ।
মরে গিয়ে তুমি মুক্তিপদক লাভ করেছো ।
ছাই রঙা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি ?
ও নিয়ে তো আর যুগান্তরের কবি হওয়া যায় না ।
বলা যায় না – নিসর্গ পথে হাঁটবো আমি... কবিতায় বিসর্জন ।
নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মায় ।
বিধাতা জন্ম দিয়েই আমার কানে কানে বোধ হয় বলেছিলো –
যাঃ শালা আজ থেকে তুই নিঃসঙ্গ মানব !!!!!!


********************************************

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ১০/০৯/২০১৩ তারিখের কবিতার আসরের সকল কবিবন্ধু।