বাংলা ছন্দের আদিতম ছন্দ হলো স্বরবৃত্ত ছন্দ
যদিও এ ছন্দ বাংলা কাব্যের মধ্যে পরে প্রবেশ করে।
এই লোকচ্ছন্দ বাংলার লোক-প্রতিভার সৃষ্টি। যাকে লৌকগীত ছন্দ বলা হয়,বর্তমানে এ ছন্দের  নাম স্বরবৃত্ত আরো নাম রয়েছে সে নিয়ে নামকরণ স্থানে আলোচনা করবো।

ইতিহাস ঘাটলে আমরা খুঁজে পাই আদি যুগের বা প্রাচীন যুগের  মানুষ এ ছন্দে নাটক, গান করতো,
তবে শব্দাংশ বা দল বা মাত্রাবিন্যাসের ততটা সুনির্দিষ্টতা ছিলোনা। সুরের টানে ছড়াগান মানিয় নেওয়া হতো।
তবে পঞ্চদশ শতক কবিদের হাতে স্বরবৃত্তের কিছু নমুনার আভাস  দেখা যায়।
প্রথমার্ধে প্রাচীন গ্রন্থ বডুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃচনোকীর্তন নামে মিশ্রবৃত্তে রচিত কবিতায় স্বরবৃত্তের কিছু টা নমুনা পাওয়া যায়----
যথাঃ-

মোরে নাহি /ছোঁ কাহ্নাঞি-
বারাণসি যা,
আ-ঘোর/ পাপেঁ তোর
বে- আপিল গা।-------------------১৭ নং গীত

কৃত্তিবাসী রামায়ণের মিশ্রবৃত্তেও স্বরবৃত্তের আভাস

অঙ্গদ বলে  সত্য করে কও রে ইন্দ্র/জিতা
এই যত বসি আছে সব কি তোর পিতা।।
তারি জন্যে এত তেজ গুরুলযু না মানিস,
তোর বাপের  এত তেজ ইন্দ্রে বেঁধে আনিস।।

এভাবে যদি আমরা পঞ্চদশ থেকে সপ্ত দশ শতক-- দীর্ঘ তিনশ বছর পর্যন্ত কোনো কবিতার মধ্যে সুস্পষ্ট বা সঠিক  স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্তের  নির্দশন পাই না ।

এবার মধ্যযুগে
——————
মধ্য যুগেও পঞ্চদশ এর মতো কাহিনীধর্মীয় বিভিন্ন  কাব্যে মিশ্রবৃত্তের মধ্যে সামান্য স্বরবৃত্তের আভাস পাওয়া যায়।
সর্বপ্রথমে রামাই পন্ডিতের শূন্যপূরাণ,মানিকচন্দ্র রাজার গান এবং ময়নামতীর গানের মধ্যে স্বরবৃত্তের আভাস, তবে এই লৌকিক গানগুলি দীনেশচন্দ্র এবং শহীদুল্লাহ বৌদ্ধ যুগের অর্থাৎ চর্যাগীতের সমকালিন  বলে ধারোনা করা হয়।
পরবরর্তীতে সাহিত্য ইতিহাসগণ এ রচনা কে মধ্যযুগের রচনা বলেই ধরে নেন।
যথাঃ মিশ্রবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের মিশ্রণ, ময়নামতির গান।

দক্ষিণ হৈতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি
সেই বাঙ্গাল আসিয়া মুলুকৎ কৈল্লা কড়ি।।
দেওয়ানগিরি চাকরী রাজা সেই বাঙ্গালক দিল,
দেড় বুড়ি ছিল খাজনা পোন্দর গণ্ডা নিল।।

এ গানে আরবী পারশী শব্দ ব্যবহার হয়েছে তাই অতি সহজেই ধারোনা করা যায় যে মোগল পাঠান যুগে রচনা হয়েছে।

প্রখ্যাত কবি বিজয়গুপ্ত,  চণ্ডীমঙ্গল, শ্রীকুমার ও বিদ্যাপতি সহ ষোড়শ শতকের শেষে দিকে বৈষ্ণব পদাবলি অনেক কবিদের  মিশ্রবৃত্ত রচনার মধ্যে স্বরবৃত্তের আমেজ পাওয়া যায়।

বিদ্যাপতির মিশ্রবৃত্ত রচিতায়

পহিলি পিরীতি পরাণ আঁতর তখনে ঐসন রীতি,
সে আবে কবহু হেরি না হেরথি ভেলি নিমসনি ভীতি।।
ভন বিদ্যাপতি সুনহ জৌবতি সময় বুঝ সয়ান,
রাজা সিবসিংহ রূপনরায়ণ লছিমাদেই রমাণ।।

ষোড়শ শতক শেষের দিকে  ধামালী জাতিয় গীতির মাধ্যমে সুস্পষ্ট গ্রাম্য ভাষাভঙ্গিতে  বৈষ্ণব পদাবলি গানের মধ্যে কবি লোচন দাসেই সর্বপ্রথম  স্বরবৃত্তের নমুনা প্রকাশ ঘটায়।।
যথা ঃ-
ধবল পাটের / জোড়া পর্্যাছে/
রাঙ্গা রাঙ্গা / পাড় দিয়াছে/
চরণ উপর /দুল্যা যাইছে/ কোঁচা,
বাঁ-ক ম-ল/ সোনার নূপুর/
বাজ্যা যাইছে /মধুর মধুর/
রূপ দেখিয়া/ ভু-ব-ন/ মুরছা।।
          ( বৈষ্ণব পদাবলী লোচনদাস ২ নং গীত)

ঐসময় একাধিক মুসলিম কবিদেও লৌকিকগীতের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে কবি আহমদ শরীফ র চাঁদকাজী রচনা থেকো যথাঃ-

বাঁশী বাজান, --জান  না,
অসময়ে, বাজাও বাঁশি।। পরাণ মানে, না।।
যখন আমি বৈস্যা থাকি গুরুজনের কাছে
তুমি নাম ধৈর্্যা বাজাও বাশী আমি মরি লাজে
ওপার হইতে বাজাও বাঁশি  এপার হইতে শুনি
অভাগিয়া নারী হাম হে সাঁতার নাহি জানি।।

লোচনের পর সুস্পষ্ট ভাবে স্বরবৃত্ত নিয়ে আসে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। যথাঃ

চিন্তাময়ী/ তারা তুমি।।
নামে জগ/ চ্চিন্তা হরা।।
প্রভাতে দাও /অর্থ চিন্তা।।
সায়াহ্নে দাও/ অলসচ্চিন্তা।।

এদের পর দীনেশচন্দ্র, দ্বিজ রামচন্দ্র, ঈশ্বর চন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, রাজকৃষ্ণ রায়,ফকির লালন শাহ্,,, পাগলা কানাই,

আধুনিক যুগে
রবিন্দ্র নাথ ঠাকুর স্বরবৃত্তের প্রচুর পরিবর্তন আনেন,
দ্বিজেন্দ্র লাল, সত্যেন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল, জসিম উদ্দিন, ইত্যাদি কবিরা লেখেন।