একজন বাবা, তিনি আপন মনে তাঁর দু’হাতের
আঙ্গুল ভেঙ্গে নিরীক্ষণ করেন উর্বরা মাটির ওম।
তিনি জানেন, যে বীজ তিনি সংরক্ষণ করেছেন এতদিন;
বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় কাটিয়েছেন দীর্ঘ নির্ঘুম রাত্রি
রঙিন স্বপ্ন সিথানে নিয়ে। প্রতীক্ষিত ঋতুর জন্য আপন মনে
রচনা করেছেন সূর্যের নিচে একটি বীজতলা। লালিত স্বপ্ন নিয়ে
সেখানে পানি দিয়েছেন তপ্ত-খর রোদ্দুরে। পূর্ণিমায় অমাবস্যায়
বাবা নিজের হাতের তালুতে ভূত-ভবিষ্যৎ দেখেন একজন ঋষির মতো।

একজন বাবা। বার বার হেঁটে যান তিনি, আঁতুড় ঘরের
পাশ দিয়ে। উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করেন, কখন জানি চিৎকার ক’রে ওঠে
তাঁর ঔরষে সদ্যজাত সন্তান। তিনি কায়মনে অপেক্ষা করেন, কখন একটি
প্রলম্বিত চিৎকারে মুখরিত হবে তাঁর বাড়ির আঙিনা। চিরল কামরাঙ্গা পাতার
আস্তরণ ভেদ ক’রে ঠিকরে ছুটে আসবে সোনালি রোদ্দুর! আহা কী আনন্দ!
তিনি তখন এক দৌড়ে ছুটে যাবেন তাঁর বীজতলায়। তাঁর বীজেরা কি
অঙ্কুরোদগম করেছে? দখিনা প্রাণিত বাতাসে কি কচি চারাগুলো ততক্ষণে
উদ্বাহু উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছে? তখন তাঁর প্রাণের আকুতি ধ্বনিত হয়ে উঠবে
বাতাশের গতিতে,‘হা ঈশ্বর! আমি একটি কান্নার রব শুনতে চাই।
একটি নবজাতকের প্রথম চিৎকার! তুমি দাও। মেঘলা আকাশ,
তুমি দাও। বৃষ্টি; তুমি দাও। আমার আকুল প্রাণের আকুতি তুমি শোন। ঈশ্বর!’
পরক্ষণেই তিনি শুনতে পান;
তাঁর মায়ের চিত্রিত কণ্ঠ,
‘খোকারে! তুই বাবা হয়েছিস! একজন বাবা ...!’

প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তিনি কান পেতে থাকেন। হ্যাঁ।
ওই তো চিৎকার! বাড়ির নতুন অতিথি জানান দিয়েছে
তার আগমনবার্তা। ওই তো তাঁর মায়ের অতি আদুরে কন্ঠ!
এবং বাবা তিনি, এক দৌড় ছুটে যান তার বীজতলায়।
তাঁর সন্তান, সে কন্যা না পুত্র; তা শোনার সময় কোথায়! সে যেই হোক!  
তিনি একজন জনক বুঝতে পারেন, আকাশ ভেঙ্গে এখনই
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসবে! সত্যই তিনি দেখতে পান! ওই যে
উত্তরের আকাশ, ওই যে পশ্চিমের আকাশ ছেয়ে গেছে ঘনমেঘে!

একজন বাবা, তিনি দেখতে পান, আহা!
দখিনা বাতাশে আন্দোলিত হয়ে উঠেছে
তাঁর আপন হাতে রচিত বীজতলা। কচি-চারারা ন’ড়ে উঠছে!
মনে হয় ওরাও তাঁর প্রথমজাত শিশুটির মতো অভূতপূর্ব জন্ম-চিৎকারে
পৃথিবী মাতাতে চাইছে। একজন সদ্যজাত সন্তানের পিতা। তিনি হাঁটু ভেঙ্গে
নিজেকে সমর্পণ করেন ধূলিমগ্ন-জমিনে। করজোড়ে ঈশ্বরের পদতলে
সমর্পিত হন কৃতজ্ঞ চিত্তে। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘মহান ঈশ্বর তুমি!’
তিনি তাঁর দু’হাত খুলেই দান করেছেন একজন স্বপ্নবিলাসী বাবাকে।

নিশ্চয় তিনি বলছেন, ‘এবার তুমি বাবা হও। এবং বহু বংশের পিতা হও।’
তাই, একজন বাবা, তিনি দেখেন সামনে
তাঁর ফলদায়ক শস্যের দিগন্তবিস্তারি মাঠ আর মাঠ!
তাঁর ঘামে সিক্ত সেই শস্য দানারা  সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে।
তাই বাবা তিনি মনে মনে হেসে বলেন,
‘বটেই। এবারই আমি একজন স্রষ্টা হলাম!’