আমাদের জীবনের অথই টানাপড়েনে
বারবার গোচরে, অগোচরে ঘটে
অসংখ্যবার স্খলন। প্রতিনিয়তই
আমরা নীরব স্খলনের মুখোমুখি এসে দাঁড়াই।
কখনও পারি তা প্রতিহত করতে।
আবার কখনও পারি না।
আর তখনই আমরা পতিত হই
সুনসান কবরের চাপা ঘোর অন্ধকারে।
আমাদের জীবনের কিছু সময় চ’লে যায় তখন,
একেবারেই নিশ্চুপ নিথর হয়ে থাকি আমরা
এই প্রাণবন্ত সৃজনশীল মানুষেরা।
তবে এই নির্ঘাত কবরবাস আমাদের
অনেকের জন্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
বস্তুত কবরের বাস্তবতা আমাদেরকে
আষ্টেপৃষ্টে আঁটকে রাখতে পারে না।
এই আমরাই কখন যে আবার
কফিনের ঢাকনা খুলে
আমাদের নশ্বর দেহ নিয়ে বেরিয়ে আসি
নিজেদের সত্ত্বায়।
তা নিজেরাই বলতে পারি না।
আমাদের অকথিত এই পাতালবাস
একেবারেই হয়ে থাকে
ভাগ্যের নির্মম আখ্যান হয়ে,
আমাদের মানবীয় জীবনে।
মানুষ আমরা। বারবার স্খলিত হই
আমাদের বাঁচার প্রবণতা
আমাদের দুর্দমনীয়
উঠে দাঁড়াবার স্পৃহা তাই
বারবার আখ্যানভাগ হয়ে থাকে
আমাদের সকলের মানবীয় জীবনে।
আমাদের জীবনের সেই গল্প
সেই কথকতা জমে থাকে
জীবন্তিকার এক একটি খণ্ডে।
কোন কোন অঙ্কের কোন কোন খণ্ডিত দৃশ্যে
আমরা প্রতিভাত হই কখনও
অতিমানব রূপে। আমরা আমাদের
জগতকে তখন দেখতে চাই,
এবং দেখাতেও চাই,
দেখাই, এই আমি তো উঠে এসেছি!
আমি পুনরুত্থিত হয়েছি নতুন রূপে।
আমার মাঝে ফিরে এসেছে সজীবতা।
এসেছে প্রাণব্যাকুল গতি। পূর্ণ স্পৃহা। এবং
নূতন ক’রে বেঁচে থাকার প্রবণতা।
ঠিক এমন করেই আমরা মানুষ
আমাদের জীবৎকালে উন্মিলিত হতে থাকি
নিজেদের আত্মার ডানা মেলে।
আমরা উড়তে চাই মুক্ত বিহঙ্গের মতো।
আমরা উড়ি। উড়তে উড়তে একেবারে
এ জগতের সীমানা ছাড়িয়ে
কোন শূন্যের মহাশূন্যের অসীমে
যাত্রা করতেই থাকি পূর্ণ আবেগ নিয়ে।
আমাদের এই দীর্ঘযাত্রা
আমাদের এই মানুষী উন্মাদনা
আহা কতই না আনন্দের! উপভোগের!
আর এই সৃষ্টির আনন্দে আমরা হই
প্রাণব্যাকুল স্রষ্টার মতো।
বস্তুত স্রষ্টা হতে হতে আমরা
আমাদের নিজস্ব সীমা ছাড়িয়ে যেতে চাই।
আমাদের নিজেদেরকেও ছাড়িয়ে যেতে চাই।
আবার অনেকে আমরা তা করতেও পারি।
তারপর। তারপর কোন এক সময়
আমাদের প্রবহমান গতির মোড় ঘুরে যায়।
আমরা আমাদের উড়ালডানা গুঁটিয়ে
আমাদের দৃষ্টিতে, জ্যোতিরেখায়
আনি ব্যাপক অনিবার্য পরিবর্তন।
এ ছাড়া আমাদের তখন আর
কিছুই কর্তব্য থাকে না। আমরা মানুষ,
আমাদের অস্তিত্বকে সামাল দিতে
আমাদের স্বপ্নকে, আমাদের নিরেট বাস্তবতাকে
দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে করতেই
নেমে আসতে থাকি বাস্তবে।
মাটির কাছাকাছি। এ মাটি তো
আমাদেরকে আকর্ষণ করেই অনবরত।
তার মাধ্যাকর্ষণের ওমে আমাদের
জড়িয়ে ধরতে উন্মুখ হয়ে থাকে।
আমরা তো মাটির সন্তান। আমাদের
অস্তিত্বে তো আছেই মৃত্তিকাকণা।
সে তো অবিনশ্বর। তার রূপান্তর হয় মাত্র।
তার প্রতিটি কণায় যে রয়েছে
মানুষের নির্জলা কঠিন সত্য লুকিয়ে।
তাই আমরা পুনরুত্থিত হতে হতে
আবার স্খলিত হতেই থাকি। অনবরত।
কোন কোন সময় আবার, পাতালে গমন করি।
করি সত্ত্বা সমেত একান্ত নিজেদের অনিচ্ছায়
অনিয়ন্ত্রিত গতিতে কবরে কবরে।
এবং পরিশেষে এক সময়,
এক সময় চূড়ান্তভাবেই কবরে গমন করি
আমাদের দেহগত রূপটাকে সঙ্গে নিয়ে।
আমরা গমন করি। গমন করতে একান্ত বাধ্য হই।
নিজেদের ভবযাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে
পরলোকে যাত্রা করি চূড়ান্ত ভাবেই।
তখন বারবার পুনরুত্থানের আর
কোন পর্বই বাকি থাকে না আমাদের জন্য।
আর কোন পুনরুত্থান আছে কিনা,
তা একমাত্র স্রষ্টার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়ে
এই আমরা ইতি টানি
আমাদের সব পুনরুত্থান পর্বের।
কারণ, আমরা মানুষ!