এক....
রফিক মিয়ার ব‌উটা হঠাৎ পালিয়ে গেছে!পুরো গ্রাম জুড়ে মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়েছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে।আশপাশের সব মিষ্টির দোকান খালি।এই সুযোগে মিষ্টি ব্যবসায়ীরা হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠেছে আরও। অনেক মিষ্টি দোকানি তো বলতেই শুরুই করে দিয়েছে যে- ইস!আরও কয়েকজনের ব‌উ যদি পালাত এভাবে..... কিন্তু ঘটনাটা কী!ব‌উ পালালো রফিক মিয়ার আর মিষ্টি বিলাচ্ছে গ্রামবাসী?আসলে পুরো গ্রামের মানুষ‌ই দীর্ঘদিনের হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।সারা গ্রাম জুড়ে ব‌ইতে শুরু করেছে এখন শান্তির সুবাতাস।আসলে রফিক মিয়ার ব‌উটা নারী ছিল না।সে ছিল একটা পেতনি- ডাইনি। এতদিন এই পেতনি-ডাইনির সঙ্গেই সংসার করেছে রফিক মিয়া!

দুই.....
মা মরলে- খালা,চাচী,ফুফুরা এসে সান্ত্বনা দেয়।কেঁদো না বাবা।আমরাতো আছি।আমরা তোমার মায়ের মতোই। কিন্তু ব‌উ মরলে?কোনো ললনা এসে সে সান্ত্বনার বাণী শুধিয়েছে আজো? সেকেন্ড বিবাব মোবারকের ক্ষেত্রে উপরন্তু নানা জটিল হিসেব নিকেশ শুরু করে দেয়।তবে ব‌উ মরলে শুধু স্বামী নয় পুরো পরিবার এমনকি গ্রামবাসীর বুকেও শোকের আঁচ লাগে। কিন্তু ঘরের লক্ষ্মী যদি পালিয়ে যায় তাতে সবাই হাসি-তামশাতেই মেতে উঠে।আজ পর্যন্ত কাউকেই বলতে শুনিনি-হারামজাদি পালিয়ে যাবার আগে তালাকনামাটাও দিয়ে গেল না!এক্ষেত্রে অটো তালাক কার্যকর হয় কি না এবং প্রচলিত আইন কী বলে তা গ্রামের প্রখ্যাত উকিল বাবু আবু কালাম‌ সাহেব ভালো বলতে পারবেন।আইনের ধারা উপধারা সম্পর্কে গ্রামের সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই যে নেই।

তিন......
সোনার গ্রাম হলেও সোনার সংসার ছিল না রফিক মিয়ার।লোক-মুখে শোনা যায় তিনি একসময় জ্বিন-ভূত ছাড়ানোর কবিরাজি করতেন।কোনো রকমে সংসার চলত।সেই সুবাদেই এই পেতনি ব‌উয়ের সাথে পরিচয়।রফিক মিয়া জেনেশুনেই শুধুমাত্র নিজের ভাগ্য বদলানোর জন্য‌ই নাকি এই পেতনিটাকে বিয়ে করেছিলেন।এটা গ্রামবাসীর অভিযোগ।অবশ্য এই ব‌উয়ের কল্যাণেই নিজের চৌদ্দ গুষ্টির-ই ভাগ্য বদলিয়ে নিয়েছেন রফিক মিয়া।পুরো গ্রামের উপরেই তাই প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। অতঃপর তিনি গ্রামের মোড়ল‌ও হয়েছেন। এখন তিনি রফিক মোড়ল! বহাল তবিয়তেই আছেন সে পদে।তবে নামেই মাত্র মোড়ল।সর্বময় ক্ষমতা ছিল তার সেই পেতনি ব‌উয়ের হাতেই। শুধু তার কাজ ছিল- গ্রামের কেউ মারা গেলে জানাযায় অংশ গ্রহণ করা,কবর জিয়ারত করা আর মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করা।আস্তে আস্তে একসময় সমগ্র গ্রামবাসীর উপরে নেমে আসতে লাগল অত্যাচারের স্টিম রোলার! প্রতিদিন‌ই গ্রামের কোথাও না কোথাও পড়ে থাকতে দেখা যেত বিকৃত লাশ! আবার গুম কিংবা নিখোঁজ এর সংবাদ‌ও শোনা যেত রোজ।এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে গাঁয়ের এক সাংবাদিক দম্পতি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল।কিন্তু তার পরদিনই তাদের জোড়া লাশ পাওয়া গিয়েছিল বিলের ধারে।তাই প্রাণের ভয়ে আর কোনো সাংবাদিক পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করার তেমন একটা সাহস করে উঠতে পারেনি।সাহসী সাংবাদিকদের এক প্রকার বাধ্য হয়েই শহরে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল।
বাকিরা তেলের কারিশমা দেখাতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে!এই গ্রামে প্রচুর গুপ্তধন ছিল।এটা গ্রামের সব লোকেই জানত।
পাশের গ্রামেই ছিল রফিক মোড়লের সাবেক পেতনি বধুর ঘাটি।প্রেতস্থান।ওটাই তার বাপ-দাদার দেশ।তার যাবতীয় শক্তির উৎস‌ই ছিল ঐ প্রেতস্থান।প্রেতস্থান থেকেই যাবতীয় কার্যকলাপের নির্দেশনা আসত।গ্রামের সমস্ত গুপ্তধন খুঁজে খুঁজে বের করে পাশের গ্রাম প্রেতস্থানে পাচার করতো। কেউই মুখ খোলার সাহস পায়নি। এমনকি রফিক মোড়ল পর্যন্ত‌ও না।

চার......
একটা সময় অতিমাত্রায় লুটপাটের মহাসমারোহ শুরু হয়ে গেল।গ্রামের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ‌ও যোগ দিয়েছিল রফিক মোড়লের পেতনি ব‌উয়ের সাথে। কারণ তারাও লুটপাটের বিরাট একটা অংশ পেত।পাশের গ্রাম থেকেও অসংখ্য প্রেতাত্মারা এসে যোগ দিত সে হরিলুটের মহা উৎসবে।ফলে ভয়াবহ রকমের অভাব নেমে এল গ্রামে।কেবল রফিক মোড়লের পরিবারেই পড়ল না এর আঁচ।নিজেরা রাজা বাদশাহের মতো উদর পূর্তি করলেও রফিক মোড়ল ও তার পেতনি- ডাইনি বধু গ্রামবাসীকে পেঁয়াজ রসুন ছাড়াই মাংসের বদলে কাঁঠালের তরকারি রান্নার রেসিপি দিয়ে আমিষের অভাব পূরণ করতে উপদেশ দিতেন!বেগুনের দাম বাড়ায় বেগুনের বদলে মিষ্টি কুমড়ার চপ,কাঁচা মরিচের বদলে শুকনা মরিচ,ইফতারিতে খেজুরের যায়গায় বড়ই,আপেলের বিকল্প পেয়ারার চমৎকার সব রেসিপি শিখিয়ে দিতেন!হতভাগা গ্রামের সাদাসিধে মানুষ হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠে পারত না!

পাঁচ......
পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়,তখন বাধ্য হয়েই মানুষ বিপ্লবী হয়ে উঠে।এ গ্রামের লোকজন‌ও বিপ্লবকেই বেছে নিয়েছিল মুক্তির জন্য। এক্ষেত্রেও গাঁয়ের তরুণ যুবারাই প্রথম উদ্যেগ গ্রহণ করেছিল। গ্রামের মুষ্টিমেয় সুবিধাবাধী লোকজন ছাড়া আস্তে আস্তে তাতে সকল বর্ণ-ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। হাঁস -মুরগি,গরু,ছাগল‌ও অংশ নেয় সে বিপ্লবে।গাঁয়ের অনেক হাঁস -মুরগি,যুবা-বৃদ্ধা হতাহত হয় মোড়ল-পেতনি ব‌উ কর্তৃক গঠিত সুবিশাল লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা।তারপরও গ্রামবাসী দমেনি।একটা সময় জমায়েত গ্রামবাসী রফিক মোড়লের বাড়ি ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী যে যার মতো আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গেল।রফিক মোড়লের পেতনি ব‌উ প্রাণভয়ে মানুষের সুরত পরিবর্তন করে ছোট্ট ইঁদুরের রূপ ধারণ করে পাখির পিঠে সওয়ার হয়।পাখি মহা ক্ষমতাধর পেতনিকে নিয়ে উড়াল দিলো প্রেতস্থান।

ছয়......
রফিক মোড়ল স্ব-পদে বহাল তবিয়তে থাকলেও গ্রামবাসী একজন জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিরাজকে শহর থেকে ডেকে নিয়ে এসে গ্রাম পরিচালনার গুরু দায়িত্ব দিলো।তার সহকারী পদে বসাল কিছু বিপ্লবী মুরগিকে।যারা এতকাল বলে এসেছিল -ইস আল্লাহ পাক যদি মানুষের সাথে একবার গ্রাম পরিচালনার কাজে নিযুক্ত করত,তবে গ্রামবাসীকে খুশি রাখার জন্য জীবন দিয়ে রাতদিন প্রচুর ডিম পারতাম। তারা প্রচুর ডিম পারা তো দূরে থাক উল্টো আরো ডিম খেতে শুরু করেছে এখন!গ্রামবাসী এবার তিক্ত বিরক্ত এসব সহকারী মুরগিদের প্রতি।আসলে সময়ের সাথে সাথে কিভাবে সবাই ভোল পাল্টায় ভাবা যায়!পেতনি-ডাইনি বিদায় নিয়েছে সত্য কিন্তু গ্রামে এখনও মুক্তি আসেনি। মুক্তি আসার কোনো লক্ষণ‌ও দেখা যাচ্ছে না।যাদেরকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গ্রাম পরিচালনার,তারা শুধু বড় ডায়ালগ এক্সপোর্টেই পটু। শান্তি ইমপোর্টের প্রসঙ্গেই-জবান বন্ধ।উনারাও মেতে উঠেছেন-প্রতিহিংসার খেলায়।গ্রামের মানুষ স্বস্তিতে না থাকলেও উনারা কিন্তু প্রচন্ড রাজকীয় হালেই আছেন।

সাত.......
সবকিছুই মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। ঘাপটি মেরে বসে ছিল রফিক মোড়ল।কিন্তু বিপত্তিটা ঘটলো -গ্রামবাসীরা যখন রফিক মোড়লকে দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব দেয় ঠিক তক্ষুনি!হঠাৎ রফিক মোড়লের মাথায় প্রেতাত্মারা ভর করে। রফিক মোড়ল উল্টাপাল্টা প্রলাপ বকতে শুরু করে দিয়েছেন!আসলে যার বদৌলতে রফিক কবিরাজ আজ গাঁয়ের রফিক মোড়ল,এত সহজেই কি তাকে ভোলা যায়? রফিক মোড়ল বলতে শুরু করেছেন-তিনি দ্বিতীয় আর কাউকেই বধু হিসেবে মেনে নিতে পারবেন না।তার সেই পেতনি ব‌উ পালিয়ে যাবার সময় নাকি তালাকনামায় স্বাক্ষর করে জমা দিয়ে যায়নি।তার সেই প্রিয়তমা পেতনি ব‌উ-ই এখনও মোড়ল বধু হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন! সুযোগ বুঝে তিনি তার সাবেক বধুয়াকেই আবার ফিরে আনবেন নিজ বাড়িতে।আস্তে আস্তে খবরটা রাষ্ট্র হতে থাকে পুরো গ্রামে।খবরটা শুনেই গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে উঠল।এক‌ই মুখে দুই রকম কথা! কারণ এর আগে তিনি বলেছিলেন -তার পেতনি বধু পালিয়ে যাবার আগে তালাকনামা দাখিল করে গেছেন।পুরো গ্রামের সাথেই সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে গেছেন।আর এখন কি-না বলেছেন -তার কাছে কোনো তালাক নামার কোনো কপি-ই নাকি নেই!তিনি এখন মোড়ল পদে বহাল তবিয়তে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। এরপর গ্রামবাসী উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করেছে-তোর তালামনামা থাক বা না থাক এতে গ্রামবাসীর কোনোই যায় আসে না।তোকেও পদচ্যূত করে তোর পেতনি ব‌উয়ের কাছে প্রেতস্থান পাঠিয়ে দেবো।ভয় ভেঙে গেছে গ্রামবাসীর।এই গ্রামে আর কোনো জ্বিন-ভূত কিংবা কোনো প্রেতাত্মাকেই আর ঢুকতে দেবে না। এ ব্যাপারে গ্রামবাসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গ্রামবাসী খুব‌ই সচেতন যে-প্রেতস্থান থেকে মোড়ল-পেতনি ও তার দোসররা আরো ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে তৎপর থাকবে।তাই গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই ভূত ছাড়ানো মন্ত্র আয়ত্ত করে ফেলেছে। গ্রামের জোয়ান-বুড়ো সবাই আজ একেকজন কবিরাজ।