প্রতি রাতে কিছু দুঃস্বপ্ন আসে আমার নিদ্রার গভীরে
কিছু দুঃস্বপ্ন জড়ো হতে থাকে আমার রাত্রির জানালায়;
রোজ রাতে আমি শুনতে পাই কিছু দুঃস্বপ্নের দুয়ার ভাঙার শব্দ;
আমি ভীত হই, আমি স্তম্ভিত হই, আমি বিক্ষুব্দ হই।
দুয়ার খুলে দেখি এ কোনো দুঃস্বপ্ন নয়
আমার সামনে দাড়িয়ে আছে পূর্ব পুরুষদের লাখো লাখো অতৃপ্ত প্রেতাত্মা,
আমার স্বপ্নে যারা বার বার হানা দেয়, ভর্ৎসনা দেয় তাদের তৃষিত আত্মারা;
তারা ক্রন্দিত, তারা বিমর্ষ, তারা বিক্ষু্ব্দ, তারা অবসন্ন;
তাদের চোখে মুখে ভর করছে গ্লানি, বুক ভরা চাপা আর্তনাদ
আমি ভীত হই, আমি স্তম্ভিত হই, আমি শঙ্কিত হই।
স্তনহীন এক কুমারীর প্রেতাত্মা চিৎকার করে বলে ওঠে--
আমি এক ধর্ষিতা,
ছেচল্লিশে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বুনো শুকুনেরা ,
আমার কাটা স্তন নিয়ে হয়েছে পাশবিক উল্লাস;
কি দিয়েছে তোমাদের সেই ধর্ম? স্বাধীনতা?
দিয়েছে শুধুই অনাহার, বৈষম্য, শোষণ আর নিপীড়ন;
তবু চেয়েছিলাম ভালো থাক এই মাতৃভূমি, নিপাত যাক সব বৈষম্য।
আমি নিশ্চুপ হয়ে রই, আমাকে ভর করে নীরবতা।
ঝাঝরা বুকে সদ্য কিশোরে পা দেওয়া এক বালকের প্রেতাত্মা কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
আমি তোমাদের ভাষা দিলাম, বর্নমালা দিলাম
আমার চেতনার শহীদমিনার আজ কেনো পাদুকায় ঢেকে যায়?
আমি নিশ্চুপ রই, লজ্জা ভর করে আমায়, আমি অবনম্র হয়ে রই।
বুলেট বিদ্ধ রক্তমাখা শার্ট পরা এক প্রেতাত্মা ধিক্কার দিয়ে বলে--
যে ভূমির জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলাম দ্বিধাহীন চিত্তে,
যে জাতিকে মুক্তির স্বাদ দিলাম,
সেই ভূখন্ড আজও কেনো গিলে খায় ঐ লুটেরা, চাটুকরেরা?
সমবেত কন্ঠে লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রেতাত্মা চিৎকার করে জানতে চায়--
আমাদের আত্মত্যাগের এই পূন্য ভূমিতে
কেনো আজও এত বৈষম্য, কেন এত বিষাদ?
কেনো নর্দমায় পড়ে থাকে আজও পরিচয়হীন কোন বিভৎস লাশ?
কেনো আজও ধর্ষিতার আর্তনাদ ভাগীরথীর এই বাংলায়?
তবে কি শুকিয়ে গেলো এই সবুজ জমিনে আমাদের রক্তের দাগ?
আমি লজ্জিত হয়ে রই, শীতলতা আমায় ভর করে, আমি নির্বাক হয়ে রই।
হঠাৎ ১৮ টা বুলেটের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে তর্জনী উচিয়ে একটি ভরাট কন্ঠ বলে উঠলো--
আমার সারাটা জীবন শুধু সাধারণ মানুষের জন্য বিলায়ে দিলাম,
আমি তোমাদের একটি স্বাধীন ভূখন্ড দিলাম,
আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিলাম,
তবে আজ আমার বাংলা এত বিমর্ষ কেন?
মানুষে মানুষে এতো ভেদাভেদ কেনো?
সাধারন মানুষের বুকে এত বঞ্চনা কেন?
বাংলায় মাটিতে আজও হায়েনা কেনো?
জেগে ওঠো, চোখ খুলে দেখো-
এই বাংলায় আবার জেগেছে সব পুরানো পিশাচেরা,
যারা সেদিন বাংলা চায় নি
মুছে দিতে চেয়েছিল আমাদের সংগ্রামী মহাকাব্যগুলো,
আজ তারা বহুরূপী, ভিন্ন বেশে খুবলে খুবলে খাচ্ছে এই লাল সবুজের ধ্বজা।
আমি নিশ্চুপ হয়ে রই, শীতলতা ভর করে আমার সমগ্র শরীরে।
আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি ঘুমোতে পারি না
আমি তাকিয়ে থাকি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ঐ মানচিত্রের দিকে;
আমি স্পষ্ট দেখতে পায়--
এ দেশ ভরেছে আজ চেতনার দালালে,
এ দেশ ভরেছে আজ লুটেরায়- শৃগালে,
এ দেশ ভরেছে আজ অনিয়ম-উৎশৃঙ্খলে,
এ দেশ ভরেছে আজ মুনাফাখোর-চাটুকরে,
এ দেশ ভরেছে আজ বিবেকহীন মূর্খে ,
এই বাংলার উর্বর ভূমি আজ খুবলে খাচ্ছে মুখোশের আড়ালে সব পুরোনো দুর্ভিক্ষ;
তবু নির্বিকার, তবু নির্বিকার আমি- শূন্য দৃষ্টিতে খুঁজে ফিরি নূর হোসেনের বাংলাকে।
মানুষে মানুষে আজও শুধুই বৈষম্য, সাম্য নেই কোথাও;
রক্তচোষারা আজ প্রকাশ্যে চুষে খায় মানচিত্রের শিরা উপশিরা;
মেধাহীন এক লোভী অসাড় জাতির পথে আমার প্রিয় স্বদেশ;
বিশ্বাসঘাতকদের রক্ত চ্ক্ষু আজও হুংকার দেয় প্রকাশ্যে ;
তারা ফিরে এসেছে আরো শক্তি নিয়ে, তারা ফিরে এসেছে এবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে;
দেশ প্রেমিকেরা আজ অন্ধকারের নির্বাসনে;
আমি ভীত হই,আমি শঙ্কিত হই।
লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের এই পূন্য ভূমি আজও সাধারণ জনতার নয়!
শ্রেনী বৈষম্যে নিপীড়িত আজও জনতা!
আমি ক্ষমা চেয়ে নিই আমার পূর্ব পুরুষদের কাছে, আমি অবনত মস্তকে ক্ষমা চেয়ে নিই।
আমার হাত আজ শৃঙ্খলিত, আজ আমার পায়ে শিকল বেড়ি, আমার কন্ঠ আজ অবরুদ্ধ
তবু ভাষাহীন কন্ঠে চিৎকার করে বলতে চাই--
হে আমার বঙ্গভূমি,
আমি ভুলিনি লাখো শহীদের রক্তের ঋন
আমি ভুলিনি একটি তর্জনির নির্দেশনা
আমি ভুলিনি সেই যাদুকরি শব্দ
আমি ভুলিনি সেই হিমালয়কে
তাই দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই--
এ ভূমি কোন রক্তচোষার নই, এ ভূমি কোন লুটেরার নয়, এ ভূমি কোন চাটুকরের নই, এ ভূমি নয় কোন লোভী মুনাফাখোরের।
এ ভূমি জাতির পিতার,
এ ভূমি জাতীয় চার নেতার,
এ ভূমি লাখো লাখো শহীদের,
এ ভূমি সাধারন জনতার,
একদিন জাগবে এ দেশ, একদিন জাগবে আবার--
এ ভূমি হবে সাধারণ জনতার।
আমি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, আমি স্বপ্ন দেখি, আজও স্বপ্ন দেখি--
সেই শব্দের যাদুকরের স্বপ্নের সোনার বাংলার।
বিপ্লব কুন্ডু
২০২০০৮০৮।