সব সৃজনশীল সাহিত্যের একটা প্রেক্ষিত থাকে, কবিতার তো থাকবেই৷ তবে প্রেক্ষিত জানার প্রয়োজনটা তিন ভাগে বিভক্ত ৷ প্রথমত, যার প্রেক্ষিত আপনাকে কবিতাটি হৃদয়ঙ্গম করতে সাহায্য করে৷ এর অজস্র উদাহরণ আছে৷ অক্ষয় কুমার বড়াল থেকে অজিতেশ নাগ৷
কয়েকটা উদাহরণ দি,
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী বিহারীলালের অনুরক্ত পাঠিকা ছিলেন। কবি বিহারীলাল তাঁকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে একটি কার্পেটের আসন তৈরি করে তাতে ‘সারদা মঙ্গল’ কাব্যের দুটি পংক্তি বুনে উপহার দেন। এই দুটি পংক্তিতে একটি প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্নটি এই-  "হে  যোগেন্দ্র ! / যোগাসনে,  ঢুলু  ঢুলু  দু  নয়নে/  বিভোর  বিহ্বল  প্রাণে  কাঁহারে  ধেয়াও ?”-/ কাদম্বরী দেবী এই প্রশ্নে কবির সারদার ধ্যানমূর্তির স্বরূপ ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। কবিও অন্য একটি কাব্য লিখে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুত ছিলেন। কিন্তু কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলে কবি বিহারীলাল অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং শীঘ্রই ভক্ত পাঠিকার উদ্দেশ্যে ‘সাধের আসন’ নামে কাব্য রচনা করেন। কাদম্বরী দেবীর দেওয়া কার্পেটের আসনই এই কাব্যের উৎস ছিল বলে কবি কাব্যের নামকরণ করেন ‘সাধের আসন’।

এই উদাহরণ টি অনেকেরই জানা,
‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।’ (পাথরের ফুল/ সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনকালে এপিলেপ্সি আর দারিদ্র্যর সাথে লড়াই করতে করতে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন ৷ তখন তাঁর দেখাশোনা করছেন পার্টির তিন সদস্য- সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রসূন বসু। আসতেন অশ্বমেধের ঘোড়ার লেখক দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ আর ছিলেন অতুল গুপ্ত। এদের সবার উদ্যোগে চাঁদা সংগ্রহ হয়েছিল ৷ লেখকের মৃত্যুর পর দেখা গেলো অনেক মানুষ আর মৃত শরীর এক লরিতে ফুলে ঢাকা। তবু সব ফুল তাতে ধরান যায়নি। তাই তাঁকে নিবেদিত ফুল নিয়ে পিছনে আরেকটা লরি। ফুলের ভারে হেলে পড়ছে খাট।
তেমনই তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'জয়মনি স্থির হও'  উল্লেখযোগ্য ৷
"আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে বললাম:
জয়মণি, স্থির হও!
হে কালবৈশাখী, শান্ত হও!
এই পৃথিবীতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে
দেখ,
আমি জটায় বাঁধছি
বেদনার আকাশগঙ্গা।।'

কিছু কবিতার প্রেক্ষিত না জানলেই বেশি ভালো লাগে, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কেন যামিনী না যেতে' বা 'ফাগুন লেগেছে বনে বনে'!

কিছু গানের প্রেক্ষিত অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে, 'আজ জ্যোৎস্না রাতে' বা 'যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা'!

অনেক কবিতা প্রেক্ষিতের বন্ধনে থাকে না ৷ সোনার তরী, দু:সময় বা বিদ্রোহীর মতো কবিতা ৷

আর কখনও কবিতা নিজেই নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে সরব হয়, যেমন সত্তরের দশকে লেখা এই কবিতাটি,

এক যে ছিল হাড়ি
মজতো তাতে দিনে রাতে
সংসদীয় তাড়ি।
তাড়ির জন্যে হয়ে হন্যে
মানুষ সারি সারি
কাকার বাড়ি বাবার বাড়ি
পাঠায় তেলের হাড়ি৷
কাটছিল দিন এমনি করে
কম করে বিশ বছর ধরে
হুট করে কে দিল মেরে ঢিল
ভেঙে দিল হাড়ি
তাড়ির নেশা কাটিয়ে ওঠে
লাল নকশালবাড়ি।
(তথ্য ঋণ : নানা লেখা থেকে৷ সবার কাছে কৃতজ্ঞ)