কম বেশি অনেকেরই বিভিন্ন সময়ে বুফে (buffet) ভোজনোৎসবের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় রয়েছে। কত রকম পদ (menu) সেখানে থরে থরে সাজানো। হাতে প্লেটটি নেওয়ার আগেই অনেকে  (ভোজন সেরে ফেরার তাড়া যাদের একটু কম অর্থাৎ হাতে একটু বেশি সময় আছে)  তো একবার এ দিকে সেদিক চক্করও মেরে নেন শুধু এটা ভালো ক’রে বুঝে নিতে যে, কি কি পাওয়া যাচ্ছে আজকের আয়োজনে। অনেকের  তো অভুক্ত অবস্থায় (মানে ভোজন শুরুর আগে)  বহুবিধ সুসিজ্জিত পদ দেখে ( জিহ্বার মেঝেতে বাড়তি লালারস ক্ষরণের সাথে সাথে ) বেশ করে মনে হয় , আহা! অনেক্ষণ ধ’রে অনেক পদ অনেকখানি খেতে পারলে মন্দ হয়না ! যদিও নিজের পছন্দের কয়েকটি পদের রসাস্বাদন করে একসময় ক্ষান্তি দিতেই হয় (আমি উদরপূর্তির কথা ভেবে বলছি, চেখে দেখা নিয়ে নয় কিন্তু) কারন উদর নামক আধারটির আয়তন ও ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়ার সুতীব্র ইচ্ছা জাগলেও উপায় থাকেনা। বেচারা উদর! বেচারা ঈপ্সা! এছাড়াও নিরলস ভাবে কাজ করে যাওয়া সময়মাপক যন্ত্রটির ( হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই ঘড়ির টাইম নিয়ে বলছি) ঘাড়ের কাছে বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস (চল হে বাপু! অনেক হয়েছে, এবার ফিরতে হবে ) তো থাকেই। সব মিলিয়ে, এক একটা বুফেতে আসা মানেই আমাদের অভিজ্ঞতার থলি খানি কিছুটা ভ’রে ওঠেই।

বুফে নিয়ে আমার মজার মজার অভিজ্ঞতা আছে। আমি কিন্তু যে কোন বুফেতেই (কতকটা অভ্যাস বা বদভ্যাসের বশেই) আমার খাওয়ার কাজটির মূল লক্ষ্যের সাথে সাথে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিতে ভালোবাসি। এই যেমন ধরুন, অন্যেরা কে কি খাচ্ছেন (বা খেতে পছন্দ করছেন বলে মনে হয়), কে কতটা নষ্ট করছেন, কোন পদটির কাছে ভিড় বেশি (এবং এও ভাবতে, কেন?), আর অবশ্যই আমার মত অনুসন্ধিৎসু  চোখ দুটি নিয়ে আর কে কে ও কিভাবে (আড়চোখে বা সরাসরি বা উদাসভাবে) এসব লক্ষ্য করছেন। দেশে বা বিদেশে, শহরে বা আধা শহরে, স্টার হোটেলে বা বিয়ে বাড়িতে (আজকাল মফঃস্বলেও বুফে শিল্প  ক্রমশঃ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে) বা মাঝেই মাঝেই আউটিং (outing, আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার হালফ্যাশন)-এ বেরিয়ে এদিক সেদিকের রেস্টুরেন্টে, যেখানেই বুফেতে ভোজন সেরেছি, কত কত রকম যে অভিজ্ঞতার কাহিনী আমার এই মনের খাতায় টুকে রেখেছি, তা বলে শেষ করা যাবেনা।  তবে আমার অভিজ্ঞতার বৈচত্র্যের নিরিখে যদি পর্যবেক্ষণগুলি একটু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে চাই, তাহলে সেগুলো এরকম হবে :

১. স্যালাড (salad) সবাই নিচ্ছে

সহজপাচ্যতা ও খাদ্যগুণে উপকারিতা তো আছেই, তবে আরো অন্যান্য যে কারনেই হোক (যেমন, সহজলভ্যতা তথা  প্লেটটি নেওয়ার পরেই প্রথম চোখে পড়লে, পদের সারি ধরে এগনোটা যেন তেন প্রকারেণ শুরুটা করতে, ইত্যাদি), বুফে থেকে বেরলেন অথচ একটু স্যালাড চেখে দেখেন নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।

২. নতুন পদে শুরুতে ভিড় কম, পরে বাড়ছে/কমছে ( পরিচিত/জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগে সব পদেরই অবধারিত প্রাপ্তি )

সবাই যেন ভাবছে অন্যেরা চেখে দেখুক আগে। যারা খাচ্ছে, তাদের চোখমুখের ভাব ভঙ্গিমা দেখে পরখ করা যাবে। অতি উৎসাহী ও সাহসীরা এগিয়ে যান এক্ষেত্রে। তবে এরা আবার বেশি প্রকাশবিমুখ হলে অপেক্ষারত বাকিরা মুস্কিলে পড়া যান (কারন এক তো নিজেরা এগোচ্ছেন না, আবার যারা এগিয়েছে তারা তেমন খুলে বলছেন না)। অনেকসময় (যে সময়টাকে আমরা বাংলায় বলি সৌভাগ্যজনক মুহূর্ত) কোথা থেকে কিভাবে যে কি হয়ে যায় (সব কিছু আমাদের গোচরে পড়ে না), মানুষ বেশ ভিড় করতে থাকে সেই নতুন পদটির কাছে। আবার অনেকসময় (বাংলায়, দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্ত) কোন এক অদৃশ্যকারনে যাও বা দু’চার জন নিচ্ছিল, সেই ভিড়টুকুও খালি হয়ে যায়।

৩. পাঁপড়ও অনেকেই নিচ্ছে

মনে হয়, খাদ্যগুণের জন্য যতটা না, ভোজনে নিজের খাওয়ার সুর নিজের কানে শোনার (পরবর্তী সময় পাঁপড় খাওয়ায় সময় খেয়াল করবেন ) এক অনুপেক্ষণীয় বাসনা থেকে এমন হয়। মুখরোচক, তাই খেতেও ভালো লাগে। আবার সহজপাচ্য, তাই ভয়টাও কম। তবু যারা তেল মানেই মনের কোনে ‘ভাগো, ভাগো’ হুঁশিয়ারি শোনেন, তারা একটু এড়িয়ে চলতে চান।

৪. মেন কোর্সে (main course)–র ভিড়কে কোন আলাদা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দলবদ্ধ করা যাচ্ছেনা

আমার যেমন প্লেন রাইস (plain rice) আর ডাল-মাখানি (dal makhani) হ’লেই ( সময়ের সাথে তালমিলিয়ে চলা আধুনিক এই কথাটি গোদা বাংলায় দাঁড়ায় ডাল-ভাত) হয়ে যায়। পছন্দ করি নিরামিষ খাবার। কোন বিধিনিষেধ বা উপদেশ/নির্দেশ-প্রভাবিত ভাবে নয়, নিতান্তই মনের ভালো লাগা। তাই একান্ত উপায় না থাকলে উপাদেয় (ও যে খাদ্য হিসাবে ডাক্তারি মতে যে কারো জন্য নিষিদ্ধ কিছু না হ’লে), যে কোন খাবারই আমি খেয়ে নিতে পারি। এরকম মুহূর্ত হয়ত আমাদের সবার জীবনেই আসে, যখন আমরা মনকে (তার ভালোলাগা খারাপ লাগা সহ) আমাদের পছন্দক্রমে (priority list) আমাদের দেহযন্ত্রের প্রয়োজনের পেছনে রাখি।  আমি তো থাইল্যান্ডে প্রথমবার গিয়ে বেশ মুস্কিলে পড়েছিলাম। প্রথমে খাবারের শিরোনামে দুর্বোধ্যতা (যা অনেক সময় সুন্দর খাবারের প্রতি অমর্যাদাশীল এবং অবিবেচকও) কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না নিরাপদে (আমরা স্বীকার না করলেও নিজের নিজের সংজ্ঞানুসারে আমরা সবাই নিরাপদ জীবন  ভালোবাসি) কোন খাবারটি খাওয়া যায়। অনেক খুঁজে খুঁজে একটি পদের নাম (ও চেহারা) মনে ধরল। নাম ছিল, ‘খাও খাই চিয়াও’  (Khao khai chiao)।  যারা থাই ফুড চেনেন, তারা জানবেন এটি আসলে ভাতের উপর ছড়ানো ওমলেটযুক্ত (Omelet on rice) একটি খাবার।  খেলাম। খারাপ লাগেনি।  যে কোন বুফেতেই দেখেছি, কোন নির্দিষ্ট পছন্দের খোঁজে ঘুরলেও, প্রত্যেকেই নতুন (সবসময় নতুন পদ নয়, নতুন প্রয়াসও) কিছু না কিছু ট্রাই (আমাদের বেশ আদুরে বাংরেজী শব্দটি) করে চলেছেন।

৫. স্বতোপ্রণোদিত হয়ে চাটনির খোঁজ করছেন অনেকেই

সাধারণতঃ স্যালাডের ক্ষেত্রটিতেই  ইনি বিরাজ করলেও, অনেকে প্রথমে খেয়াল না করে পরে খুঁজে খুঁজে ফিরছেন। কেউ কেউ অন্যের প্লেটে উঁকি দিয়ে চুপটি করে বুঝে নিতে চাইছেন সেখানে চাটনি আছে কিনা, তাহলে ঐ একটু জেনে নেওয়া যেত আর কি!

৬. ভোজের শেষ পদের পরিবেশনস্থলে (dessert)  জমাট ভিড়  

পরিপাচনের কথা ও আহারের পরিতৃপ্তিতে তুলির শেষ  টান  দিতেই ভোজন রসিকমাত্রই এই ক্ষেত্রটিকে খুব কমই উপেক্ষা করেন।  অনেককে আবার এই ক্ষেত্রটিতেই একটু বেশি সময়ও থাকতে দেখা যাচ্ছে।

৭. বুফে ক্ষেত্রটি থেকে প্রস্থানবিন্দুতে (exit point) রাখা মন্তব্যের খাতা

অর্থাৎ আপনি চাইলে জানাতে পারেন, কেমন লাগলো আজকের আয়োজন। কতটা তৃপ্তি পেলেন।  কোন খামতি পেলেন কিনা। কোন সুপরামর্শ যদি থাকে।  ইত্যাদি ইত্যাদি।  তবে ঐ মন্তব্যের খাতা ভরানোটা কখনোই বাধ্যতামূলক নয়। সম্পূর্ণ ও সার্বিক অর্থে একান্তই ঐচ্ছিক।  এমনকি কি লিখবেন সেটাও ঐচ্ছিক।  কিন্তু যে কথাটি সাদা অক্ষরে সেই মন্তব্যের খাতার সাদা পাতার ঠিক উপরেই লেখা থাকে সেটা দেখেছেন কি? না দেখে থাকলে নেক্সট টাইম একটু খেয়াল করে দেখবেন তো । আমি তো বেশ স্পষ্ট দেখেছি, সেখানে লেখা থাকে , “সুধীবৃন্দ, আমাদের সাধ্যমত আপনাদের যথাযথ রসাস্বাদনের লক্ষ্য নিয়েই এই আয়োজন করা হয়েছিল।  আপনাদের নিঃশব্দ (কিছু না লিখেও যা দেওয়া যায়) ও সশব্দ (যা আপনি শব্দ সাজিয়ে লিখছেন) সমস্ত প্রকার মন্তব্যই আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ।  তাই আপনি লিখুন (কম লিখুন, বেশি লিখুন, যা খুশি লিখুন)। কিংবা লেখার যায়গাটি খালি রেখে দিন। শুধু বিশ্বাস করবেন যে, এই পদ গুলি পরিবেশন করতে গিয়ে, বহুবিধ পাচক বহু ঘাম আর বহু অশ্রু (যেমন, পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে আর কি) আর বহু সময়  ব্যয় করেছেন শুধু মাত্র আপনাদের খুশিমুখটি দেখার নেশায়। তাই মুখে খুশিভাবে ফোটাতে আমরা ব্যর্থ হ’লেও, অনুগ্রহ ক’রে আমাদের পাচকদের পরিশ্রমের কথা ভেবে এমন কোন নিরুৎসাহজনক আবহ তৈরী করবেন না যাতে পাচকসমগ্রের পাচনশিল্প বন্ধ না হ’লেও, এই বুফে থেকে তাদেরকে আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলি”।

আরেকটি ব্যাপার আমি খেয়াল করেছি যে, অনেক সময়েই পাচকমহাশয় নিজেও হয়ত (মাঝে মাঝে অবশ্য বোঝা যায়না) রান্নাঘরের পোশাকটি পাল্টে নিয়ে ঠিক আমারই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে। উনি নিজের খাবারের সাথে সাথেই আড়চোখে কিন্তু আমাকেও খেয়াল করছেন। মানে খাবারের রসাস্বাদনে আমার মুখমন্ডলে যে তৃপ্তি/অতৃপ্তির পরিচায়ক ( কখনো সহজবোধ্য, কখনো দুর্বোধ্য ) রেখাগুলি ফুটে উঠছে (যা আমি যত লুকাতেই চাই না কেন, পাচকমহাশয় ঠিক বুঝবেন) সেই সঙ্কেতলিপির অর্থোদ্ধার (decode) করে চলেছেন। আর সবার অলক্ষ্যে সব কিছু খেয়াল করে চলেছেন বুফে পর্বটির মূল আয়োজক/আতিথ্যকর্তা (host)। প্রতিটি অভ্যাগতের (যতখানি সম্ভব) পরিতৃপ্তি লাভে যথাসাধ্য সহযোগিতার কথা কথা ভেবে কত সুবিধার ব্যবস্থাই না করেন! প্রতিবন্ধীদের জন্যও রাখেন বিশেষ ব্যবস্থা। যেমন অন্ধের জন্য ব্রেইল (braille) পদ্ধতিতে লিখিত মেনুকার্ড কিংবা শারীরিভাবে অক্ষমদের জন্য বিশেষ আসনের ব্যবস্থা কিংবা মানসিকভাবে অনগ্রসরদের জন্য বিশেষ বিনোদনমূলক প্রদর্শন ইত্যাদ ইত্যাদি। আপনি বুফে ভোজনে এসে (তা সে ভোজনরসিক হিসাবে আপনি যে প্রকৃতিরই হোন) যদি সত্যি কোন না কোনভাবে মনের পরিতৃপ্তিলাভ করেন, তাহলে জানবেন তিনজন ব্যক্তি অতি অবশ্যই আপ্লুত হ’ন: এক, আতিথ্যকর্তা, দুই, সংশ্লিষ্ট পদটি/পদগুলির পাচক/পাচকবর্গ এবং তিন, আপনি নিজে (যেহেতু নিছক অভিজ্ঞতালাভ দিয়েও মানসিক সমৃদ্ধি পাওয়া যায়)।  আরো একটি মজার দিক হ’ল, তিনজনই কিন্তু প্রাথমিকভাবে পরিতৃপ্তি পাওয়া নিয়ে কোন সম্যক রূপরেখা মাথায় রাখেন না। কিন্তু যখন পরিতৃপ্ত হ’ন, তখন সেটা অনুভব করেন। অনেকটা সেই, ভালো লাগলে ভালো। কিন্তু ভালো না লাগলে কোন ক্ষতি তো নেই।

শ্রদ্ধেয় পাঠক/পাঠিকা, এই পর্যন্ত এসে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ত আপনি। হয়ত ভাবছেন এডমিন মহাশয় পই পই ক’রে বলে দেওয়া সত্ত্বেও এরকম কবি ও কবিতার সাইটে খাওয়া দাওয়া নিয়ে, বুফে নিয়ে এসব কি বলে চলেছে মানুষটি। কি ভাবছেন কি? অনুগ্রহ করে বিভ্রান্ত হবেন না। আমি গ্রহণযোগ্য বিষয়ের সীমানাতেই আছি। যেহেতু এটা কবিতা নয়, আলোচনা; যেহেতু  আমরা এই মুহূর্তে মুখোমুখি ব’সে, তাই হেঁয়ালিপূর্ণ বা উপমাত্মক শৈলী অবাঞ্ছিত। তাই  মিসিং লিঙ্ক (missing link)-টা ধরিয়ে দিচ্ছি।

মনে করা যাক, আমাদের এই আসরটি এমনই কোন এক বুফে ভোজনোৎসবের ক্ষেত্র। আমাদের মাননীয় এডমিন মহাশয় হ’লেন তথাকথিত আতিথ্যকর্তা।  আসরের এক একটি কবিতা হ’ল এক একটি পদ। পাচক হলেন কবি নিজে। পদের তারতম্য হল কবিতার সুরের তারতম্য।  মেন কোর্স হ’ল সেই সব উপাদানটি যার স্বাদ কবি, কবিতা ও পাঠককে এক অনন্য সূত্রে বাঁধবেই। সেই স্বাদ যা একটু আস্বাদন না ক’রে এই আসর থেকে বেরনোতে অসম্পূর্ণতাদোষে দুষ্ট হ’তে পারে আমাদের আগমন/বিচরণের প্রয়াস। আর বহুবিধ তালিকা ও অন্যান্য ফিচার হ'ল সেই সুবিধা যা সরাসরি কোন কবিতার গরিমাকে প্রভাবিত না করলেও অনেকেরই মনোরঞ্জন ও মনোবাঞ্ছাকে প্রভাবিত ক'রে তাদের তৃপ্তিলাভের প্রক্রিয়াটি আরো সহজ করে (যেহেত আতিথ্য কর্তা চাইবেনই যত বেশি সংখ্যক অভ্যাগতকে যত বেশিভাবে তৃপ্তি দেওয়া যায়)। এভাবে ভাবলে, মনে হয় আপনারা এবার আলোচনার কিছু প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছেন। পাচ্ছেন কি?

গন্তব্য

পুরো বুফে ভোজন পর্বটি যদি একটি যাত্রাপথ হয়, তার নিশ্চয় এক গন্তব্য আছে। হ্যাঁ গন্তব্য বলছি, যাত্রাপথের শেষ নয়। গন্তব্য হ'ল এক উদ্দেশ্যমূলক যাত্রাপথের পরিণতি পর্যায়, আর যাত্রাপথের শেষ হ’ল কোন বিশেষ অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য মাথায় না রেখেও এক সময় পথ চলতে চলতে যেখানে এসে পোঁছে যাওয়া হয় শেষ পর্যন্ত।

আমি বিশ্বাস করি আসরের গন্তব্য হ’ল সৃষ্টিসুখের উল্লাসকে অনুপ্রাণিত ক’রে মানবতার ও ‘সুন্দর’-এর জয়গান গেয়ে জীবনবোধকে আরো আরো বেশি বেশি উৎসাহিত হতে দেখা যা’তে অসুন্দর মনের মানুষ সুন্দর মনের হয়ে ওঠেন  এবং সুন্দর মনের মানুষ আরো সুন্দর।  আর এই পথে যদি কেউ কেউ বিখ্যাত কবি হয়ে ওঠেন, যদি কোন কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ বহুজনসমাদৃত হয়ে ওঠে, যদি কোন কুর্নিশযোগ্য স্বীকৃতি মেলে, সেসব কিন্তু বাড়তি প্রাপ্তি হবে। এটা আমার উপলব্ধি।  আপনারা সহমত পোষণ না করলে নিশ্চয় গঠনমূলক ও সৃষ্টিশীল প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

মন্তব্য

তা সে নিঃশব্দই (অর্থাৎ নীরবে পাঠ) হোক বা সশব্দ, একটি শব্দে হোক বা অগুণতি শব্দে, সাদামাটা হোক বা রাশভারি সজ্জার আতিশায্যে,  একটি মন্তব্যও কিন্তু সৃজনশীল মননের পরিচায়ক হতে পারে।  কিছু লেখা মানেই সেটা মন্তব্য, আমি সেটা মনে করিনা (অর্থাৎ অমন্তব্যও হয়ে উঠতে পারে)।  আর কিছু লেখাটাই সব সময় প্রত্যাশিত, তাও  নয়।  আর সেটা হলে সেই তথাকথিত প্রস্থানবিন্দুতে প্রহরারত রক্ষী কিন্তু আপনাকে দিয়ে মন্তব্যের খাতায় না লেখা পর্যন্ত রেহাই না দেওয়ার বিধান থাকত সর্বত্র।  তাই এমনকি যদি মন্তব্যের খাতা এক্কেবারে শূন্যও থাকে, তা দিয়ে কিছুতেই প্রমাণ হয়না যে, বুফের পদগুলি ভোজনকারীরা উপভোগ করেন নি।, ঠিক যেভাবে খাতা ভর্তি মন্তব্যও ভোজনের সর্বজনগ্রাহ্য তৃপ্তি সূচিত করেনা।  আর এটা আপনি আমি না মানলেও, সেই পাচক নিজেই মানেন।  বিশ্বাস হ’চ্ছে না? না হ’তেও পারে। সেক্ষেত্রে  গন্তব্যটি হয়ত আমি যেরকম ভেবেছি আপনি হয়ত তেমন মনে করছেন না। অন্য কিছু।

আমি এক কবিবন্ধুর পাতায় চমৎকার এক প্রতিমন্তব্য পেয়েছিলাম যা আমার মনকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। সেখানে কবিতায় পাঠকের উদাসীনতা প্রসঙ্গে উনি মনে করেছিলেন, 'আমার কবিতা গুলোর ব্যাপারে উদাসীন, যেমন করে, যেভাবে পারুক শুধু বেঁচে থাকুক আমার গরুটা- এ টাইপের চিন্তা"।  

অমন্তব্য

একটি মন্তব্য যে কোন চেহারাতেই (এক শব্দের, দুই শব্দের, বা অত্যধিক শব্দের) যদি লক্ষ্যবস্তুকে (পদ সৃষ্টিকারী পাচক ও অন্যান্য ভোজনকারী) ছুঁতে ব্যর্থ হয় কিংবা বিরূপ অনুভূতির ( গঠনমূলক সমালোচনা বা  সৃজনশীল নেতিবাচকতা দিয়ে নয়, এমন কিছু যাতে পাচক কষ্ট পান মনে মনে) উদ্রেক করে, তাহলে একটি আপাতঃ মন্তব্য (মানে কবিতার পাতায় বিরাজমান অবস্থায়) প্রকৃতপক্ষে অমন্তব্যে পর্যবসিত হবে। কেউ শংসাপত্র দিয়ে তা চিহ্নিত করবে না। কিন্তু মন্তব্যকারী ও লক্ষ্যবস্তু উভয়ের উপলব্ধিতেই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কবিতার আসরে আমার শেষ লেখাটিতে দু'টি অদ্ভুৎ মন্তব্য পেয়েছিলাম, যেখানে অবশেষে একটির ব্যাখ্যা পেলেও, অন্যটি নিয়ে আমার অনেকখানি সময় ধরে ভেবেও (এমনকি এখন অব্দি) আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি, কেন এমন মন্তব্য করেছেন। আমার মনে হয়, আমরা মন্তব্য না করতে চাইলেও, অমন্তব্য করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতেই পারি। অন্ততঃ আসরের সৌন্দর্যের স্বার্থে। আসরের মঙ্গলের স্বার্থে।

সব সময় একটি কঠিন কাজ করাতেই আমার মনে হয় পরিতৃপ্তি বেশি আসে। যেমন, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বদলা নেওয়া তো একটি শিশুও পারে, কিন্তু ক্ষমা করে দিয়ে নিজের মনুষ্যত্বকে উজ্জ্বল করতে পারা অনেক কঠিন কাজ। কাউকে ভালোবাসতে পারা অনেক সহজ, কিন্তু খারাপবাসতে না পারাটা বেশ কঠিন। মন্তব্য করে ফেলাটা বেশ সহজ, কিন্তু অমন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারাটা বেশ কঠিন। সহজ কাজ করতে পারাতে আর আনন্দ কিসের! মামা-ভাগ্নে পাহাড়ে (পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম জেলার এক পাহাড়) চড়ে কেউ নিজেদের বীর ভাবিনা, এভারেস্টে জয় করলেই ভাবি।

কিছু অপ্রতিকুলতা থাকবে। যেমন রাইটক্লিকের সুযোগ না থাকাতে কিছু অসুবিধা থাকলেও, সুরক্ষার্থে অনেক সুবিধাও পাওয়া যায়। লাইক অপশন না থাকাতে ফেসবুক ঘরানায় যারা স্বচ্ছন্দ, তাদের হয়ত সাময়িক অসুবিধা হবে। সমস্ত নিয়মাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নথিবদ্ধ করে প্রকাশিত না থাকায় কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ত থাকবে। কিন্তু আমাদের যেহেতু একটা প্রদত্ত পরিস্থিতিতেই (given scenario) এগিয়ে চলতে হয়, তাই পরিস্থিতির সাপেক্ষে খাপ খাইয়েও কিন্তু বজায় রাখা যায় সুন্দরের পূজা। সৃষ্টিসুখের উল্লাস। চেতনার উন্মেষ।

আসুন সবাই ভালো থাকি। সুস্থ থাকি। কবিতায় থাকি। আর অতি অবশ্যই সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে থাকি।