"বাঁকুড়ার কবিতা"
✍চারণকবি বৈদ্যনাথ
............................................................
জনম দুখিনী চির ভিখারিনি বাঁকুড়া জননী জানি মা তুমি।
শাল মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা – পোড়ামাটি রাঙা তোমার ভূমি।
তীরে ভাঙা তরী গন্ধেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী।
লাজে নত মুখ তোমার চিবুক, অবগুণ্ঠিতা, ভক্তিমতী
তোমার জেলার দিগদিগন্তে মাটির দেওয়ালে বাঁশের খুঁটি
মাচার উপরে ঝিঙে ফুল ফোটে, ঘরে বাড়ন্ত শস্যমুঠি ।
কোন কোন গৃহে অঘ্রাণে ধান, শ্রাবণ ভাদ্রে ভাবনা বাড়ে
অভাবে দুঃখে চির দারিদ্র্যে ডুগডুগি বাজে তোমার হাড়ে
তবুও তোমার উঠোনে উঠোনে পৌষের রাতে লক্ষ্মীপুজো
সাঁওতালি মেয়ে খোঁপা ভরে তুমি কুরচি কলকে তবুও গুঁজো
গোবরে নিকনো জ্যোৎস্না উঠোনে দ্রিম্ দ্ৰিম্ তবু মাদল বাজে-
আহা সোহাগিনী ওগো ভাদুমনি, ভাদু গানে তবু মনের মাঝে-
বেঁচে আছো জানি, তুমি অভিমানী, মকর সিনানে তুষুর মতো
বৈশাখে আছো পুণ্যি পুকুরে পুষ্প মালায় ছড়িয়ে ব্রত
বাগদি বাউরী তোমাকেই পুজে ধর্মরাজের হাতির শুঁড়ে
মনসা, বড়ম, শিবের গাজনে পালা পার্বণে হৃদয় জুড়ে--
জানি মাগো তুমি ছড়িয়ে রয়েছে, রয়েছে মা তব সংস্কৃতি
সরল জীবন অতি পুরাতন রসে ভরা মন প্রণয়প্রীতি।
স্মরণীয় তব বিষ্ণুপুর গাে তুমি কি জননী এমনি রবে
শৌর্য বীর্য ত্যাগের মন্ত্রে মাথা তুলে তুমি দাঁড়াবে কবে।
মল্লভূমের রাজধানী তুমি ক্ষাত্রবীরের জননী ছিলে।
ভ্রান্ত-বিলাসী-পতিরে বাধিয়া নিজ হাতে সতী মরণ নিলে।
হাম্বীর ছিল ক্ষাত্রবীর্য শক্তি পূজার ভক্ত ছিল
তরবারি ত্যজি ত্যাগের মন্ত্রে শ্রীনিবাস কাছে দীক্ষা নিল
মল্লরাজারা নিষ্কর জমি দান করে গেছে কত না জনে
প্রজাকল্যাণে কত না কীর্তি রেখে গেছে তারা সংগােপনে
সুর-সমুদ্র মন্থন করে অমৃত দিল তোমারই ছেলে
যদুভট্ট ও জ্ঞান গোস্বামী এ ভারতে আজ ক-জন মেলে
আরো কত ছেলে ছড়িয়ে গেছে মা সুর-সিম্ফনি সংস্কৃতি
পোড়া মাটি দিয়ে টেরাকোটা গড়ে রেখে গেছে কত শিল্পস্মৃতি
‘মল্লভূম’ আর ‘বালুচরি' শাড়ি অঙ্গে তোমার বাড়ায় শোভা
জননী তোমার ও রাঙা চরণে কত প্রতিভার রক্তজবা
জ্যোৎস্নাজরির ঝলমলি দিল রেশমশিল্পে তোমার ছেলে
শঙ্খ, পেতল, কাঁসার বাসনে কত দূরদেশে আদর পেলে
কোথা সে শিল্প ? তোমার শিল্পী পুত্রেরা মরে অর্ধাহারে
কিছু ধড়িবাজ মহাজন আর শিল্পের নামে পকেট মারে
কোথা সে তোমার অমিত বীর্য রণ-কৌশলী পুত্র আজি ?
সব কটা জন-প্রতিষ্ঠানেতে স্বার্থপরের আড্ডাবাজি।
কোথা সেই প্রেম কোথা সে বীর্য কোথা তপস্যা কোথা সে হৃদয়
কেন মা তোমার ছেলেরা এখন দাগি বদমাস অমানুষ হয়।
নষ্টামি আর ভ্ৰষ্টামি শুধু চ্যাংড়ামি আর কুটিলস্বভাব
জানি মাগো ওরা বিষ্ণুপুরের সন্তান নয়- গর্ভস্রাব
চিরকাল কি মা তোমার বক্ষে চলবে এমনি চোরের খেলা
সৎচরিত্র শিল্পীবীরেরা ভাসাবে কবে মা প্রেমের ভেলা
খেটে-খাওয়া-লােক গরিব দুঃখী মাথা তুলে বলো দাঁড়াবে কবে
কবে মা জাগবে সাহসী পুত্র যােদ্ধা ত্যাগীরা সগৌরবে
জানি মাগাে তুমি রত্ন প্রসবা জানি মাগো তুমি বীরের মাতা
সৎসন্তানে দেবে না জন্ম ? শৌর্য বীর্য ত্যাগী ও দাতা--
শিল্পী স্রষ্টা কবি সুগায়ক দাও মা জন্ম আবার তুমি
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর গো জেগে ওঠো মাতঃ জন্মভূমি।
তুমি মা বাঁকুড়া চিরস্মরণীয়া চিরবরণীয়া আমার কাছে
তব ঝিলিমিলি আহা নিরিবিলি প্রাকৃতিক শােভা ছড়িয়ে আছে
শুশুনিয়া আহা পাহাড়ি প্রতিমা পাথুরে শিল্পে দু-চোখ ভরে
রুক্ষ মাটির বক্ষে মা তাের ঝিরিঝিরি করে স্তন্য ঝরে
পাঁচমুড়া গাঁয়ে দেখেছি মা তোর খ্যাতি ভালোবাসা পৃথিবীজোড়া
পোড়া মাটি আর টেরাকোটা যত চিরদুরন্ত মনের ঘোড়া
পেতলের কাজে ডোকরা শিল্পে উজ্জ্বল তব স্বর্ণজ্যোতি
তাঁতের শাড়িতে এয়োতি সেজেছ চিরসতী তুমি মূর্তিমতী
গােপীনাথপুর কেঞ্জাকুড়া ও রাজগ্রামের তাঁতের চাদর
ক্রমশ তোমার সুনাম এনেছে শহরে নগরে পেয়েছে আদর
তুমি মহীয়সী কত যে শিল্পে কাঁসা ও শঙ্খ তসর গরদ
কত মনীষীকে জন্ম দিয়েছাে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ
কবিরঞ্জন রায়গুণাকার , রামানন্দের জননী তুমি
শ্রেষ্ঠ পটুয়া যামিনী রায়ের পটে-আঁকা তুমি জন্মভূমি।
চির অভিমানী বনেদি রমনী অবগুণ্ঠিতা লজ্জাবতী
ধর্মের দেশ কর্মের দেশ একতেশ্বরে শিবের সতী
তবুও মা তুমি চিরবঞ্চিতা তোমার জেলার চৌদিকেতে
দুমুঠো অন্ন পাওয়ার জন্য আজ তুমি ছেড়া আঁচল পেতে।
কারণ তোমার উঠোনে শিল্প-কারখানা-কল হয়নি হেথা
শতের মধ্যে নব্বই জনই কর্ম অভাবে ধুকছে যেথা
হলাে কত মাগো এম.এল.এ মন্ত্রী দেশনেতা আর পৌরপতি
দিল তারা কত আশা বক্তৃতা প্রলােভন আর প্রতিশ্রুতি।
কেউ তো মা তোর মোছালোনা চোখ ঘোচালো না তোর দুঃখ জ্বালা
শাসনে শোষণে দুঃখ দহনে গলাতে মা তাের হাড়ের মালা
তোমার জেলার খেতমজুরেরা অতি নগণ্য মজুরি খাটে
অথচ ফোড়েরা মুনাফখােরেরা রক্ত শুষছে তোমার হাটে।
স্কুল বোর্ড থেকে জেলা জুড়ে ঘুষের বেসাতি হাজার হাজার
ইদানিং তোর বাণিজ্যভুমি গাঁটকাটা চোরে ভরেছে বাজার,
জনহিতকর প্রতিষ্ঠানেতে সুবিধাবাদীরা নিচ্ছে ডেরা
অথচ বাঁকুড়া ধার্মিক ছিল, ছিল সারল্যে সবার সেরা।
কাঁদছে বাঁকুড়া, ধুকছে বাঁকুড়া, পুড়ছে বাঁকুড়া নানান দোষে
দেহের রক্ত, মনের রক্ত ছারপোকাগুলাে নিত্য শোষে।
প্রতিটি প্রহর আকাল এখানে ঘরে ঘরে হেথা লক্ষ বেকার
বলাে বলাে মাগাে বাঁকুড়া জননী, কে আছ এখন তােমাকে দেখার
বাঁকুড়াকে যদি ভালােবাসাে কেউ ভালােবাসাে এর হৃদয়ভূমি
বাঁকুড়ার তিনটি প্রান্তে তিনটি কারখানা গড়ে তাহলে তুমি।।
বাঁকুড়ার চাই ক্ষীরােদমঞ্চ জাতীয় মঞ্চ নাট্যশালা
যােগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি গবেষণাগার গ্রন্থমালা
গ্রামে গ্রামে চাই লাইব্রেরি আরাে, আরাে বই আরাে শিক্ষা সুযােগ
কলামন্দির, ফুটবল মাঠ মনের মতন স্টেডিয়াম হোক।
রেলপথ করাে পাঁচটি লােকাল, ট্রেনের যাত্রী আছেই আছে
জলকল সেচ-পরিকল্পনা-দিঘি ও পুকুর গ্রামের কাছে
যত আছে সব খনন করাও, মাঠকুয়াে গড়াে ব্যাপকভাবে
পােড়া ডাঙা যত ক্ষেত জমি করাে, কত যে পতিত জীবন পাবে
কৃষি-ঋণ, বীজ, সার বলদের ব্যবস্থা চাই সহজ পথে
কুটিরশিল্প উন্নয়নের পন্থাতে এসাে নতুন মতে।
বিদ্যুৎ আনাে শিল্পীর ঘরে রিবেট বাড়াও প্রােডাকশনে
দেশে ও বিদেশে পাঠাও শিল্প, বিশ্বাস আনাে জাতির মনে
দান খয়রাতি রিলিফ এবং দিতে হবে হেথা বেকার ভাতা
বাঁকুড়ার বনে মৌচাক গড়াে, পাঠাও দুরেতে বনের পাতা।
আছে প্রাণ আছে, আছে গান আছে, আছে রস আছে এ মাটি জুড়ে।
যখের ধনের সন্ধান আছে খুজে বের করাে কবর খুঁড়ে।
প্রয়ােজন-- প্রেম--প্রবীণ-পবিত্র প্রিয় মানুষ হেথা ।
বাঁকুড়ার বীর বিবেক-সত্তা বাঁকুড়া-দরদী প্রকৃত নেতা।
জানি জানি মাগাে বাঁকুড়া জননী সে মানুষ জানি জন্ম নেবে
বাঁকুড়ার কবি চিরবিপ্লবী তাঁকে শতকোটি প্রণাম দেবে ।