নদীর ধারে শেষ বিকেলের আলো ঝিমিয়ে আসছিল। বাতাসে শিউলী ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল, আর সেই গন্ধে মোহিত হয়ে শিউলী চুপচাপ বসে ছিল। পাশের খাল থেকে নৌকার কাঁকনির মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। শিউলী আজ অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভুগছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার আশপাশে আছে, তাকে চুপিচুপি দেখছে।
ঠিক তখনই হালিম ধীরে ধীরে এসে পাশে দাঁড়াল। সে বেশ নার্ভাস ছিল, কারণ আজ তার মনে হয়েছিল, অনেক দিন ধরে জমিয়ে রাখা কথা বলার সময় এসেছে। সে বুঝতে পারছিল, শিউলীর কাছে কিছু বলতে না পারলে আর তার শান্তি থাকবে না।
শিউলী প্রথমে হালিমকে দেখে একটু চমকে উঠল। হালিমের মুখে এক অদ্ভুত সিরিয়াস ভাব ছিল, যা শিউলী আগে কখনো দেখেনি। সে একটু হাসল আর বলল, "তুমি এখানে কী করছ?"
হালিম একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, "তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।"
শিউলী কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। তার চোখে কৌতূহল জাগল। সে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, "আমার সাথে? কী কথা বলবে?"
হালিম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, যেন মনের ভেতর নিজেকে প্রস্তুত করছে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "অনেক দিন ধরে একটা কথা বলার সাহস জোগাড় করছিলাম। আজ ঠিক করলাম, বলেই ফেলব।"
শিউলীর চোখে একধরনের অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল। সে আরও কাছে সরে এসে বলল, "কী কথা?"
হালিমের হৃদপিণ্ড দ্রুত বেঁধে চলছিল। সে গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, "আমি অনেক দিন ধরে তোমাকে ভালোবাসি, শিউলী। কিন্তু কখনো বলতে সাহস পাইনি।"
শিউলী কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল হালিমের দিকে। তার চেহারায় মৃদু হাসির আভা দেখা গেল, কিন্তু তার চোখগুলো গভীর ও চিন্তামগ্ন হয়ে উঠল। তারপর সে বলল, "তুমি কি জানো, আমি প্রথম দিন থেকেই তোমাকে খেয়াল করেছি? তোমার চোখে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছিল, যা আমাকে বারবার তোমার দিকে টানছিল।"
হালিম অবাক হয়ে বলল, "তাহলে তুমি…?"
শিউলী একটু লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসল, "হয়তো আমিও তোমার মতোই ভেবেছি, কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি, কীভাবে বলব।"
হালিম তখন পুরোপুরি নির্বাক। সে ভেবেছিল, এই দিনটি হয়তো আসবে না। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, সব কিছুই যেন নতুন করে বদলে যাচ্ছে। সে আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু কথাগুলো যেন গলায় আটকে গেল।
শিউলী একটু কাছে এসে তার দিকে তাকাল। "তাহলে, এখন আমরা কী করব?" সে মৃদু হাসল।
হালিমের বুকটা ধকধক করে উঠল। সে হালকা গলায় বলল, "আমরা কি… বন্ধু থেকে আরও কিছু হতে পারি?"
শিউলী মিষ্টি হাসল। তার চোখে একধরনের প্রশান্তি ফুটে উঠল। "সময়ের সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, হালিম। আমরা এখন শুধু একসাথে থাকি। বাকি সব সময় বলে দেবে।"
হালিমের মনে যেন বিশাল এক ভার নেমে গেল। সে এতদিন ধরে যে অনুভূতিটা বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল, আজ তা মুক্ত হলো। শিউলীর পাশে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, জীবন যেন এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করছে।
নদীর দিকে তাকিয়ে দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। দূর থেকে সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছিল, আর আকাশটা লালচে হয়ে উঠছিল। বাতাসে শিউলী ফুলের গন্ধ আরও বেশি ঘন হয়ে উঠেছিল।
"শিউলী," হালিম হঠাৎ বলল, "তুমি কি জানো, তোমার সাথে এই মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় হয়ে থাকবে?"
শিউলী মৃদু হেসে বলল, "হয়তো আমারও।"
এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। দুজনেরই মনে হল, তারা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, কিভাবে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠবে। নদীর ধারে এই প্রথম দেখা এবং প্রথম কথোপকথন তাদের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।