[একটি আয়নাঘরের ছবি সামনে রেখে!]
দন্ডিত পুরুষ আমি
খন্ডিত অবয়বে
কষ্ট নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি আমার জীবন
পরাবাস্তবের এই আয়নাঘরে।
খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে
আটকে আছি আমি এখন
পার ক’রে দিচ্ছি আমার
যন্ত্রণাকাতর এ জীবন!
কবে, কখন মিলবে আমার মুক্তি
আমি নিশ্চিত নই।
এমনকি, জীবিত এই আমি
এখান থেকে বেরিয়ে
বাইরের মুক্ত বাতাশ
বুক ভ’রে নিতে পারবো কিনা
আমি জানি না।
আমি নিশ্চিত নই,
বাকী জীবনটা আমার প্রিয়জনদের সাথে
একান্ত নিবিড় সান্নিধ্যে
কাটাতে পারবো কিনা।
আমি এখন বন্দী
সময়ের অনিবার্য আয়নাঘরে।
আমার জন্য,
কী দুর্বিষহ সময় এখন!
মনে হচ্ছে,
আমি এখন পৃথিবীর ভয়ংকর বাস্তবতার
মুখোমুখি অবস্থান করছি!
অথচ, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
তবে কি এই কঠিন বাস্তবকে
আমার প্রাপ্য ব’লে মেনে নিতেই হবে?
এই আয়নাঘরে আসার পূর্বে
আমার জীবনযাপন ছিল স্বচ্ছন্দ।
সে তো ছিল সৃজনশীলতায় ভরপুর।
দেশের মানুষের কল্যাণেই
আমি ধরেছিলাম আমার কলম।
আমি তো চেয়েছিলাম
বর্তমান অব্যবস্থার অচলায়তন ভেঙ্গে
আমরা সকলে মিলে উপনীত হবো
অনন্য এক সম্ভাবনার দরজার কাছে।
সেই দরজা খুলে আমরা
দেখতে পাবো অভূতপূর্ব এক সূর্যোদয়!
তার নতুন আলোয়
সকলেই আলোকিত হয়ে
সুন্দর শান্তিময় একটি দেশের চিত্র
করবো রচনা। এর চেয়ে বেশী কিছু নয়।
খুব বড় প্রত্যাশাও ছিল না
আমার কল্পনায়। চিন্তা-চেতনায়।
এই তো আমার অপরাধ!
এই আয়নাঘরের কথা শুনেছিলাম আমি।
কিন্তু, বিশ্বাস করতে চাইনি।
প্রশ্ন জাগে মনে, আমার দেশে আয়নাঘর কেন?
এই আয়নাঘর তো সে আরেক
দুঃসহ অমানবিকতার ইতিবৃত্ত!
আয়নাঘর তো মনে করিয়ে দেয়
মধ্যযুগীয় পাশবিকতার কথা!
আর এখন?
আমার রুঢ় বাস্তবতা এবং
কঠিন অভিজ্ঞতা দিয়েই
আয়নাঘরের চিত্র আমাকে
বাস্তবে দেখতে হচ্ছে!
আমার সত্তার পরতে পরতে
তার বাস্তবতাকে অনুভব করতে হচ্ছে।
হা আয়নাঘর!
এই পৃথিবীর গতি
মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা
এখানে এসে যেন স্তব্ধ হয়ে আছে!
যেন অনন্ত অন্ধকারে
নিমজ্জিত হয়ে আছে
মহাকালের ইতিহাস! ঐতিহ্য!
কোথায় মানবিকতা?
কোথায় মানুষের বিবেক?
এখানে এই আয়নাঘরে এসে
সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে মিশে আছে
জমকালো চার দেয়ালের পলেস্তরায়
মেঝের ক্ষুদ্র আয়তনের পরিসরে এবং
উপরে সিলিঙের শরীরে ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা
লাশের অবয়বে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ আমাকে!
ওদিকে আয়নাঘরের সংকীর্ণ পথ এসে
থেমে গেছে সামনের লৌহ কপাটের কাছেই।
এখানে কালের ধুলোর পুরু আস্তরণ
বিভীষিকাময় ক’রে তুলেছে বর্তমানকে!
মনে হচ্ছে, এই ধুলোর নীচে
চাপা প’ড়ে আছে বন্দী অসহায় মানুষের
যত দীর্ঘশ্বাস! চোখের জল!
এমন কি, তাদের অনেকের মাথার খুলি।
হাড়, কঙ্কাল ইত্যাদি!
এখানে প্রায়ই শুনি আমি
অসহায় মানুষের কান্নার চাপা শব্দ!
তাদের আহাজারি।
তাদের দীর্ঘশ্বাসের স্পন্দন
এই আমাকেও চমকে দেয়
আমার বেঁচে থাকার আশাকে
একেবারেই দুর্বল করে দেয়!
জীবনের বাস্তবতাকে নড়বড়ে করে দেয়!
আমার আশেপাশে যারা
আমারই মতো একেবারেই একা,
তাদের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে
তারাও কি আমার উপস্থিতি
বুঝতে পারছে
তাদের সংবেদন দিয়ে? হয় তো পারছে!
আচ্ছা। এখানে এই আয়নাঘর থেকে
কেহ, কোন বন্দী কি মুক্ত হয়ে
ফিরে গিয়েছে বাইরের জগতে?
তারা কি খোলা আকাশের নীচে
দাঁড়িয়ে বুক ভ’রে নিঃশ্বাস নিতে পারছে?
এবং তাদের প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে
পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গসুখ উপভোগ করছে?
আমি জানি না।
তবে আমি চাই, তাই যেন হয়।
তাদের সকলের কথা ভাবলে
আমি আতংকিত হই!
আমার চোখে জল আসে!
না। এখানে এই আয়নাঘরে, কারো জীবন যেন
দীর্ঘস্থায়ী না হয়। এমন কি আমারও।
আমি চাই,
আমরা বন্দী যারা
এখানে কাটাচ্ছি দুঃসহ সময়,
সহসা সকলেই যেন বেরিয়ে যেতে পারি।
নিশ্চয়, পারবো একদিন।
আমি নিশ্চিত, সেদিন খুব বেশী দূরে নেই।
নিশ্চয় হঠাৎ একদিন,
আচমকা আমাদের আয়নাঘরের লৌহকপাট
খুলেই যাবে। তখন চমকে উঠবো আমরা।
আহা, কী অসম্ভব বিষয়!
বাস্তবিক সম্ভব হয়েছে, আমাদের জন্য!
তখন, পিছনের সব অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত,
যন্ত্রণা ভুলে দৌড়ে ছুটে যাবো
বাইরের মুক্ত আঙিনায়!
সেখানে গিয়ে দেখবো,
মুক্ত আলোর ঝলকানি!
মুক্ত বাতাশ!
মুক্ত আবাহন!
একে একে সকলেই আমরা
মুক্ত হয়ে ফিরে যাবো আমাদের
নিজস্ব ঠিকানায়। ফিরে যাবো,
প্রিয়জনের কাছে। তারা আমাদের
অপেক্ষায় কঠিন সময় করছে যাপন।
সহসাই আমাদের কাছে পেয়ে
তারা জড়িয়ে ধরবে আমাদের!
তাদের উষ্ণ সান্নিধ্যে উজ্জীবিত হবো আমরা
আয়নাঘরের অধিবাসী সকলেই।
আমাদের গলায় পরিয়ে দেবে তারা
তাজা রঙিন ফুলের মালা।
হাতে তুলে দেবে গোলাপস্তবক।
অপেক্ষায় আছি সেইদিনের।
প্রার্থনায় নিমগ্ন সময় কাটিয়ে দিচ্ছি এখানে,
‘হে দয়ালু মহান সৃষ্টিকর্তা!
তুমি আমাদের মুক্ত কর!
এই আয়নাঘরে বন্দী আমাদের সবাইকে
তোমার হাতে রাখি।
তুমি আমাদের রক্ষা কর!
আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি,
আমাদের জীবনে তোমার ভালোবাসার
প্রমাণ দেখতে পাবো আমরা!
তুমি শোন আমাদের কান্না!
শোন আমাদের আর্তনাদ!
পূরণ কর আমাদের প্রার্থনা
হে মহান সৃষ্টিকর্তা!’
-------------
মে ২৯। ২০২৪