আমার বাবাকে সেদিন আমি দেখেছিলাম
মহামতি নোহের সেই অভিজ্ঞানের
নৌকার এক যাত্রীর মতো,
যিনি দীর্ঘ একটি ঝড়ের পথ পাড়ি দিয়ে
কোনমতে প্রাণ নিয়ে ঘাটে ফিরে এসেছেন।
আশুগঞ্জ থেকে আড়িখোলা তখন ছিলো
এক লম্বা দুর্গম রণাঙ্গন।
যুদ্ধবিক্ষুব্ধ দুর্মর প্রতিবেশে পরিচিত পথে
সেদিন তাঁর কাছে অনিশ্চিতের মতোই
মনে হয়েছে। তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন
ভৈরব হবে কখনও রিকশায়,
কখনও পায়ে হেঁটে।
মনোহরদি, পাঁচদোনা, পলাশ ...
তাঁর সাথে আর কারা ছিলেন সেদিন?
একসময় সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে
বাবার যাত্রাপথে রণাঙ্গনের সীমান্ত।
তো মুক্তিযোদ্ধারা ওৎ পেতে বসে আছে,
সন্দেহভাজন অপরিচিত কাউকে পেলেই
ঘিরে ফেলে তারা। কোথাও কোথাও আবার
আলবদর রাজাকারদের গুপ্ত তৎপরতা।
আসলে কী হচ্ছে, বুঝে ওঠার কোনো উপায় নেই।
একদল অস্ত্রধারী লোক আমার বাবাকে সেদিন
রিকশা থেকে নামিয়ে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে
যায় জঙ্গলের কাছাকাছি একটি বাড়িতে।
সেখানে তাঁকে নানাভাবে জেরা করা হলো,
তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা? নাকি রাজাকার?
তাঁকে সামান্য খাবার অথবা ঘুমানোর
এতোটুকু সুযোগ কিছুই দেয়া হলো না!
বাবা বুঝতে পারলেন না আসলে এরা কারা!
মুক্তিযোদ্ধা? নাকি রাজাকার?
তাঁকে সেদিন একস্থান থেকে রাতের অন্ধকারে
অন্যস্থানে পিঠমোড়া দিয়ে কখনও ঠেলে
আবার কখনও টেনে নেয়া হলো।
আবার সেই দরবার! সালিশি। বিচারের নামে
প্রহসন! ওদের কেহ কেহ বললো, 'না সে রাজাকার।
তা না হলে, এখানে আসবে কেন?'
কেউ বললো, 'মেরে কী লাভ?'
এভাবে দু’দিন আঁটকে রেখে নানাভাবে
তাঁকে হেনস্থা করা হলো। তারপর এক সময়
আরও অপরিচিত স্থানে নিয়ে তাঁকে
‘যান। চ’লে যান বাড়িতে ...’ বলে
ছেড়ে দেয়া হলো। তখন রাত্রি শেষে
ভোর হতে শুরু করছে।
ভগ্ন অবসন্ন দেহমন নিয়ে বাবা
আবার যাত্রা শুরু করলেন।
তখন মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়।
সমগ্র দেশ জ্বলছে গোলার মুখে।
মানুষের আহাজারি, নারীদের শিশুদের চিৎকার।
সর্বত্রই লাশ। দুর্গন্ধে ছেয়ে আছে বাতাস।
ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে মানুষ বাস্তুভিটা
সব পিছনে ফেলে ...।
আর আমাদের বাড়িতে তখন শোকের ছায়া!
বাবার কোনো সংবাদ জানা নেই আমাদের
কোথায়, কেমন আছেন আমাদের প্রিয় বাবা!
তাঁর নিরাপদ আগমন প্রতীক্ষায় আমাদের পরিবারের
প্রতি সন্ধ্যায় পারিবারিক প্রার্থনায়
আমাদের বাবার জন্যে ঈশ্বরের কাছে
সে কী করুণ আর্তি!
অবশেষে কোনমতে বাবা আড়িখোলাতে এসে
হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
চড়াই উতরাই পথে যীশুর মতো কষ্টের কালভেরিতে
যন্ত্রণার ক্রুশ বয়ে বয়ে ক্লান্ত অবসন্ন
কপর্দকশূন্য বাবা আমাদের
বাড়ির উঠানে এসে পা রেখেই ঢক্ ঢক্ ক’রে
কয়েক গেলাশ কুয়োর ঠান্ডা ঠান্ডা পানি গিলেছেন।
আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে তিনি
ইচ্ছেমতো চোখের জল ফেলেছেন!
তাঁর ফিরে আসার বয়ান তিনি
শুনিয়েছেন আমাদের সবাইকে।
মনে পড়ে, প্রাণ ভ’রে আমরা সেদিন
যীশুকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম।
আমি তাঁর একমাত্র পুত্রধন,
বাবাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম;
'তাহলে বাবা তুমি কি মুক্তিযোদ্ধা?
নাকি আলবদর? রাজাকার?'
আমাকে তাঁর বুকে টেনে বাবা মলিন হেসে,
বলেছিলেন, ‘এখন আমি শুধু নই একা
আমাদের পরিবারের আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।’