অতি সাম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী এক মহাকাব্যিক ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে বাংলাদেশে। নতুন এক স্বদেশ পেয়েছি আমরা।সবাই আজ মুক্ত স্বাধীন।মানুষ আজ প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। কথা বলছে মন খুলে।বিজয়ের আনন্দ বাংলার জমিন থেকে মেঘের মতো করে ভেসে বেড়াচ্ছে দিগন্তে। দু'চোখে আজ অনেক স্বপ্ন।অনেক প্রত্যাশা।অনেক আশা -আকাঙ্খা।আমরা বৈষম্যহীন এমন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবো- যেখানে না থাকবে কোনো জাত-ধর্ম,ধনী-গরির,সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু,উঁচু -নিচুর ব্যবধান। যেখানে হবে সব মানুষ সমান। যেখানে সুরক্ষিত থাকবে মানুষের মৌলিক অধিকার।যেখানে থাকবে না কোনো ভিআইপি, ভিভিআইপি কোটা। যেখানে আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।যেখানে মন্ত্রী -এমপিদের যাতায়াতের সময় মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর অ্যাম্বুলেন্স কিংবা প্রসব যন্ত্রণায় কাতর কোনো মায়ের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের রাস্তা পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে না পুলিশ সদস্যরা।
যেখানে রাস্তা ঘাট ,হাট-বাজার এমনকি দেশের সকল অঞ্চল হবে চাঁদাবাজিমুক্ত। যেখানে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক হানাহানি, প্রতিশোধ পরায়ণ প্রবৃত্তি।যেখানে আইনের শাসন হবে সুপ্রতিষ্ঠিত। যেখানে কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমেই জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই নির্বাচিত হবে জনপ্রতিনিধি।যে সমাজ,রাষ্ট্র বিনির্মাণে একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন জাতির বীর সন্তানেরা। অনেক রক্ত ঝরায়ে, অনেক ত্যাগে, অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে উক্ত স্বাধীনতাই চেয়েছিলেন তারা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে -স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সময় পরে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম মহানায়কের পরিবার থেকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তার স্বৈরাচারী মনোভাব এবং তার চারপাশের স্তাবকদের কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি এদেশের জনগণ। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হতো -স্বাধীনতা যেন তাদের জন্যই এসেছিল। স্বাধীনতার স্বাদ কেবল তারাই করে যাচ্ছে উপভোগ।হয়তো তারা ভুলেই গিয়েছিল যে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।দেশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল তাদের প্রতি। মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে জমতে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো হয়ে উঠেছিল।যার ফলশ্রুতিতে এক মহাকাব্যিক ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এসেছে স্বাধীন দেশের দ্বিতীয় মহা বিজয়।এরই মধ্য দিয়ে হয়তোবা চিরদিনের জন্য কিংবা সুদীর্ঘকালের জন্য ডুবে গেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর নৌকা।
যাহোক ভেবেছিলাম -তাদের এ পরিণতি দেখে বাকি রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা লাভ করে জনগণের হৃদয়ে আসীন হয়েই আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে সে আশা আকাঙ্ক্ষা কিংবা পরিবেশ পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।আজ যেখানে স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশে ছাত্র সমাজ- দেশ পূণর্গঠনে গায়ের ঘাম ঝরাচ্ছে রাত-দিন এক করে। যেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বিবেচনায় তরুণ প্রজন্ম গ্রামে-গঞ্জে,শহরে -নগরে দলগতভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ধর্মীয় উপাসনালয় পাহাড়া দিচ্ছে, ক্লিনার, সুইপার হয়ে রাস্তাঘাট পাড়া মহল্লার অলি গলি পরিস্কারে ব্যস্ত সময় পার করেছে,আজ যেখানে ছাত্র সমাজ রাস্তায় ট্রাফিক সামলাচ্ছে, সেখানে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র এক-দু'দিন পরেই বড় বড় রাজনৈতিক দল জনদূর্ভোগের কথা উপেক্ষা করে সভা সমাবেশ নিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে!মহা ধুমধামে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য মাঠে নেমে পড়েছে!এখনি তারা ক্ষমতার সিংহাসনে বসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে!কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবে এসব নিয়েই তারা জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যেই!তাদের যেন আর তাড়া সইছেই না!কবে রাজ ক্ষমতায় আসবেন,কবে থেকে আখের গোছাতে শুরু করবেন!আসলে যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার মসনদ চ্যূত তারা!দেশের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, প্রসাশন, দুর্নীতি দমন কমিশন,নির্বাচন কমিশন এসবের সংস্কারের কথা ভুলেই গিয়েছেন তারা বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ আবেগে!
এমনকি খুবই লজ্জাজনক হলেও সত্য যে-অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগেই তারা তাদেরকে সময় বেঁধে দিচ্ছে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়ার জন্য! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে -দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যেন তাদেরই আন্দোলনের ফসল!তাদের সুমহান দক্ষ নেতৃত্বেই যেন নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।সত্যি কথা বলতে কী আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দুধের মাছির মতোই।জাল দেয়া দুধের সর খেতে পারে। তৈরি করে নয়,তারা কেবল তৈরি করা খাবারই গোগ্রাস করতে জানে!এ দেশের সাধারণ জনগণ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিবেন যে -দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
আমি অবাক হয়ে যাই এদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের প্রজ্ঞাহীনতা ও অদূরদর্শিতা দেখে!আসলে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এদেশে এখন আর একজনও হয়তো অবশিষ্ট নেই! কেউই দেশ ও দেশের জনগণের ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না।সকলেই ভাবেন নিজের পরিবারের কথা।দেশকে ভালো রাখার কথা ভাবেন না কেউই।সকলেই ভাবেন নিজের পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখার কথা।তবে আশার কথা হলো এই যে, বৈষম্য বিরোধী সফল আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ মেধা মননে, চিন্তা চেতনায় কিংবা রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় অনেক বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান।যা ইতোমধ্যেই একটি সফল আন্দোলনের নিখুঁত কর্ম পরিকল্পনায় এদেশই শুধু নয় বহির্বিশ্বের আয়নাতেও স্পষ্ট ধরা পড়েছে।তারা এত সহজেই তাদের সহপাঠী কিংবা ভাই হারানোর শোক ভুলে যাবেন না।যেতে পারেন না।তাদের পড়ুয়া বন্ধুদের রক্তের উপর সাঁতার কেটে যে মহাকাব্যিক বিজয় এসেছে,তার সুফল অন্য কেউ চেটেপুটে খাবে,তা কখনোই তারা হতে দেবেন না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সকল অবকাঠামোর পুরোপুরি সংস্কার না করে তারা যেনতেনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে আগের দেদো রাজনৈতিক দলের হাতে নতুন স্বদেশটাকে সঁপে দিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় প্রার্থনা করে কান্নাকাটি করার মতো এতোটা আহমক তারা কখনোই যে নন এটুকু অন্তত আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। তবুও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বিবেচনায় কিংবা যেই রাজনৈতিক দল এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন,তাদের সামনে আতংক ফাটাকেষ্ট হয়ে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মের এ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে। তবেই হয়তো ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মানুষ মহান একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হবে।