হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে লালিত
এক বদ্বীপ শোষক শাসকের পিঞ্জরে আবদ্ধ থেকে
মুক্তির নেশায় আপ্লূত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে বার বার।
আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন।
বায়ান্ন থেকে একাত্তর। তারপর।
নতুন উপকূলের প্রাঙ্গণে বাঙালির নোঙর রচিত হয়।
তিনি এক আশ্চর্য বংশীবাদক। তাঁর ডাকে
মুক্তির উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বদ্বীপ জুড়ে।
বাঙালি ছুটে যায় রণাঙ্গনে। কাঁদা মাখা হাতে
তুলে নেয় রাইফেল। গ্রেনেড।
হানাদারদের ও তাদের দোসর রাজাকারের
বিধ্বংসী তাণ্ডবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
নয় মাসের তাণ্ডব পেরিয়ে
তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে
লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে
একটি বদ্বীপ জেগে ওঠে
বাংলাদেশ হয়ে।
একাত্তরের সীমাহীন তাণ্ডব শেষে
ধ্বস্ত বিধ্বস্ত আবহে বিরচিত হয়
লাল সবুজের বুননে এক নবীন পতাকা।
আর তার সংবেদে মূর্ত হয়ে ওঠে
সবুজ শ্যামলিমার আঁচল জুড়ে
জ্বলজ্বলে রক্তিম সূর্য এক। কী এক প্রাণময় বিভব
উদ্বেলিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ নামক নতুন শব্দটিতে।
যেন তাকে আঁকড়ে ধরেই বাংলা বাঙালি মাত্রা খুঁজে পায়
নবতর এই উপকূলে। আর। আর এত সবের মূলে
যিনি কাণ্ডারি, তিনি টুঙ্গিপাড়ার দুরন্ত রাখাল বালক
শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর মানবিক এবং তেজদীপ্ত পরিচর্যায়
ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন নয়নমণি
বাংলা বাঙালি আর বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ
বঙ্গবন্ধু।
তিনি সমস্ত ধ্বংসস্তূপের উপর
ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত প্রত্যয়ী
একজন উদ্বোধক।
তাঁর অবয়ব বিম্বিত হয়ে ওঠে
পুরো বাংলাদেশ জুড়ে।
তারপর বিশ্বের প্রান্ত থেকে প্রান্তে
তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এক মহাপুরুষ এগিয়ে আসেন দৃপ্ত পায়ে।
উঠে আসেন তিনি
জাতিসংঘের শামিয়ানার নিচে স্থায়ী মঞ্চে।
স্বমহিমায় নিজেকে করেন উপস্থাপন
বীর বাঙালির গর্ব নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের নজরুলের জীবনান্দের
বাংলায় তাঁর কবিকণ্ঠ সাবলীল প্রতিধ্বনিত হয়।
তিনি বিধ্বস্ত বাংলাকে গড়ে তুলতে
তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের আঁখরে
লিখিত বাংলাকে দাঁড় করাতে
উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দেন নতুন এক সংগ্রামের।
এ সংগ্রাম দেশকে বিনির্মাণ করার
দৃঢ় প্রত্যয়ী এক নবতর স্বপ্নযাত্রা।
দেশের মানুষকে এক কাতারে
সামিল করে এগিয়ে যাবার নাম
দ্বিতীয় বিপ্লব।
হ্যাঁ। এগিয়ে যাবেনই তিনি।
যাত্রা শুরুও করেছেন তিনি।
আর ঠিক এমনই সময়
ঘাতকের উদ্যত বন্দুকের ট্রিগারে
খানেদজ্জালের আঙ্গুল নড়ে ওঠে।
মুহূর্তে ঝলসে ওঠে প্রাণঘাতি বন্দুকের নল।
নারকীয় আক্রোশের বুলেট বিদ্ধ করে
স্বপ্নদ্রষ্টার অমিত অবয়ব।
আর সাথে সাথে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান
তিনি বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েন!
সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে
গড়িয়ে পড়ে তাঁর পবিত্র দেহ
কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা
ছিটকে পড়েছে টুকরো টুকরো হয়ে
তাঁর নিজের হাতে অঙ্কিত
মানচিত্রের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত
স্বপ্নদীঘল প্রাঙ্গণ জুড়ে!
শাদা সফেদ পাঞ্জাবি। লুঙ্গি।
রক্তে রক্তে জবজবে হতে থাকে।
সিঁড়ি বেয়ে রক্ত নিচের ঘুলঘুলিতে
গড়াতে থাকে অনবরত।
বাংলার পদ্মা। বাংলার মেঘনা। বাংলার যমুনা।
পিতার রক্তে রঞ্জিত হতে হতে এক সময়
তীব্র হাহাকারে বঙ্গপোসাগরে নেমে আসে।
জনকের দেখা সেই স্বপ্ন
জনকের কলমে লেখা সেই স্বপ্ন
জনকের তর্জনীতে প্রস্ফুটিত সেই স্বপ্ন
কী এক অমানিশার ঘোরে আবর্তিত হতেই থাকে।
পুরো বাংলা। সব বাঙালি। পুরো মানচিত্র।
খেই হারিয়ে নিঃসীম প্রলয়ের আকস্মিক অভিঘাতে
আবর্তিত হতেই থাকে। ওদিকে কাপালিক হায়েনার
দাঁতাল হাসি রক্তলোভী হাসি হাসতে থাকে।
ওদের সেই হাসি ক্রমাগত কালবৈশাখীর মাত্রা নিয়ে
প্রলম্বিত হয় সর্বত্র। তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ।
বাংলার সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রত্যন্তে।
একাত্তরে পরাজিত হানাদারের দোসর
পঁচাত্তরের খুনে দজ্জালরা ভেবে নিয়েছে
চিরতরেই থেমে গেছে
সেই শেখ মুজিবুর রহমান নামের
সেই বঙ্গবন্ধু নামের
আদলে রচিত স্বপ্নযাত্রার উপাখ্যান।
কিন্তু না!
কিন্তু না! একজন শেখ মুজিবুর রহমান
একজন বঙ্গবন্ধু সামনে না থাকলেও
বাংলাদেশ থাকবে।
বাংলা থাকবে।
থাকবে লাল সবুজের সজীব এক পতাকা।
আর এত কিছুর পরও সবকিছুকে সামনে রেখে
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই।
এগিয়ে যাবেই সামনে।
তিনি আছেন বাঙালির মননে।