চেতনার সব কটি শিকল
আমাকে করেছে বন্দি।
আমি নির্বাসনে নিজেকে করেছি রুদ্ধ।
বন্ধ করেছি দিয়েছি সম্ভাব্য সব পথ।
না। না। জীবন থেকে পালাতে নয়
ছুটে বেড়াতে নয় দিক্বিদিক চক্রবালে।
আমাকে নিয়ত ব্যতিব্যস্ত রাখতেও নয়।
একান্ত বাঁচার প্রশ্নে
জীবনের সবকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে
উৎরে যেতে চাই সমূহ যন্ত্রণার বৃত্তকে।
তাইতো সব থেকে আমাকে
সবকিছু থেকে চেতনাকে
আলাদা করেই স্বতঃসিদ্ধ বলয়ে
স্থিত হয়েছি
আমার এ স্থিতি জানি খুব বেশি
স্থায়ী হবেনা বর্তমান পরিসরে
স্থায়ী হবেইবা কেন? কীইবা এ যাবত
স্থায়ী হয়েছে এ উচাটনের সত্ত্বায়?
কী রেখে এসেছি আমার পিছনে
অতীতের ক্যানভাসে?
কিছু না। কিছুই নেই।
তেমন কিছু আমাকে
পিছু টেনে নিতে চাইবে ফের
তাইতো নিজেকে ভেবেছি
এক অস্থির যাযাবর।
আমি নিঃসঙ্গ। নেই কোন সহচর আমার।
নেই কারো সাথে সখ্যতা
যার সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে জীবনের কথা,
অতীতের কথা, ভালোবাসার কথা,
এবং স্মৃতিমেদুর অতীতের কথা বলবো।
যাকে নিয়ে নূতন করে ভেবে চিন্তে
এগিয়ে যাবো সামনে।
রচনা করবো নিত্য নূতন অভিজ্ঞতার প্রচ্ছদ।
আমি কি সেই?
আমি কি সেই আমি?
আর আমি কি সত্যই আমি?
সোনালি অতীত বলে যা ছিল
যা নিয়তই আমাকে পরিতৃপ্ত করতো
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সব স্মৃতি
করতাম এক সময় রোমন্থন।
আর এখন আমি কি সেই?
সেই মানুষ আমি স্মৃতি এক সময়
আঁকড়ে ধরেছি সামনে এগিয়ে যাবো বলে।
স্মৃতিমেদুর হয়ে জীবনের জীবনের পরতে পরতে
জমিয়ে রাখতাম রঙিন সমস্ত আলপনা।
আর এখন আমি পুরোপুরিই আর একজন।
আমার পায়ের ধূলি
আমার স্মৃতির খাতায় দুহাতে ঘষে ঘষে
সমস্ত পৃষ্ঠা করে দিয়েছি শাদা।
ওই সমস্ত শাদা পৃষ্ঠা এখন আমাকে
এই আমাকেই করে উপহাস!
স্মৃতি বিষয়ক কোন রচনাই নেই
আমার খাতায় এখন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা
একেবারে আদিগন্ত শূন্যতায় ভরপুর।
শুধু শূন্য আর শূন্য এখন।
তাই আমি নির্বিবাদে স্থিত হয়েছি বর্তমান নিয়ে।
বর্তমানকাল বড়ই দুর্বিষহ। বেঁচে থাকাই
যেখানে মানুষের জন্য চরম ও পরম
চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে আমি
এই আমাকে নিয়ে কী ভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা
ভরিয়ে দেবো সেই মধুর দিনগুলোকে নিয়ে
বিমল কাব্যকথায়? আমার দুর্বিনীত সময়
কোন ভাবেই আমাকে ছাড় দিতে চায় না।
কোন কিছুই আমার পক্ষে নেই আর।
আমি এখন নিজেকে ছাড়া আর
কী ভাবতে পারি? না আমার ভূত ভবিষ্যৎ
না আমার সোনালি অতীত সব।
কীইবা হবে আমার পক্ষে প্রামাণিক?
এই আমি এখন কেবল আমাকে ছাড়া
আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
এ সময়। এ দুঃসময়ের পেন্ডুলামে কেবল
বিপ্রতীপ সমস্ত কিছু দোল খাচ্ছে।
বস্তুত আমি দেখতেই পাচ্ছি সবকটা কাঁটা ঘুরছে।
বড় কাঁটা। মধ্যম এবং ছোট কাঁটা।
কেহ দ্রুত। কেহ ধীরে। এবং কেহ
একেবারেই ধীরে। তবুও তারা ঘুরছে।
নিয়ত আমার সমূহ আশংকা এখানেই।
কখন আমার লগ্ন আমাকে ঠেলে দেবে
অনিবার্য সময়ের চাকার তলে।
আমার ভয় সেখানেই,
আমি ঠিক নির্ধারিত সময়েই পতিত হবো
পেন্ডুলামের নিচে! কী এক অমানিশা আমাকে
ক্ষণিকে ঢেকে দেবে। তলিয়ে নিয়ে যাবে
সীমাহীন গভীর আঁধারে! হায়! আমার অতীত।
হায় আমার বর্তমান এবং আমার ভবিষ্যৎ!
আমি কিছুতেই কোন কিছুকে আর সমান্তরালে দাঁড়
করাতে পারলাম না। পারলাম না আমার
যত আছে শক্তি। আছে যত প্রতিভা সব মিলিয়ে
শুধু আমার জন্য কিছু একটা করতে।
এ সময় আমি স্থিত হই নিয়ত
যা আমার সামনে দেখি চলমান।
এ কি আমার বর্তমান? আমি কি এই বর্তমানের কাছে
সমর্পিত অস্থির এক সত্ত্বা? আমি কি পারি না
আমার সমূহ অস্তিত্বকে সমর্পণ করতে
নিয়তই যা আমাকে করে আছে পরিবৃত?
তারই কাছে সাষ্টাঙ্গ হয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে?
আমার প্রয়াস এখানেই। আমি আমার ইচ্ছাকে,
আমার স্বপ্নকে, আমার সব সত্ত্বাকে ক্ষণিকেই চালাই
পারষ্পরিক বৈপরীত্যে দাঁড় করাবার কুশলী প্রচেষ্টা
আমি সফল হবো কি না
আমি হেরে যাবো কি না
একমাত্র নিয়তিই তা জানে।
তবুও আমি আমার ইচ্ছার কাছে হই সমর্পিত।
দলিত করি সব যা আছে আমার পায়ের নিচে।
চলমান জীবনকে আমি উপভোগ করতে চাই
এক অনাস্বাদিত চেতনার রুপকে মণ্ডিত করে।
কী আছে আমার? আমি কি অহংকারী একজন মানুষ?
আমি কি নিজেকে এক বিশাল উচ্চতায় দাঁড় করিয়ে
ভাবি, আমি তো এখন আমি নই!
আমি তো আমার পুরনো পারিপার্শ্বিকতাকে উৎরে এখন
ভিন্নতর উচ্চতায় এসে দাঁড় করিয়েছি।
আমার ভেতরের উচ্চারিত শব্দমালা
ভুলে গিয়েছি। অমায়িক তার রূপ
আমার ভেতরের উচ্চারিত শব্দমালা কেবল বেগিতক।
ক্ষিপ্রতার অনুষঙ্গে বেঢপ হয়ে জ্যামিতিক আকার
ধারণ করে। আমার কাছে তা ভালো লাগে না।
আমি বিরক্ত হই। আমি আমাকে নিয়ে নিয়তই
এক অনাচারে বিব্রত হই। আমি হই সময়ের সাথি।
এ সময় আমাকে টেনে নিয়ে যায় কালের বৈপরীত্যে।
আমাকে দাঁড় করায় হাজার প্রশ্নের সামনে।
আমি কোন প্রশ্নের কোন উত্তর সঠিক দিতে পারি না।
পারবো কী আর! আমার ভেতরের আমি তো এখন
খুবই নচ্ছার হয়ে চরিত্রহীন প্রচ্ছায়ায় নিজেকে করেছি
আবৃত। আমার এ আবরণ আমাকে রক্ষা করতে
পারে না। এ আবরণ আমাকে ছদ্মবেশী হতে
প্রলুব্ধ করে। আমি বারবারই প্রলুব্ধ হই।
নিজেকে সমর্পণ করি ইচ্ছার ছায়াতলে।
তার চাকার অবয়বে হই নিয়তই পিষ্ট।
এখন দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
কেবলই ক্ষণ গণনা করি। কখন হবে আমার
শেষ নিঃশ্বাসের সেই মুহূর্ত! আমি সবকিছুকেই
দুহাতে ঠেলে হাতপা সব নিবৃত করে
স্থিত হবো শেষ শয়ানে। আমার শেষ নিঃশ্বাস
আমাকে ছেড়ে ঊর্ধ্বে অসীম ঊর্ধ্বে যাত্রা করবে
আমাকে ছেড়ে। আমার সব মায়া ত্যাগ করে
আমারই শেষ ইচ্ছা চিত্রায়িত হবে জাগতিক
পটে। হ্যাঁ। আমি এক নট ছিলাম ব্যস্ত আমার
নাট্যমঞ্চে। আমার গতি প্রকৃতি আমার সংলাপ।
আমার অভিনয়ের ভঙ্গি সব কিছু
এখন আমাকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়।
আমি কী? হ্যাঁ আমি কি ছিলাম এখানে
এই নাট্যমঞ্চে একজন সাধারণ অভিনেতা?
আমি কি পেরেছি আমার চরিত্র সঠিকরূপে
পরিস্ফুটন করতে? আমার অভিনয়শৈলী আমাকে
প্রকাশ করতে পেরেছে কি সঠিক মাত্রায়?
আমার সন্দেহ এখানেই। আমি নিয়তই
ছিলাম চাপা স্বভাবের। আমি নিয়তই নিজেকে
আবৃত করে রেখেছি অন্য এক মলাটের আবরণে।
দুরাচারী আমি আমার চরিত্রে তেমন কিছুই
ভালো কিছু যোগ করতে পারিনি।
এ জগতের যা কিছু মন্দ, যা কিছু অবান্তর জঞ্জাল
সবকিছুই বুঝি আমার চরিত্রে লেপ্টে আছে
সব আবর্জনাই বুঝি আমি সজতনে
লালন করছি এই আমার জীবনপুস্তকে!
তার পাতায় পাতায় বুঝি সবকিছুই
কালিমা লেপ্টে দিয়েছি অনাবিল বৈভবে।
আহা! আমার কী দুর্বলতা এখানে।
আমার সমূহ পরাজয় এখানে।
আমি পারিনি নিজেকে সংবরণ করতে
সেই সরলরেখা থেকে। যে রেখায়
এই জগতের সব মন্দ এসে ভিড় করে-
পুঁতিগন্ধময় আস্তাকুড়ে! যত সমস্ত বর্জিত বিষয়,
যতসব নিক্ষিপ্ত আবেশ আমার চরিত্রে সযতনে
করেছি লালন। এই হল আমার চরিত্র!
এই হল আমার বৈশিষ্ট! জানিনা। কেন
এমন হলাম আমি! তবে কি আমি আমার
বিবেকের কাছে, আমার ভবিতব্যের কাছে
পরাজিত এক যোদ্ধা? আমি যুদ্ধ করছি
সমস্ত বৈপরীত্যের বিরুদ্ধে। আমার সামনে
দুর্বিনীত ঊর্মিমালাকে আমি সজোরে করেছি প্রতিরোধ।
আমি এগিয়ে এসেছি সামনে আমার
যত ছিল শক্তি। যত সামর্থ। সবকিছুকে সঙ্গী করে
ঠেলে এসেছি সময়কে এই আমার সামনে দাঁড় করিয়েছি
আমি কিছু একটা করবো বলে। কিছু একটা রেখে যাবো
বলেই বুকে আমার ধারণ করেছি স্বপ্নকে।
লালন করেছি সজতনে প্রাণের সব আকুলতা নিয়ে।
আহা! আমার সান্ত্বনা এখানে।
আমি তো হারিয়ে যাইনি।
আমি তো সামনে আমার এগিয়ে এসেছি
দ্রুত আমার সমস্ত পারিপার্শ্বিকতাকে পিছনে ফেলে।
সবকিছুকে পিছনে ফেলেই তো আজকের এই আমি।
কী আছে জড়িয়ে আমার সেই অতীতের
অতীতের কিছুকে কি আমি সঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছি?
আমি আমার হাতের আঙুল নেড়ে দেখেছি।
নাহ্! কিছুই তো নেই আমার সঙ্গে।
না কিছু চিহ্ন। একেবারেই কপর্দক হীন আমি এসে
দাঁড়িয়েছি এখানে। এখানে এ সময় এমন কিছু নেই
যা আমার সামনে ধরে বলবো, এই আমার অতীত।
আর এই অতীতকে সঙ্গে নিয়েই নিয়েই আমি
বর্তমানের কাছে সমর্পিত এখন। এগিয়ে যাবোই
ভবিষ্যতের কাছে। নিজেকে আবার সমর্পিত করবোই।
এখন এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি অতীতের মোহ নিয়ে
নাহ্! নেই। কিছুই নেই। আমি দেখি, একেবারেই
শূন্য আমি। কোন কিছুই এখন আমার সাথে
যোগ করতে পারিনা আমি। কেনা, শূন্যের সাথে
যা কিছুই আমি যোগ করতে চাইনা কেন
তা আমাকে হতাশ করেই কেবল।
আমি নিয়তই শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে থেকেছি।
শুন্যকে অবলম্বন করেই শূন্যে পর্যবসিত করছি সব কিছুকে।
এখন দেখি, শূন্যই আমার অবলম্বন। শূন্যই আমার সব।
তো, অজস্র বিনিদ্র রাত আমি টানা তপস্যায় কাটিয়েছি।
জীবনের সুর করেছি অন্বেষণ।
আনন্দের, দুঃখের, সুখের, অসুখের অনুষঙ্গে
খুঁজে ফিরেছি আমার ইপ্সিত জৈবিক শব্দমালা।
কঠিন শিলা ভেঙ্গেচুরে কবিতার পঙক্তি বের করে এনেছি।
আহা! কত সযতনে আমি সংরক্ষণ করেছি-
কবিতার শৈলীশব্দ আমার বুকে!
আমি খাঁদের কিনারে দাঁড়িয়ে নিয়ত দেখেছি
পাহাড় থেকে প্রচন্ড গতিতে নেমে আসা ঝর্ণাকে।
সেখানে জলধারায় আবিষ্কার করেছি গতিময় প্রাণের স্পন্দন।
আমার নিজের বুকে লেপ্টে নিয়েছি সেই
ঝর্ণার আবহকে। সেই তার গতিকে। স্পন্দনেকে।
কী দুর্মদ ভঙ্গিতে এই প্রকৃতিকে, এই সুন্দরকে
আমার সত্ত্বায় করেছি লেপন। হেঁটেছি পাথরময় বেলাভূমিতে।
সেখানে দেখেছি অগণিত প্রাণেরা
কেমন বেঁচে থাকার, টিকে থাকার মানবীয় সৌন্দর্যে
নিজেদের অনাবিল উপস্থাপন করে
বালুকাবেলায় আহা সমুদ্রের ফেনিল তরঙ্গমালা!
কী শব্দ! কী তার ঝংকার!
যেন এখানেই জীবনের সব সৌন্দর্য
একসাথে জমাট হয়ে আছে!
সমুদ্র যেন বলছে, হে মানুষ! যদি পারো
আমার কাছ থেকে, সৌন্দর্য; জীবনের স্পন্দনে
যা পারো দুহাত ভরে তোমার বুকে, তোমার সত্ত্বায়
লেপ্টে নাও। আমি তো বিশাল।
আমার নেই দান করার কুণ্ঠা।
আমি তো সমস্ত প্রাণীকূলের, সমস্ত প্রকৃতির
এবং মানুষের জন্য।
সেই সমুদ্রের কাছে বারবারই
ছুটে গিয়েছি আমি। অঞ্জলি ভরে তার লোনাজল
ছিটিয়েছি আমার শরীরে। সমুদ্রকে মেখেছি আমার সত্ত্বায়।
আজ আমি দাঁড়িয়ে এখানে।
আমার সামনে কি পিছনে নেই এখন
আসমুদ্র অনুভূতি। আমার চোখেমুখে দ্যুতি খেলে যায় না
এখন আকাশ ও জলরাশির আলিঙ্গনের বৈভব।
এখানে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।
আমি দাঁড়িয়েই থাকবো।
জানিনা এভাবে আর কতকাল কাটবে আমার
মানবজীবনের দিনরাত্রি চৈতন্যের এ কারাবাসে!
ডিসেম্বর ৬, ২০২০
[আজ ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে করোনা আক্রান্ত অবস্থায় কম্পোজ শেষ করলাম।]