বনলতা তুমি কেমন আছো?
আমার জানতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে।
তুমি আছো কোন সুদূরের ভিন আবহে?
আমি তো ইচ্ছে করলেই
ছুটে যেতে পারি না সেখানে।
চোখ মেললেই এখন তোমাকে
আমি দৃষ্টি ভরে দেখতে পারি না।
কোন সুদুরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে
তুমি ভাবছো এই আমার কথা।
আমি জানি। বনলতা, আমি জানি।
তুমি এখন, এ সময় ভাবছো আমাকে।
শুধুই তোমার জীবনানন্দের কথা।
জানি, এসময় আমার কবিতাকণ্ঠ
তোমার কল্পনায় তুমুল ঝড় তুলছে।
তুমি বলেছিলে একদিন, কবি আমি
আমি তোমাকে কখনও একা ভাবতে পারি না।
তুমি যেখানেই থাকো কবি,
তুমি জেনো, তোমার এই বনলতা থাকবেই
তোমার পাশে। তোমার কাব্যিক আবহে
ঢেউ তুলবে দুর্নিবার সব অনুষঙ্গে।
তুমি জেনো। তুমি জেনো কেবল,
আমি এই বনলতা, কেবলমাত্র তোমারই।
হে কবি। তুমি যতই বিচরণ কর তোমার
কল্পনার তটে। সেথায় যত আছে
দিগন্ত বিস্তৃত মেঘমালা। আছে জলরাশি।
তার তরঙ্গ বিস্তর। আমি যেদিকেই তাকাই
হে কবি, আমি জানি সেখানে, আছো সবখানেই তুমি।
তুমি দেখ তোমার এই বনলতাকে।
সবকিছুর ঊর্ধ্বে তোমার এই আমাকে।
আমি তোমার সব চিত্রপটে থাকি সমুজ্জ্বল।
আমিই তোমার স্বপ্নের বনলতা।
হ্যাঁ বনলতা। তুমিই আমার স্বপ্নের বনলতা।
তোমাকে নিয়ে আমি যতই ভাবি না কেন,
তোমাকে নিয়ে আমি যতই কাব্য রচি না কেন,
তোমাকে নিয়ে আমি যতই রঙিন ছবি
আমার তুলিতে জীবন্ত করে তুলি না কেন।
তুমি হে বনলতা, আমার কল্পনায় নও
যতক্ষণ বাস্তবে সামনে এসে না দাঁড়াও,
যতক্ষণ তোমাকে আমি আমার স্পর্শে
অনুভব করতে না পারি, ততক্ষণ তুমি হে,
দূরেই আছো জেনো তুমি।
তুমি দূরেই থাকো। এটাই আমার দুঃখ!
তুমি আমার বনলতা। কাছে এসো।
কাছে এসে দাঁড়াও আমার । একান্ত আমার পাশে।
এই আমার বাস্তব জুড়ে। একটু দেখি তোমাকে
তোমার পেলব হাতের ছোঁয়ায়
শুধু একবার আমি ধরা দেই তোমার অস্তিত্বে।
আমার অস্তিত্বেও তুমি এসে বল, এই তো আমি।
হে কবি তোমার বনলতা। তোমার কাব্যমালা।
তোমার শব্দাবলী আবার ঝড় তুলুক আমার কল্পনার জগতে।
তোমার কাব্য বৃষ্টি হয়ে,
তুমুল বর্ষণ হয়ে নেমে আসুক।
গাছের সব পাতারা টলমল নড়ে উঠুক
তোমার শুষ্ক মাটি ভরে উঠুক
বৃষ্টিময় চিত্রিত সোঁদা গন্ধে।
তুমুল বর্ষণ তোমার এক নাগাড়ে
উন্মুল হয়ে থাকুক বনলতাময় স্বপ্নিল আবহে।
হ্যাঁ বনলতা। তুমি এসেছ।
আমার দরজায় এসে ঘা মেরেছ।
আমি হতচকিত! আমি বিহ্বলিত!
আমার দু'হাতের আঙ্গুল কেঁপে কেঁপে ওঠে।
খুলব কি দরজা আমার?
এই আমি কি ত্রস্তপায়ে হেঁটে যাবো আমার
কক্ষের লম্বা করিডোর পেরিয়ে
বনলতার আগমনী দেখতে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম আবার।
আবারও বাইরের দরজায় শব্দ।
নড়ে ওঠে আমার কক্ষের বাতাশ।
আমার জানালার কার্নিশ।
আবারও নড়ে ওঠো দেয়ালে ঝোলানো তুমি
নড়ে ওঠে তোমার সেই পুরনো সাদাকালো ছবিটা।
কী এক জাদুময় বাতাশ এসে আমার
অস্তিত্বের সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে!
কী এক আলো এসে আমার সবকিছু
ঝলসে দিয়েছে। হ্যাঁ বনলতা।
তোমাকে নিয়ে আমি যতই ভাবি।
যতই করি কাব্যিক পটভূমি রচনা।
আমার সেই ভাবনায়, আমার সেই পটভূমিতে
তাকিয়ে দেখি। দৃষ্টি মেলে দেখি তুমি.
কেবল তুমিই একা বনলতা!
আমি পায়ে ভর করে স্থিত হই।
বুকে সব সাহস নিয়ে সোজা হই।
আমাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে।
একপা দুপা করে এগিয়ে যেতেই হবে।
বনলতা। জানি তুমি তোমার হাতে
আমার বন্ধ দরজায় আঘাত করছ।
কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি না তোমার কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠ তোমার, কবি দরজা খোল।
দরজা খোল তোমার।
আমার সব সন্দেহ। আমার যা কিছু
মনবৈকল্য সব যেন ঘনীভূত হয়।
গাঢ় হয় দ্বিধার নীল রঙ।
যদি তুমি হও।
যদি তুমিই হও; আমার সেই বনলতা।
তবে কেন এখানে তোমার সেই
সুললিত কন্ঠ নেই? কেন নেই?
তুমি কি বনলতা?
আমার বনলতা দাঁড়িয়েছ এসে
আমারই দোরগোড়ায়!
তুমি কি সত্যই বনলতা?
আমি কি উঠে দাঁড়াবো? স্থিত হবো আমার বিশ্বাসে?
হাত রাখবো আমার বন্ধ দরজার হাতলে?
খুলে দেবো কি এখনই
আমার মনের সব কয়টি অর্গল?
আমার জানালার কাঁচে
আমি দেখি তোমার আলাদা অবয়ব।
দেখি লাস্যময়ী বনলতা তুমি
দাঁড়িয়ে আছো আলোআঁধারি পরিমণ্ডলে।
দেখি তোমার হাতে আমার কবিতার পৃষ্ঠা।
দোল খাচ্ছে বাতাশে তোমার আঁচল।
উড়ছে তোমার প্রলম্বিত কালো চুল।
আমার ঠোঁট কেঁপে ওঠে বনলতা, চুল তার কবেকার …!
তারপর বনলতা! তারপর বনলতা কী হল আমার?
আমার সব ক’টি আঙুল আলোআঁধারির অস্তিত্বকে
জাপ্টে ধরতে চাইল।
আমি দু'হাত বাড়িয়ে আঙুল নেড়ে এগিয়ে যাই।
সামনে আমার কাঁচের দেয়াল যেন দাঁড়িয়ে আছে স্থির।
আমি উদাত্ত কণ্ঠে ডাকি, বনলতা! ব-ন-ল-তা!
মুখ খুলো। কথা বল। সাড়া দাও আমার ডাকে; তুমি বনলতা!
তুমি কি শুনছো? তুমি কি শুনতে পাচ্ছ
এই আমি তোমারই কবি জীবনানন্দ!
তুমি কি চিনতে পারছনা তোমার এই জীবনানন্দকে?
হ্যাঁ বনলতা! আমি জীবনানন্দ। আমি এখনও কবি।
আমি এখনও তাই জীবনানন্দ!
তোমার আমি বেঁচেই আছি বনলতা।
হ্যাঁ বনলতা। আমি তোমার কবি, জীবনানন্দ।
মরে যাইনি বনলতা। আমি বেঁচেই আছি।
আমি বেঁচে আছি তোমাকে স্পর্শ করবো বলে।
আমি বেঁচে আছি তোমাকে নিয়ে
আমাদের স্বপ্নের নাটোরে
দুরন্ত পদভারে ছুটে যাবো বলে।
আমি আবার ছুটে যাবো সেখানে।
সেখানে। সেই নাটোরে। যেখানে আমাদের
সমস্ত স্বপ্ন ধূলিধূসর হয়ে জমাট পাথর হয়ে আছে।
তুমি আমি সেখানে সেই নাটোরে ছুটে যাবো
আমাদের সেই সোনালি অতীতকে
আবার জাগাবো বলে। আমাদের স্বপ্নসমস্ত
সেখানে লুটিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে।
আমাদের কবিতার তরঙ্গমালা সেখানে স্থির হয়ে আছে।
আমার অতীত। আমাদের ভবিষ্যত। সবই তুমি
জানো বনলতা। কী আমাদের ছিল। কী আমাদের হবে।
তুমি এভাবে মায়াবী জাদুকরী অস্তিত্বে তোমার
ঘুরিয়ে মেরো না। না। না। বনলতা।
আমি তবে মরেই যাবো। তখন আমি আর তোমার থাকব না।
আমি তবে চলেই যাবো। তোমার আমার স্বপ্নের নাটোর ছেড়ে
অন্য কোথাও। দূরে অন্য কোন দিগন্তে।
তখন তুমি যতই ডাকো আমাকে। তোমার কবিকে।
তোমার জীবনানন্দকে। না, বনলতা।
তা করো না। তুমি জানো আমার মন।
আমার অভিমান। এই আমার সবকিছু।
তুমি এসো বনলতা।
তোমাকে নিয়ে ছুটে যাবো আমি
আমার নিজস্ব আবাসে।
যেখানে শুধু থাকবো ব্যস্ত আমি
আমার নিজস্ব পাণ্ডুলিপি নিয়ে
থাকবো মত্ত আমি এক জীবনানন্দ
আর থাকবে তুমি এক বনলতা।
তবে, আমি কি ফিরে যাবো আমার দরজার কাছে?
বনলতা। তুমি বল, তুমি কোথায়?
তুমি ভেবো না, আমি তোমার কবি
পাগল হয়ে প্রলাপে মত্ত হয়েছি।
আমি ঘোর দুঃস্বপ্নের নিগড়ে আটকে আছি এখন।
আমি যেন দূরে থেকেই আছি তোমার খুবই কাছাকাছি।
আছি একান্ত পাশে। একেবারে তোমার বাহুর নাগালে।
শুধু তোমার সান্নিধ্যের, তোমার অস্তিত্বের স্পর্শ আমাকে
আবার ফিরিয়ে আনতে পারে; এই ভাবময় বাস্তব জগতে।
আমি দেখছি; যন্ত্রদানব ট্রাম এগিয়ে আসছে,
দ্রুতলয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমি যদি বলি, এসময় আমি এগিয়ে যাবো।
আমি বিপদের নাগালে।
আমি যদি বলি, পিছিয়ে যাবো।
তাও আমি বিপদের নাগালে।
এখন এই অবস্থায় আমি কী করবো বনলতা?
বলতে পারো তুমি, আমি এখন কী করতে পারি?
আমি যদি দরজা খুলি।
আমি যদি চোখ মেলে দেখি।
আমি যদি তোমাকে একান্ত কাছে পাবার
তোমাকে দেখার ইচ্ছা নিয়েই ছুটে যাই
যদি তোমাকে না দেখি।
যদি না পাই তোমাকে।
তবে ভাবতে পারো কী হবে আমার?
না সামনে তুমি। না পিছনে তুমি।
না খোলা দরজায়। না পিছনের জানালার কাঁচে।
কোথায় কোন প্রেক্ষাপটে দেখতে পাবো তোমাকে?
বাস্তবের বনলতাকে?
হে বনলতা। বলতে পারো তুমি
আমি এখন কী করতে পারি?
এসময় আমার কী করার আছে?
তবে কি আমি ধাবমান ট্রামের দিকেই
এগিয়ে যেতে থাকবো?
নাকি, আমি তার বিপরীতে পিছু হটবো?
না বনলতা। না। কোনটাই আমাকে বাঁচাতে পারবে না।
তোমাকে নয় বনলতা। তোমার অস্তিত্বকে নয়।
অনিবার্য মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে হবে।
কোথায় তুমি হে বনলতা? কোথায় তুমি?
সামনে আমার ট্রাম এগিয়ে আসছে, বনলতা!
আর আমি ছুটে আসছি দরজার কাছে।
এই আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।
খুলে দিচ্ছি আমার হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে
আমি দরজা খুলেই তোমাকে দেখতে চাই; বনলতা!
তোমাকে স্পর্শ করতে চাই;
আমার হাতের সবকটি আঙুল দিয়ে।
তুমি কথা বল।
বল, কবি আমি তোমার বনলতা।
দাঁড়িয়ে আছি তোমার দোরগোড়ায়।
খুলে দাও তোমার দরজা।
খুলে দাও মনের আগল।
তাকিয়ে দেখ, আমি তোমার নাটোরের বনলতা।
তুমি এসো বনলতা।
তোমাকে নিয়ে ছুটে যাবো আমি
আমার নিজস্ব আবাসে।
আমি খুলে দিলাম আমার দরজা।
দুহাতে দরজার দু' কপাট ধরে দাঁড়ালাম।
চোখ তুলে তাকালাম।
দূরে ধূসর নীলিমা। সবখানেই শূন্যতা। সবই শূন্য।
বনলতা! তুমি বিহীন সবদিকে দেখি নিঃসীম শূন্যতা!
সবখানে এখন আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
বনলতা! বনলতা তুমি কোথায়?
তুমি কোথায় বনলতা?
তোমার অপেক্ষায় আমি জীবনানন্দ
তুমি এসো বনলতা!