মহামতি নোহের অভিজ্ঞানের নৌকা ঘাটে এসে নোঙর করেছে।  চারদিকে অদ্ভুত সুনসান নীরবতা! সুদীর্ঘ ঝড়-ঝঞ্জা, বৃষ্টি-প্লাবনের পর  ঝলমলে আকাশে সীমাহীন নীলের গভীরতা পরিবেশকে মূর্ত করে রেখেছে। কোনদিকেই নেই সতেজ সবুজের চিহ্ন। নবোদিত সূর্যের আলোয় সবেমাত্র সৃষ্টির সব যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি শ্বেত কপোত নৌকার মাস্তুলের উপর ব’সে গা ঝাপ্টাচ্ছে। মনে হয় দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণে অতিশয় ক্লান্ত সে। তার দু ঠোঁটের মাঝে এখনও কচি পাতে সমেত গাছের শাখা শোভা পাচ্ছে।

পশ্চিম আকাশে বিশালাকার এক রংধনু! নৌকার যাত্রী সকলের দৃষ্টি এখন সেদিকে। সকলেই প্রচন্ড আগ্রহ ও অপেক্ষায়। কখন নৌকা থেকে নামার আদেশ আসবে। লম্বা শ্বেত শুভ্র চুল, দাড়ি ও আলখেল্লা পরিহিত এক ঋষি প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর গায়ের সব কিছু মুক্ত বাতাসে খোলা আকাশের নিচে উড়ছে। নৌকার ভিতর রাজ্যের কোলাহল।

আমি কান পেতে রই। দৃষ্টি আমার দূর; অনেক দূরে। কখন নামতে পারবো, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আমি দেখি, আমি আমার সামনে যত মানুষ ও প্রাণীকুল দেখছি, সকলের চোখে মুখেই দ্যুতি খেলে যাচ্ছে। সবাই আকুল আগ্রহ নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে।

এরই মাঝে কত সময় কেটে গেছে বলতে পারবোনা। আমার পক্ষে বলাও সম্ভব নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তার সমীকরণ নির্ণয় করাও দুষ্কর।  আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, বাঃ সুন্দর জগত! মনে হয় এই মাত্র পরম যত্ন সহকারে কোন এক মহান শিল্পীর অজাগতিক  পারঙ্গমতায়  রঙে, সৌরভে, ছন্দে, গন্ধে নতুন এ জগতটাকে সৃজন করা হয়েছে। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। পায়ের তলায় আমার কচি সবুজ তৃণের সমাহার। আহা কী প্রাণের স্পন্দন!

রাজ্যের পশুপাখি সরীসৃপ সব ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আমি এগিয়ে গেলাম। তারপর হাঁটছি। শুধুই হাঁটছি।
সামনের দিকে দেখি এক কাঠুরের কুঁড়ে। একজন পরিশ্রমী মানুষ নিবিষ্ট মনে গাছের টুকরো নিয়ে কাজ করছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ গাছ দিয়ে কী হবে?’
‘ক্রুশ’
‘কেন?
‘এখানে একজন ঈশ্বরপুত্রকে ঝুলানো হবে।’
‘ঈশ্বরপুত্র?’
‘হ্যাঁ। তাঁর পূর্ব পুরুষ আমাদের সাথে নৌকা থেকে নেমে এসেছেন।’
কী আশ্চর্য! ঈশ্বরপুত্র হত হবেন, আর তাঁর পূর্ব পুরুষ নোহের নৌকা  থেকে  সদ্য অবতরণ করেছেন! কী ভাবে কী হবে, আমার মাথায় কিছুই আসছেনা।
আমি এগিয়ে গেলাম। বিনম্র সম্বিতের সাথে আমি সব কিছু অবলোকন করি। আমার উপলব্ধির একাগ্রতায় সঞ্চয় করে রাখি ভবিষ্যতের জন্য। আমি এগিয়ে যাই।

সামনে তাঁত কলের শব্দ। আগ্রহ নিয়ে আমি একটি চালার ভিতরে প্রবেশ করি।
‘আচ্ছা। এখানে কী হচ্ছে?’
‘পরিচ্ছদ বোনা হচ্ছে।’
‘পরিচ্ছদ! আশ্চর্য ধরণের এ এক পরিচ্ছদ তো। এটি কে  পরিধান করবে?’
‘একজন মনুষ্যপুত্র’
‘মনুষ্যপুত্র?’
‘হ্যাঁ। তাঁর পূর্ব পুরুষ আমাদের সাথে নৌকা থেকে নেমে এসেছেন।’
আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার সীমিত জ্ঞানে তার সরল যোগ – বিয়োগ করা সম্ভব নয়।
একজন মনুষ্যপুত্র এই আশ্চর্য পোশাক পরিধান করবেন!
কোন দিকে না তাকিয়ে আমি বের হয়ে এগিয়ে যাই। আমি আমার দু’পায়ে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে  হাঁটতে থাকি।

সামনেই এক পাহাড়ের গুহার মতন। এখানে অনেক গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ। অনেক রাখাল বালকেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আগ্রহ নিয়ে গুহার ভিতর ঢুকে পড়ি।
আমি দেখলাম কয়েকজন রাখাল বালক মিলে ত্রস্ত হস্তে  একটি জাবপাত্র নির্মাণ করছে। তারা নিমগ্ন হয়েই কাজটি করছে।
আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘তোমরা এ কাজটি করছো দেখে আমার একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে।’
‘করুন।’
তাদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে বললো।
‘আমি তো দেখছি এখানে অনেক গুলো জাবপাত্র রয়েছে। তা সত্বেও তোমরা আর একটি কেন নূতন ক’রে নির্মাণ করছো?’
‘আমাদের এখানে স্বর্গের রাজা জন্ম নিবেন। তাঁকে এখানে শয়ন করানো হবে।’
‘স্বর্গের রাজা! এই জাবপাত্রে শোবেন!’
‘হ্যাঁ। তাঁর জন্মের সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।’
তাঁর মা-বাবা কোথায়?’
‘হ্যাঁ। তাঁর পূর্ব পুরুষ আমাদের সাথে নৌকা থেকে নেমে এসেছেন।’
অপার বিস্ময়ে আমি তাদের নিপুণ কাজ অবলোকন করি।

গুহা থেকে বেরিয়ে আমি আবার হাঁটতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পেলাম ঊর্ধ্বাকাশ থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীতের মূর্ছনা, ‘জয় পরমেশ্বরের, ঊর্দ্ধলোকে জয়... ... ...।’
আমি পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি চূড়ান্ত বিশ্ব ব্যাপি অন্ধকারের মধ্যে সেই পাহাড়ের গুহার উপর এক উজ্জ্বল তারকা। দিগন্ত বিস্তৃত রাতের আঁধারে রাখাল বালকদের মশাল জ্বলে উঠেছে। তারা উৎফুল্ল হয়ে নাচছে আর সুর তুলে গাইছে, ‘খ্রীষ্ট এলেন পৃথিবীতে ছেড়ে স্বর্গের সিংহাসন...।’
পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, সমস্ত জগত অলৌকিক আনন্দে যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি।