অবশেষে কবর থেকে
বিদায় নিতে হল আমাকে।
আমার নিজস্ব কবরে আমার আর
স্থান হল না। ভেবেছিলাম,
চিরশয়ানে ওখানে ‘চির শান্তিতে’ই
শেষ বিশ্রাম নেব।
নাহ্! আমার নিজস্ব এই কবর
আমার নিজের আর হল না।
শেষ পর্যন্ত বুঝেই নিলাম আমি,
চর দখলের ন্যায় কবরও দখল হয়!
এখানেও মানুষের নির্মম দখলদারত্ব চলে।
তথাকথিত ভূমিদস্যুরা কবরেও হানা দেয়।
মৃতদের চির আবাস বলে খ্যাত;
এই কবরও কখনও বেহাত হয়ে যায়।
তো ‘জোর যার মুলুক তার’ শুনে বুঝে এসেছিলাম
জীবিত জগতে। এখন মরজগতে এসেও
হাড়ে হাড়ে বুঝে গেলাম।
জেনে গেলাম, জোর যার; কবরও তার।
এবং এখানেও পেশী শক্তি! জোরের মহড়া! দস্যুতা!
জীবিত থাকতে তো শান্তির ‘শ’ ও পাইনি জীবনে।
ভেবেছিলাম, ম’রে অন্ততঃ তার সন্ধান পাব।
কোথায় শান্তি?
না জীবিত অবস্থায়।
না কবরে!
হা! এখন কবর তুমি দ্বিধা হও!
বুঝে গিয়েছি। এতদিন ভেবে এসেছি,
এখানে এই মুক্তাঙ্গনে শুয়ে আছেন যাঁরা;
তাঁরা কত না শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।
কিসের চিরশয়ান! কিসের চিরশান্তি!
এখানে শয়তান নয়। শয়তানের বড় বাবা
জবরদস্তি, কর্তৃত্ব ক’রে যাচ্ছে।
এখানে কবরেও দেখি এলাকার কর্তৃত্ব নিয়ে
তুমুল বিতণ্ডা! এখন দেখি,
চিরশান্তির আবাস ব’লে খ্যাত
এই কবর আস্ত নরকে পরিণত হয়ে গেছে!
এই কবর থেকে মৃত মানুষেরা;
দিব্যি গায়েব হয়ে যাচ্ছে!
লাশ গুম হয়ে যাচ্ছে!
কী সাংঘাতিক! কী ভয়ানক!
এতদিন যে বিশ্বাস করিনি
কোন মতেই বিশ্বাস হয়নি
এখন দেখি নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতায়,
তা একেবারেই দিবালোকের মতই স্পষ্ট।
সূর্যের মতই সত্য।
অবলীলায় আমি যে কখন উৎখাত হয়ে গেলাম।
আমি যে কখন একেবারেই গায়েব হয়ে গেলাম,
প্রকারান্তরে গুম হয়ে গেলাম।
মানুষের অমানুষিকতার বলী হয়ে গেলাম
ভাবতেই শরীরের বেবাক হাড়গোড় আবার
এক হয়ে যেতে চাইছে!
এই হাড়গোড় সমেত জীর্ণ দেহটা
সটান খাঁড়া হয়ে যেতে চাইছে!
ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যাই!
ছুটে গিয়ে টুটি চেপে ধরি
ওই সমস্ত জ্যান্ত মড়াদের!
এরাও মানুষ! সভ্য মানুষ!
দাবি করে নিজেদের সৃষ্টির সেরা!
মৃতদের নিয়ে এত চোরাই ব্যবসায়!
কোথায় কোন অজানায় মৃত মানুষদের
চালান ক’রে দিচ্ছে!
পাচার ক’রে দিচ্ছে, নির্বিবাদে গুপ্তপথে!
কার কবরে কা’কে সেঁধিয়ে দিচ্ছে!
তার ইয়ত্তা নেই। নেই কোন শুমার!
আবার ইচ্ছেমত লাশ কাটা-ছেঁড়া করছে।
ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যবচ্ছেদ করছে তাবৎ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে অতসী দিয়ে।
বলে ময়নাতদন্ত! পোষ্ট মর্টেম!
অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখছে মর্গে দিনের পর দিন!
ইচ্ছেমত সুরতহাল প্রতিবেদন দাখিল করছে।
চোখ, হৃৎপিণ্ড, কিডনি কেটে
বিক্রি করে দিচ্ছে দালালদের কাছে!
কাকে কখন বেকসুর চালান ক’রে দিচ্ছে
কোন কর্তৃপক্ষের আমলে গছিয়ে দিচ্ছে।
প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়, আইন মোতাবেক হচ্ছে সবই।
কিসের আইন? কার আইন?
মৃতের জন্যে আইন?
এই আইনের আওতায় এনে
মৃতদের সৎকার হচ্ছে।
গুরুগম্ভীর সনাতনী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।
বলি, আরও কত কী হচ্ছে! তার ইয়ত্তা নেই।
ভাবখানা এই, ওরা মরবে না কখনও।
আসবে না কোনদিন এই কবরে।
নাকি, মরে গেলেও ‘জিন্দা’ ব’লে
চালিয়ে দেবে আইনের পাতা উল্টিয়ে।
প্রতীয়মান হয়, ভাবখানা এই
ওখানেও ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ প্রবচন
ওদেরকে সুরক্ষা করবে চূড়ান্ত।
এরকম অনেক দেখেছি। দেখেছি বলেই বলছি।
প্রমাণ মিলেছে,
শেষতক রক্ষা পায়নি কেহই।
আগামীতে পাবে না কখনও।
বিষয়টা ওরা জানে।
এটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা।
আমিও দেখেছি।
যারা গায়ের জোরে এ জগতটাকে
নিজদের পৈতৃক সম্পত্তি ভেবেছে
তাদের শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি কেহই!
কত কত সম্পত্তি! কারুকার্যময় বিশাল প্রাসাদ।
শিক্ষার, অর্থের কী জৌলুস! কী গর্ব! অহংকার!
নাহ্! শেষ পর্যন্ত কিছুই স্থায়িত্ব পায়নি।
ক্ষণস্থায়ী নড়বড়ে তাদের জগত
মৃত্যু নামক বাতাসের তোড়ে
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে একবারে মাটিতে
পরিশেষে ধূলিতে মিশেই গেছে!
তাই বলি, মানুষ তুমি মানুষ হও!
পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি পরিহার কর।
জীবিত অবস্থায় অন্ততঃ কবরের কথা
ভেবে দেখ। এ কবরে তোমার মত,
তোমার চেয়েও বড় মহাজনেরা এসে গেছেন!
তাঁদের অনেকেও তোমাদের মত
জীবিতদের নিয়ে, মৃতদের নিয়ে
ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে
নিজেদের হৈ-হুল্লোড়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
কী হয়েছে তাতে? তো, কী পেয়েছেন তাঁরা?
তাঁদের প্রাপ্তি ফল; ভিন্ন কিছুই হয়নি।
যা লেখা আছে পরিণামে,
তাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।
কেহ আর শতবর্ষী হতে পারেননি।
বিধির অমোঘ বিধান, লঙ্ঘন করতে পারেননি কেহই।
প্রবল অনিচ্ছায় সত্ত্বেও মাথা পেতে মেনে নিয়েই
আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে মৃত্যুর কাছে।
মৃত্যু নামক চিরসত্যকে আলিঙ্গন করতেই হয়েছে।
বরণ করতে হয়েছে, তার শীতলতাকে
একান্ত বাধ্য হয়েই।
তাই বলছি, এই কবর ও পরজগত নিয়ে ব্যবসায়
বাদ দিয়ে, হে মানুষ।
তোমরা সবাই এবার, মানুষ হও।