গদ্যের যে স্বাভাবিক ছন্দ বা গদ্যের যে ছন্দ তা ঠিক গদ্যছন্দের অনুরূপ নয়। পার্থক্যটা হলো— গদ্যের যে ছন্দ তা গদ্যের ছন্দ আর গদ্য কবিতার যে ছন্দ তা হলো গদ্যছন্দ। এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষ ‘গদ্যকবিতা ও অবনীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের ফুটনোটে লিখেছেন—‘সুরচিত গদ্যমাত্রেরই একটা ছন্দপ্রবাহ আছে। তার ধ্বনির উত্থান-পতনে, তার যতির হ্রস্বদীর্ঘতায়, তার শব্দব্যবহারের সুমিত বলয়ে— তৈরি হয় এই ছন্দ। এর কোন পূর্বনির্দিষ্ট নিরূপিত ধরণ নেই। একেই বলা যায় গদ্যের ছন্দ। এই ছন্দ শুনেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু একদিন মুগ্ধ হয়েছিল তার ছেলেবেলার পাঠশালায়, ভেবেছিল বড়ো হয়ে খুঁজে নেবে রামায়ণ-মহাভারতের দেশ। আর এর তুলনায় গদ্যছন্দ কথাটির প্রয়োগ একটু বিশেষিত। গদ্যকবিতা নামে চিহ্নিত যে বিশেষ রচনাশ্রেণীটি, এ হলো তার ছন্দ। এরও নেই কোন পূর্ব-নির্ধারিত রূপ। কিন্তু শ্রুতিতে বা অনুভবে বুঝে নেওয়া যার সাধারণ গদ্যের ছন্দের থেকে এর স্বতন্ত্র এক স্পন্দন, হয়তো খানিকটা ছোটো আর সুষমাময় হয়ে আসে এর শ্বাসপর্বগুলি।’
কবিতাকে কবিতা বলার জন্য ছন্দ অথবা ছন্দহীনতা বড় বিষয় নয়। বড়ো বিষয় হলো কবিতাকে কবিতার নির্যাসে ধারন। সেই নির্যাস ধারনের একটি উপাদান হলো ছন্দ যেটা অনেককাল যাবৎ কবিতার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসাবে ছিল। কিন্তু গদ্য কবিতায় যাকে বাতিল করা হলো। আসলেই কী বাতিল করা হলো? মোটেই না। শুধু ছন্দের গণিত বাদ পড়লো। আসলো ভাবের আর বাক্যের প্রবাহমানতার ছন্দ। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানো কবির বরং কঠিনই হয়ে গেল! কবিত্ব কী দেখানোর জিনিস? উত্তর হবে না। কবিত্ব হয়ে ওঠার ব্যাপার। একজন কবি, কবি হয়ে ওঠার মাধ্যমে যা লাভ করে। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানোর সুযোগ আরো বেড়ে যায়। কারণ এখানে গাণিতিক ছন্দের হিসেব কষে কবিতা লিখতে হয় না। আবেগের ঘোড়াকে ভাবের ছন্দে বেঁধে গদ্য কবিতা আগায়। মঞ্চে নৃত্যরত রমণীর মতো ধরাবাঁধা ছকে নাচে না, চলার পথে নিজের খেয়াল খুশি মতো সে চলে। সুন্দর শব্দবাগানের মধ্যে হেঁটে যায় আর হরেকরকমের শব্দফুল সে মাথায় গুঁজে নেয়। সময়ে সময়ে সে বাহারি রূপ ধারণ করে এগিয়ে যায় গন্তব্যে। তৈরি হয় গদ্যছন্দ।
কবিতাকে গদ্য কবিতা বলেও ছন্দ শব্দটি পরিত্যাগ করতে পারলাম না। ‘ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য ছিল এরকম—‘সাত্ত্বিক কবিমাত্রেই গদ্যপদ্যের বিবাদ মেটাতে চেয়েছেন কিন্তু কৃতকার্য হননি। এতদিন পরে রবীন্দ্রনাথের অধ্যবসায়ে হয়তো বিরোধ ঘুচল’।
এখন মনে প্রশ্ন আসলো রবীবাবু গদ্য কবিতা নিয়ে কী অধ্যবসায়টি করলো? রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীর সাথে এক আলোচনায় বলেছিলেন— ‘ভাবকে এক-একটি ছন্দের কাঠামোর আনুগত্য মেনে চলতে হয়। কিন্তু যাকে গদ্যকবিতা বলা হয় তার নিয়মরীতি স্বতন্ত্র। তার বিশেষত্ব হচ্ছে— ভাবের আনুগত্য স্বীকার করতে হয় ছন্দকে, ভাবের মধ্যে ছন্দের গতিবিধি, ভাবভঙ্গি দেয় ছন্দকে। যদি নতুন বলে এর প্রতি বিমুখ হও তাহলে এর মধ্যে যে ছন্দ আছে তার পরিচয় পাবে না।’ আসলেই রবীন্দ্রনাথের কাছেই যেন আমাদের সবকিছুর সমাধান! কবি হুমায়ুন আজাদ ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যথার্থই বলেছেন—‘অকাশে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, আমরা সূর্যের স্নেহই পাই সারাক্ষণ। সূর্য ছাড়া আমাদের চলে না। তেমনি আমাদের আছেন একজন, যিনি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য। তার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
রবীন্দ্রনাথ যখন গীতাঞ্জলী ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন তখন তিনি ভেবেছিলেন—‘পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্য কবিতার রস দেওয়া যায় কি না।’ রবীন্দ্রনাথ ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকেও অনুরোধ করেছিলেন, তিনি গদ্য কবিতাকে স্বীকার করেছিলেন কিন্তু নিজে চেষ্টা করেননি। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ নিজেই গদ্য কবিতা লিখার প্রয়াস পান। ‘লিপিকা’ তারই পরীক্ষার ফল। ‘লিপিকা’ কাব্য হতে ‘বাঁশি’ গদ্য কবিতাটি পড়ে দেখুন—
বাঁশি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।
লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার 'পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব॥
বেতন পঁচিশ টাকা,
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে-দশ বেজে যায়,
তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥
ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥
বর্ষা ঘনঘোর।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে, পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কান্কা,
মরা বেড়ালের ছানা---
ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
মাইনের মতো,
বহু ছিদ্র তার।
আপিসের সাজ
গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
বাদলের কালো ছায়া
স্যাঁত্সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
কলে পড়া জন্তুর মতন
মূর্ছায় অসাড়!
দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---
যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
বড়ো বড়ো চোখ,
শৌখিন মেজাজ।
কর্নেট বাজানো তার শখ।
মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
এ গলির বীভত্স বাতাসে---
কখনো গভীর রাতে,
ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
কখনো বৈকালে
ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
হঠাত্ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে
অনাদি কালের বিরহবেদনা।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘোর মিছে
দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
হঠাত্ খবর পাই মনে,
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধুলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া---
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥
এ ছিল রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতার ধরন। কথিত ছন্দমুক্ত। কিন্তু একটি নিবিড় বার্তা আছে। ভাবের ছন্দ আছে। দৃশ্য আছে।