টিয়া / ময়না / বুলবুলি
চারণকবি বৈদ্যনাথ
.......................................................
নদীর বাঁকে তুমি যদি কখনো গিয়ে থাকো
তাহলে দেখবে
কাত হয়ে পড়ে থাকা রহমান মাঝির ভাঙা নৌকাটার ওপর
একটা শাঁখচিল
ডানা নাড়া দিয়ে সাগরে যাবার স্বপ্ন দেখছে

বিষ্টুপুর ইস্টিশনের গা ঘেঁযে বন কেটে বসত
সেখানে যদি তুমি কখনে গিয়ে থাকো
তাহলে দেখবে
মাটির দেওয়াল খড়ের ছাউনির ঘরের দাওয়ায়
হুঁকো হাতে বসে আছে ব্রজ দত্ত
কষ্ঠিতে বাঁধা তুলসীর মালা.... তামাকের গন্ধ
রামায়ণ পড়ছে সিধু বোষ্টম
ওখানেই যেন এক হাঁটু সমুদ্র

কাঠের ঝরকার উপর ভাঙা আয়নাকে সামনে রেখে
চুল বাঁধছে টিয়া
চুলের খোঁপায় ক্লিপ আঁটছে নিপুণ হাতে
উডু উড়ু মন...........অরক্ষণীয়া
পিয়ারডোবা স্টেশনের পানিপাড়ে রাম সিং
নাকের নিচে বাঘের মতো গোঁফজোড়া
গায়ে রেল কোম্পানির কোর্ট- মাথায় বাঁধা

                       কালো রঙের পাগড়ি
তারই ছেলে ছেন্টু
ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গলায় কালো কারের পদক
সে এক্ষুনি লোকাল ট্রেনটায় নামবে
হারমোনেম বাঁশিটাই বাইস্কোপের সুর বাজাতে বাজাতে
এগিয়ে আসবে
তারই জন্যে অপেক্ষা করছে টিয়া
ছ-টার ট্রিপে ছবি দেখতে যাবে কিনা
খুশির সমুদ্রে হাবুড়ুবু খাচ্ছে
আর মেজ বোন ময়না
ড্যাবকা ড্যাবকা কাজল-পরা-চোখ
পরনে তার কলাপাতা রংয়ের জল ঢেউ টেউ শাড়ি
কপালে পরেছে কাচপোকার টিপ
সে যাবে ওই তুড়কীর মেলায়
নাগর দোলায় চড়বে, বন বন্ করে দুনিয়া ঘুরবে
তারপর যখন সে ঘরের দিকে পা বাড়াবে
কাল্টু দাদা তখন তাকে কিনে দেবে
কাচের চুড়ি, চুলবাঁধার ফিতে এবং একটা রোলগোল্ডের আংটি
তাহলেই তার নাগালের কাছে সমুদ্র
কিন্তু ছোটো বোন বুলবুলি- বয়স তার কতই বা
এখনো সে ফ্রক পরে, পুতুল পুতুল খেলা খেলে
পাকামি করলে দিদিরা ওর কান মুলে দেয়
বল্টুর ঘুড়ির সুতো ধরে হালকা হাওয়ায়
কোথায় যেন সে উড়ে যেতে চায়
বয়সে সে দিদিদের চাইতে বড্ড বেশি ছোটো কিনা
কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মন ভরে না
তাই সে সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখবে, কনে বউ সাজবে
গায়ে জড়াবে ফুল ফুল নকশা করা বেনারসী শাড়ি
কপালে আঁকবে কনে চন্দন, গলায় পরবে
জুঁই ফুলের মালা
তারপর ..... কখন যেন নদীর ওপারের ওই কী যেন এক গাঁ থেকে
হাতির শুঁড় আর প্রজাপতির ডানা আঁকা পালকি আসবে
তারপর একদিন
হাঁড়ি, কলসি, পানের ডাবর, জলের কুঁজো এবং
একটা নকশা করা কাঁথা
এবং একটু ঘরকন্না
তারপর সে মনের মানুষের শরীরের সঙ্গে হৃদয়ের সঙ্গে
  মিশে গিয়ে
পূর্ণতা লাভ করবে
তবেই তো তার সারা অঙ্গে উপচে পড়বে সমুদ্র।

নদীর বাঁকে তুমি যদি কখনো গিয়ে থাকো
তাহলে দেখবে
কাত হয়ে পড়ে থাকা রহমান মাঝির ভাঙা নৌকাটার উপর
বসে থাকা শাঁখচিলটা
সমুদ্রের দিকে ডানা মেলেছে
বিষ্টপুর ইস্টিশনের গা ঘেঁষে বন কেটে বসত
সেখানে যদি তুমি কখনো গিয়ে থাকো
তাহলে দেখবে
স্বপ্নের অন্ধকারে মুখ থুবড়ে কারা যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে
আর রামায়ণ পড়ছে সিধু বোষ্টম তেমনি
ব্রজ দত্তের কল্কের মুখে আগুনের টুকরো ধিকি ধিকি পুড়ছে

ওটাই আমাদের পৃথিবী
যার তিনভাগ জল একভাগ স্থল ৷।